বোমার আঘাতে দুই হাত, এক পা আর এক চোখ হারিয়েছিলেন। আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলেন হতাশায়। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন আচমকা। সাঁতার, সাইক্লিং অতিক্রম করে আজ অলিম্পিকের পথে তিনি। এই গল্পটা হার না মানা 'মোচোম্যান' এর!

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর বিখ্যাত একটা কোটেশন আছে-

If you can't fly, then run.
If you can't run, then walk.
If you can't walk, then crawl.
But whatever you do, you have to keep moving forward.

একবার বড়ভাইয়ের সাথে রিক্সায় করে বসুন্ধরা সিটির দিকে যাচ্ছিলাম। আমাদের রিক্সা স্বাভাবিক রিক্সাগুলোর তুলনায় ধীরে চলছিলো। বড়ভাই চুপচাপ, আমি বিরক্ত। রিক্সাওয়ালাকে কিছু বলতে যাবো, হুট করে চোখ গেলো প্যাডেলের দিকে। দেখলাম, লোকটির একটা পা নেই। এক পা দিয়ে প্যাডেল ঘোরানো যায় না, তাই পা-বিহীন জায়গাটিতে হাটুর সাথে একটা কাঠের টুকরো প্যাডেলের সাথে বেঁধে রেখে অনেককষ্টে রিক্সা চালাচ্ছেন। বিরক্তি হুট করে কেন যেন "শ্রদ্ধা"য় পরিণত হলো। "Never Give up" শব্দটা তো আমরা সবখানেই সেঁটে দিই, উপলব্ধি করি কয়জন? ঐদিনের ঐ রিক্সাওয়ালাকে দেখে বুঝেছিলাম, দুয়েকজন কেন যেন কখনোই হাল ছাড়েনা। বুঝলাম "Never Give up" শুধু গালভরা কথা না, কেউ কেউ এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করে।

চারপাশে মানুষের নানা সমস্যা। হতাশা, দীর্ঘশ্বাস, ধুর, আমাকে দিয়ে বোধহয় কিচ্ছু হবেনা, আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই.... ধরণের বিষাদবাক্যে চারপাশ আচ্ছন্ন। আমি এগুলো দেখি, শুনি আর বারবার অবাক হই। মানুষ আজকাল কত অল্পতেই থেমে যেতে চাচ্ছে! কত ছোট গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আটকে ফেলছে! ঐ লাইনটা তখন মাথায় চলে আসে-
You are your only limit.

আসলেই তো। আমিই তো আমার সীমা, আমার দূরত্ব, আমার লক্ষ্য। আমি থেমে গেলে, আমিই থেমে যাবো। চারপাশের এক ধুলোকণারও এদিক সেদিক হবেনা। তবু আমরা কেন যেন থেমে যাই, থেমে যেতে চাই, হুট করে সবকিছু বাদ দিয়ে সময়ের হাতে সব ছেড়ে দিতে চাই । সময় তখন আমাদের ওপরে ছড়ি ঘোরাতে থাকে, সময় আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। জীবন তখনই যন্ত্রণার হয়ে যায়।

বেশ কয়েক বছর আগে নিউজফিডে একটা ছবি দেখে কিছুক্ষণের জন্যে থমকে গিয়েছিলাম। এক ভদ্রলোক, যার দুটি পা নেই, যার জীবন আটকে গেছে দুই চাকার হুইল-চেয়ারে, সেই মানুষটিই রাস্তায় ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র বিক্রি করছেন।  সময়ের হাতে আত্মসমর্পণের কোনো চেষ্টাই যেন নেই, সময়ের ওপরেই কী সুন্দর ছড়ি ঘুরিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মানুষটি হয়তো পারতেন রাস্তার মোড়ে ভিক্ষার জন্যে হাত পাততে, বরং এটাই সহজ ছিলো ওনার জন্যে। কিন্তু, হাত না পাতার এ গল্প তো আরো সুন্দর।

যেরকমটা দেখি কলম্বিয়ার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ডামাডোলে দুই হাত, এক পা আর এক চোখ হারিয়ে ফেলা হুয়ান হোসে ফ্লোরিয়ান এর ক্ষেত্রে। ঘরের সামনে পড়ে থাকা এক প্যাকেট তুলতে গিয়ে ফ্লোরিনা বুঝতে পারেন, সেখানে রাখা বোমা। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরীও হয়ে গিয়েছে। বিকট শব্দ আর বিস্ফোরণের পর যখন তাকে উদ্ধার করা হয়, তখন তিনি কোমায়। শরীর থেকে ছিন্ন হিয়ে উড়ে গিয়েছে দুটি হাত, এক পা আর এক চোখ। পরবর্তীতে তিনি যখন কোমা থেকে ফিরলেন, তিনি নিজেকে মেরে ফেলতে চাইলেন। এ অক্ষম জীবন নিয়ে তিনি কী করবেন আর! হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। বড় ভাইকে ডেকে এটাও বললেন-

মাথায় একটা গুলি করে দাও, প্লিজ। এ জীবন আমি আর চাই না...

কিন্তু মানবজীবন খুব অদ্ভুত। ফ্লোরিয়ান মারা গেলেন না। বরং নতুন এক জীবনে তিনি  ফিরলেন। নকল দুই হাত আর এক পা নিয়ে সাঁতার শুরু করলেন। সাঁতারে ভালোও করা শুরু করলেন। এরপরই সাঁতার থেকে চলে এলেন সাইক্লিং এ। কলম্বিয়ার বিমান বাহিনীর প্রকৌশলীরা ফ্লোরিয়ান এর জন্যে বিশেষ একটা সাইকেল বানালেন। কার্বন ফাইবার আর বিশেষ প্যাড সম্বলিত এ সাইকেল ফ্লোরিয়ানের কথা ভেবেই তৈরী।

আগামী বছর টোকিওতে অনুষ্ঠিত হবে প্যারা অলিম্পিক। সেখানে অংশগ্রহণ করবেন ফ্লোরিয়ান। ইতোমধ্যেই তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। মানুষজন তাকে এখন  ভালোবেসে 'মোচোম্যান' নামে ডাকে। সবার আশা তিনি এবার অলিম্পিক থেকে বিজয়ী হয়েই ফিরবেন।

ফ্লোরিয়ানের বিজয়ী হওয়ার জন্যে সোনা জিততে হবে না। যে মুহুর্তে তিনি সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখেছেন, সে মুহুর্ত থেকেই তিনি আমাদের কাছে বিজয়ী। আসলে যত যাই বলা হোক না কেন, আমার জীবন তো আমার। সমস্যা তো আসবেই, এড়ানো যাবেনা কোনোভাবেই, হাঁটার সব রাস্তা কখনোই সোজা হয়না, আশা করাও যায় না তা। তবু জীবন থেমে থাকে না। এগিয়ে যেতে হয়-ই।

ঠিক এ কারনেই 'জীবন' অসাধারণ এক মঞ্চ। এই মঞ্চকে সর্বোচ্চভাবেই খরচ করা উচিত নিজের খুশিমত। থেমে যাওয়া, হেরে যাওয়ার কনসেপ্টগুলোকে এড়িয়ে, এসব চিন্তাভাবনাকে বাদ দিয়ে যতটুকু যাওয়া যায়, ততটুকুই ভালো। কথায় আছে- যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই আঁশ... আশাটা নিভে গেলে জীবন অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে শুরু করে তখন। সেটা আসলে কারোই কাম্য নয়।

পারস্যের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়ামের একটা লাইন দিয়ে ইতি টানা যাক-

এই মুহূর্তটির জন্যে খুশি থাকো। এই মুহূর্তটিই তোমার জীবন

অনেকগুলো মুহূর্ত নিয়েই গোটা এক জীবন। সে মুহূর্তগুলোতে হতাশা, ব্যর্থতা, গ্লানি... এই আগাছাগুলোকে যত কম আসবে, জীবন হয়তো ততই ঠিক পথে থাকবে।

এই অবেলায় সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা