মিথিলাকে সবাই চিনলেও মিথিলার কবি বিদ্যাপতিকে বোধহয় চাকরি পরীক্ষার্থী ছাড়া কেউ চেনে না। শৃঙ্গার রসে ভরপুর পদাবলি লেখা এই কবি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথও...
কে এই বিদ্যাপতি? তার কোন গুণের জন্যে তাকে দেহবাদী কবি বলা হয়? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো এই লেখায়৷
বিদ্যাপতি হলেন মধ্যযুগের কবি। নির্দিষ্ট করে বললে, বিদ্যাপতি পঞ্চদশ শতকের কবি। বিদ্যাপতি জন্মগ্রহণ করেন ভারতের মধুবনি বিহারে। তার জন্মসাল নিয়ে মতভেদ আছে। বলা হয়, ১৩৫০-৭৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি দ্বারভাঙা জেলার সীতামারী মহকুমার বিম্ফি নামক গ্রামের একটি বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বংশপরম্পরায় বিদ্যাপতির পরিবারের লোকজন কাজ করতো মিথিলার রাজপরিবারে। বিদ্যাপতির আসল নাম জানা যায়নি। তবে জন বীমসের মতে বিদ্যাপতির আসল নাম বসন্ত রায়।
প্রাচীন ভারতের রাজ্য মিথিলার ভাষার নাম মৈথিলী। ইন্দো-আর্য গোত্রের এই ভাষাটি ভারতের বিহার ও নেপালের তেরাই এলাকায় প্রচলিত। এই ভাষাটি হিন্দি থেকে কিছুটা আলাদা, কিন্তু এর সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বাংলা, অসমীয়া ভাষার। বিদ্যাপতি এই ভাষায় কবিতা লিখতেন। এজন্যে তাকে বলা হতো মিথিলার কবি।
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর॥
ঝম্পি ঘন গর্জন্তি সন্ততি
ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।
কান্ত পাহুন কাম দারুণ
সঘনে খর শর হন্তিয়া॥
কুলিশ শত শত পাত-মোদিত
ময়ুর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরি ডাকে ডাহুকী
ফাটি যাওত ছাতিয়া॥
তিমির দিগ ভরি ঘোর যামিনী
অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।
বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি
হরি বিনে দিন রাতিয়া॥
- বিদ্যাপতি
ভরা বাদরে অর্থাৎ ঝুম বৃষ্টির দিনে কবি প্রিয়ার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যে আকুল। প্রিয় মানুষটার জন্যে তার মরমে যে বিরহ, তার আকুলতা, মর্মবেদনা সেটাই তিনি বলতে চেয়েছেন এই কবিতায়। তিনি দৃশ্য বর্ণনা করে বোঝাতে চাইছেন, এমন একটা দিনে তিনি প্রিয় মানুষটাকে কতটা অনুভব করছেন।
বিদ্যাপতি এই যে ভাষায় পদাবলি লিখতেন তার সেই পদাবলির ভাষার নাম ব্রজবুলি যা মিথিলার উপভাষা। মিষ্টি ব্রজবুলি ভাষায় কবিতা লেখার কারণে মধ্যযুগের গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি হিসেবে নাম করেন বিদ্যাপতি। বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির স্থান অনন্য। বিদ্যাপতির প্রভাব আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথও ব্রজবুলি ভাষায় পদাবলি লিখেছেন বিদ্যাপতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। ব্রজবুলিতে লেখা রবীন্দ্রনাথের পদাবলির গ্রন্থও আছে 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি' নামে!
আজু সখি, মুহু মুহু
গাহে পিক কুহু কুহু
কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু
দোহার পানে চায়
- ব্রজবুলি ভাষায় কবিতা
বিদ্যাপতিকে কোনো কোনো দেহবাদী বলে আখ্যায়িত করেন। বিদ্যাপতির কবিতায় মানবিক অনুভূতির ঝংকার ওঠে। এই যেমন রাধাকে তিনি কবিতায় সাজান মানবীয় গুণাবলী দিয়ে। রাধার বয়ঃসন্ধির দৈহিক সুষমা ও লাস্যময়তা তার পদাবলিকে ঐশ্বর্যময় করেছে। তিনি অলৌকিক প্রেমকাহিনীকে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখার প্রয়াস নিয়েছেন। ফলে রাধা, যৌবন, কৃষ্ণের প্রতি বিরহ তীব্র হয়ে দেখা দেয় তার কবিতায়।
কবি বিদ্যাপতি তার কবিতায় কামশাস্ত্রে অনভিজ্ঞ বালিকা রাধাকে শৃঙ্গার রসের পূর্ণাঙ্গ নায়িকায় রূপান্তরিত করেছেন। তুমুল প্রেমানুভূতি দেহমনকে আচ্ছন্ন করে রাধার মনে ভাবান্তর এনেছেন। বিদ্যাপতির পদে রহস্যময়ী নায়িকার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি প্রত্যক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন "এই পদগুলি পড়িতে পড়িতে একটি সমীর চঞ্চল সমুদ্রের উপরিভাগ চক্ষে পড়ে। কিন্তু সমুদ্রের অন্তর্দেশে যে গভীরতা, নিস্তব্ধতা যে বিশ্ববিস্মৃত ধ্যানশীলতা আছে তা বিদ্যাপতির গীতি তরঙ্গের মধ্যে পাওয়া যায় না"।
সম্ভবত কবিতায় মানুষ, শরীর, দেহ মনের মানবিক বর্ণনার কারণে বিদ্যাপতিকে বলা হয়েছে দেহবাদী কবি। বিদ্যাপতি মৃত্যুবরণ করেন ১৪৪৮ সালে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তিনি তার পদাবলির কারণে অমরত্বের স্থান পেয়েছেন।
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন