মিঠি নামের এই শহরে হিন্দুদের প্রতি সম্মান রেখে গরু জবাই করে না মুসলমানেরা, রমজান মাসে মুসলিম ভাইদের সঙ্গে সারাদিন উপোষ থাকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা, নামাজের সময় বন্ধ থাকে মন্দিরের আরতি। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের বুকে...

পাকিস্তানের নাম শুনলেই ইউরোপ-আমেরিকার লোকজন ভ্রু কুঁচকে তাকায়, কারণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই দেশটা বেশিরভাগ সময় শিরোনাম হয় জঙ্গীবাদ, বোমা হামলা, অনার কিলিং, সংখ্যালঘু নির্যাতন বা মৌলবাদী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। জনসংখ্যার অনুপাতে পাকিস্তানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার হার বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল একটা সময়, অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে হিন্দু এবং শিখ ধর্মাবলম্বী অজস্র মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে গেছে। আর যারা ধর্মে বিশ্বাস করে না, তাদের জন্য তো পাকিস্তানকে নরক বললেও কম বলা হবে। এখানে সংখ্যালঘুদের ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা বা ধর্মীয় নানা গোঁড়ামি নিয়ে আওয়াজ তোলার একমাত্র পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু। 

এখন আপনাকে যদি বলা হয়, সেই পাকিস্তানেই একটা ছোট শহর আছে, যেখানে হিন্দু-মুসলমান বসবাস করে দারুণ সৌহার্দ্যের সঙ্গে, সেই শহরে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগের কথা চিন্তা করে মুসলমানরা গরু জবাই করে না, আবার রমজানের সময় হিন্দুরাও মুসলমানদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে উপোষ থাকে, দিনের বেলায় খাবারের দোকান বন্ধ রাখে, মন্দিরে আরতির শব্দ শোনা যায় না এই এক মাস- সেখানে ধর্মের নামে দাঙ্গা হয় না, সংখ্যালঘু বলে কাউকে নির্যাতন করা হয় না, কেউ কাউকে 'মালাউনের বাচ্চা' বলে গালি দেয় না- এমন কিছু শুনলে নিশ্চয়ই বিশ্বাস হবে না কারোরই! প্রথমবার যখন শুনেছিলাম, আমারই বিশ্বাস হয়নি। কিন্ত গুগল ঘেঁটে জানা গেল, তথ্যগুলো শতভাগ সত্যি। 

পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের থারপারকার জেলার রাজধানী মিঠি। ছোট শহর, উন্নতির ছোঁয়া খুব একটা লাগেনি এখনও। বড় বড় দালানকোঠা নেই, যোগাযোগব্যবস্থাও খুব উন্নত নয়, রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ট্রেন আর বাসে ভেঙে ভেঙে আসতে ঘন্টা বিশেক লেগে যায়। মিঠি শব্দের মানে হচ্ছে মিঠাই, এক ধরণের মিষ্টান্ন। এই শহরের মানুষগুলোর মনও তো মিঠাইয়ের মতো চমৎকার। নইলে পাকিস্তানের মতো উগ্রবাদী লোকজনের ভর্তি একটা দেশে এমন চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা কি সম্ভব?

মিঠি শহরের মুসলিম নারীরা

এই শহরের জনসংখ্যার শতকরা আশিভাগই হিন্দু। পাকিস্তানে এটাও একটা ব্যতিক্রম, দেশটির আর কোন শহর বা গ্রামে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, একমাত্র মিঠিতেই এমন বিরল ঘটনা ঘটেছে। এই গ্রামে কখনও গরু জবাই করা হয় না। এমন নয় যে কোন নিষেধাজ্ঞা আছে, মুসলমানরাই নিজেরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হিন্দু ধর্মে গরুকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে, তাই কুরবানীর সময় এখানে ছাগল এবং ভেড়া জবাই করা হয়। এখানে ঈদের উৎসবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও শামিল হয় পূর্ণ আনন্দ নিয়ে, সম্প্রীতির অদ্ভুত একটা বাতাবরণ তৈরি হয় গোটা শহরজুড়ে, সেটা মিঠিতে এসে স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। 

রমজান মাসে মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এখানকার হিন্দুরাও দিনের বেলায় কোন খাবার গ্রহণ করে না, এমনকি কেউ পানি খেলে সেটাও আড়ালে গিয়ে খায়। ইফতারের সময় হলে প্রতিটা দোকানে, বাড়িতে ইফতারের আয়োজন করা হয়, সেখানে একসঙ্গে উপোষ ভাঙেন হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের মানুষই। খাবারের দোকান বন্ধ রাখা হয় দিনে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কেউ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়নি। নামাজের সময় মন্দিরের আরতি বন্ধ রাখা হয়, আবার মন্দিরে যখন প্রার্থনা চলে, তখন মসজিদের মাইক বন্ধ থাকে। অদ্ভুত একটা সাম্যাবস্থা বিরাজ করে গোটা গ্রামজুড়ে, শুনতেই কেমন যেন রূপকথার মতো লাগে ব্যাপারগুলো। 

এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। মহররম মাসটা মুসলমানদের জন্য শোকের, এই মাসে এই গ্রামে কোন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় না। মুসলমানের তো না-ই, হিন্দুরও না। আশুরার দিন যখন তাজিয়া মিছিল বের করা হয়, সেই মিছিলে সামনের দিকে থাকে হিন্দু তরুণরাও। ঈদ আর দিওয়ালিতে উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় শহরটা, যে উৎসব সবার, সেখানে হিন্দু-মুসলমানের কোন ভেদাভেদ নেই। এই শহরে কখনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি, মসজিদে হামলা হয়নি, মন্দিরে গিয়ে কেউ প্রতিমা ভাঙচুর করেনি কখনও। ছোটখাটো চুরির ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটলেও, ডাকাতি, খুন বা ধর্ষণের মতো বড় অপরাধ কখনোই প্রত্যক্ষ করেনি মিঠির জনগন। 

এই শহরে গরু জবাই করা হয় না

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় নয় শতাংশ ছিল হিন্দু-শিখ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ফলে সেই সংখ্যাটা এখন কমে দুই পার্সেন্টের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। মৌলবাদীদের হামলায় শত শত মন্দির-গুরদ্বার বিধ্বস্ত হয়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে এসেছে এসব অত্যাচার নির্যাতনের কারণে। এখনও সেদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চলে, সেসবের কোন প্রতিবাদ বা বিচারও হয় না। সেই পাকিস্তানের সঙ্গে মিঠির ছবিটা বড্ড বেমানান। 

এই গ্রামের শিশুদের মনে অসাম্প্রদায়িক চেতনার চাষাবাদ করা হয় একদম ছোটবেলা থেকেই। ধর্ম পালনে উৎসাহ দেয়া হয় পারিবারিকভাবে, কিন্ত তারচেয়ে বেশি শেখানো হয় অন্য ধর্ম ও মানুষকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে, কাউকে আঘাত করে কথা না বলতে, কারো ক্ষতি না করতে। কট্টরপন্থার কোন স্থান নেই মিঠি নামের এই গ্রামটাতে, এখানে দেখা মেলে শুধু ভালোবাসার, মনুষ্যত্বের। এই গ্রামে মসজিদের ইমাম আর মন্দিরের পুরোহিত পাশাপাশি বসে আড্ডা দেন, খাওয়াদাওয়া করেন, সমাজ-দেশ-রাজনীতি বা ধর্ম নিয়ে তাদের আলাদা ভাবনা থাকতে পারে, কিন্ত মিঠিতে শান্তি বজায় রাখার ব্যাপারে তারা সবসময় একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকেন।

মরুভূমির মাঝখানে অনুন্নত একটা মফস্বল শহর, যেখানে প্রযুক্তির ছোঁয়া খুব একটা লাগেনি, যেখানে দারিদ্র‍্য আছে, অভাব আছে, জীবনের সংগ্রাম আছে, সেখানেও মানুষগুলো কি চমৎকারভাবে ভালোবাসার ফুল ফোটাচ্ছে, ধর্মের ভূমিকা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে গোটা বিশ্বকে। ধর্মের নামে যখন চারপাশে হানাহানি চলছে, ঘৃণার বাম্পার ফলন হচ্ছে, তখন মিঠি শহরটা আমাদের জানান দেয়, ধর্ম আসলে ভালোবাসতে শেখায়, যারা ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ায়, তারা কখনোই ধার্মিক হতে পারে না। এখানকার মানুষগুলো ধনে ধনী না হতেই পারে, কিন্ত মনের দিক থেকে তাদের মতো ধনী আর কেউই নেই... 

তথ্যসূত্র- ডন, নিউইয়র্ক টাইমস, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট

 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা