নিউইয়র্কের অভিজাত একটি এলাকায় মিঠু ১৬ কোটি টাকা দামের বাড়ি কিনেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসার কাজে তার ঘনঘন যাতায়াত আছে। চড়েন রোলস রয়েসে। আর আমার বাংলাদেশে করোনা টেষ্ট করতে এসে হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। একজন প্রবাসীকে রীতিমত কাঁদতে হয় টেষ্ট করতে না পেরে...

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহের একটা কাজ পেয়েছিলেন এক ঠিকাদার। কাজ শেষ করে সাড়ে চার শ কোটি টাকার বিল তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আবিষ্কার হয় যে, কোন যন্ত্রপাতিই পৌঁছায়নি।

না কোন রূপকথার গল্প না। এটাই বাস্তবতা। আপনারা হয়তো অনেকেই আজকে প্রথম আলোতে প্রকাশিত স্বাস্থ্যের মধু খেয়ে মিঠু বিদেশে, নিউজটা পড়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর দেশের স্বাস্থ্যখাতটা কীভাবে লুটেপুটে খেয়েছেন ঠিকাদার মোতাজজেরুল মিঠু তার একটা চিত্র পাবেন এই প্রতিবেদনে।

হ্যা, এসব নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন হয়েছে গত এক দশকে। কিন্তু কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বরং স্বাস্থ্য মন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণাালয় থেকে শুরু করে সবকিছুই মিঠুর কথাতেই চলতো।

ভাবেন একবার একটা সরকারি কাজ পেতে কত জন কর্মকর্তার স্বাক্ষর লাগে, বিল নিতে কতোকিছু লাগে, কতো কাগজ দেখাতে হয়, সেসব উপেক্ষা করে মিঠু সাড়ে চারশ কোটি টাকা নিয়ে গেছেন এবং আমাদের পুরো রাষ্ট্রের কেউ দেখতে পায়নি। আচ্ছা আমাদের আমলাতন্ত্র কোথায় ছিলো তখন? কোথায় ছিলো দুদক?

কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ মৃত্যুর আগে লিখিতভাবে সরকারকে জানিয়েছিলেন, কেনাকাটায় অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্য খাত ‘মিঠুচক্র’–এর কবজায়। স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটা থেকে গত ১০ বছরে ঠিক কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারছেন না। কারণ, এ ব্যাপারে কখনোই কোনো তদন্ত হয়নি।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় খরচ হয় সাত–আট শ কোটি টাকা। এর বাইরেও প্রকল্পভিত্তিক কেনাকাটা হয়। আ ফ ম রুহুল হক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ওই সময়ের ১৮টি মেডিকেল কলেজে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ পান মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু। প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের আমলেও কেনাকাটায় মিঠুচক্রের একচেটিয়া প্রভাব ছিল। অবশ্য শুধু এই দুজন নন, সব স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ জনপ্রশাসন সচিবকে লেখা চিঠিতে বলেন, গত বছরের ২২ নভেম্বর পরিচালক পদে তিনি যোগ দেন। তখনই তাকে একটি কেনাকাটার তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলাম তাঁকে মৌখিকভাবে জানান, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তাঁর ছেলের রিকোয়েস্ট আছে। তালিকা ও প্রাইস লিস্ট অনুযায়ী কেনাকাটার ব্যবস্থা চূড়ান্ত করতে হবে।’

কী হয়েছে এসব অভিযোগে শুনবেন? অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় তাঁকে এখন রেলপথ মন্ত্রণালয়ে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। কী দারুণ! রেলের এক অতিরিক্ত সচিব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে ওএসডি করা হয়েছে। আর যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তাকে অতিরিক্ত সচিব করে রেলে আনা হয়েছে। এই হলো রাষ্ট্র!

শোনা যায় মিঠুচক্র তাদের পছন্দনীয় কর্মকর্তাদের বদলি করে মন্ত্রণারয়ে আনতো। এমনকি কেনাকাটার প্রক্রিয়া মনমতো না হলে অনেক সময় ক্রয়াদেশ বাতিলও করতো। প্রয়োজনে কর্মকর্তাদের বদলিও করা হতো।

আমার এতো কথা বলার কারণ কী জানেন? আমি গত এক দশক ধরে এই যন্ত্রণা বয়ে চলছি। দশ বছর আগে আমার এক সাংবাদিক সহকর্মী যিনি এখন বিসিএস অডিট ক্যাডারে আছেন তিনি এই চক্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তখুনি প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। সেদিন যদি রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতো তাহলে কিন্তু আর আজকে এতোকিছু হতো না। কিন্তু সেদিন তো ব্যবস্থা নেয়া হয়ইনি, উল্টো ওই কর্মকর্তাকে অপদস্থ করে বদলি করা হয়েছিল।

এই বুঝি সততার পুরুস্কার! এই রাষ্ট্রকে বলবো, দুর্নীতি দমন করতে হলে সবার আগে সৎ মানুষদের পাশে থাকুন। অসৎদের শায়েস্তা করুন। অথচ আমাদের দেশে হয় উল্টো। এসব কারণে সত্যিকারের সৎ কর্মকর্তারা কোনঠাসা হয়ে পড়েন।

আচ্ছা এই যে এক দশক ধরে এই লুটপাট চলছে, আমাদের দুদক কোথায় ছিলো এতোদিন? শুনে অবাক হবেন, ২০১৭ সালে দুদক তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো প্রমাণই নাকি খুঁজে পায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি নথিতে বলা হয়, দুদকের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সঙ্গে মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। ওই কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী স্ত্রী, কন্যা ও জামাতার দেখভাল করেন মোতাজজেরুল। ওই কর্মকর্তার ভাইয়ের মোতাজজেরুল ওরফে মিঠুর অফিসে নিয়মিত যাতায়াত আছে।

বলেন কার উপর আস্থা রাখবেন? আমি জানি বিদেশে বসে এসব খবর দেখে নিশ্চয়ই মিঠু হাসছেন নিশ্চয়ই। আপনারা হয়তো খবরে পড়েছেন, ২০১৬ সালে পানামা পেপারসে নাম ওঠার পর মিঠু বিনিয়োগকারী কোটায় এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। নিউইয়র্কের কাছে ব্রংসভিল নামের অভিজাত একটি এলাকায় বাড়ি কিনেছেন যে বাড়ির দাম নাকি ১৬ কোটি টাকা। আটলান্টায় ‘মোটেল সিক্স’ নামে একটি বিলাসবহুল মোটেলের তিনি অংশীদার। অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসার কাজে তার ঘনঘন যাতায়াত আছে। চড়েন রোলস রয়েসে। আর আমার বাংলাদেশে আজ করোনা টেষ্ট করতে এসে হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। একজন প্রবাসীকে রীতিমত কাঁদতে হয় টেষ্ট করতে না পেরে।

শুধু যে স্বাস্থ্যখাতটা তাই নয়, গত দশ বছরে এমন সব দুর্নীতি প্রকাশ পেয়েছে, যা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। গত ১০ বছরে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংক থেকে চলে গেছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়েছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ও ফারমার্স ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে আরও ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা।

এসব ভাবলে ভীষণ কষ্ট লাগে। বঙ্গবন্ধু নিজে কোনদিন দুর্নীতি করেননি। অথচ গত একযুগ ধরে লুটপাট চালাচ্ছে বহুজন, যাদের শাস্তি হচ্ছে না। আমি জানি না কেন এইসব লুটেরা, টাকা পাচারকারীদের বিদেশ থেকে ধরে দেশে আনা যায় না? আমি জানি না কেন এদের বিচার করা যায় না? বাঁধাটা কোথায়? এই দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এসব প্রশ্ন করলে কী অন্যায় হবে?

অনেকবার লিখেছি এসব কথা। আমি জানি না এর শেষ কোথায়? আমরা যারা এই বাংলাদেশেই শুধু থাকতে চাই, যারা একটা সুন্দর দেশের স্বপ্ন দেখি জানি না তাদের অপরাধটা কী? আমি জানি না কবে সর্বগ্রাসী এসব দুর্নীতি বন্ধ হবে। জানি না কবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে? জানি না আমার এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? শুধু এটুকুই জানি আমি আজীবন স্বপ্ন দেখে যাবো। হয়তো আমৃত্যু!

 

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা