সব কূটনৈতিক সমীকরণ ভুলে যাই। একবার ভাবুন, স্রেফ একবার ভাবুন, ভারতের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোদির রক্তাক্ত হাতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে দেওয়া ‘স্পিচ’ কি বঙ্গবন্ধু ডিজার্ভ করেন?

ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল মানুষটার জীবনের খুঁটি। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আমূল বদলে দলটার নাম আওয়ামী লীগ হয়েছিল তারই কারণে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে চারটি মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ভিত্তি ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার এই চার নীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি কতটা আঁকড়ে রাখতেন, সেটি বাহাত্তরে দেওয়া তার এই বক্তব্যেই বোঝা যায়, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খৃস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধ তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের ব্যবসা চলবে না, ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না।’

সেই মানুষটা বেঁচে নেই স্বজাতির এক দল নরাধমের নির্মম বিশ্বাসঘাতকতায়। বহু ক্রান্তিকাল পেরিয়ে তার দল ক্ষমতায় এসেছে তার কন্যার নেতৃত্বেই। আজ সেই মানুষটার শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যখন দেশজুড়ে মুজিববর্ষ উদযাপিত হতে যাচ্ছে, প্রবল আক্ষেপ নিয়ে বলে যাই, সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি নরেন্দ্র মোদি, যার হাতে দাঙ্গায় নিহত হাজারো মানুষের রক্ত লেগে থাকার অভিযোগ আছে।

মোদির মতো সাম্প্রদায়িক একজন লোক মুজিববর্ষের কী-নোট স্পিকার হবেন, এই সিদ্ধান্ত প্রথম থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনায় মোদির মদদ, বিজেপির ভূমিকা এবং মোদির নির্লিপ্ততা এই সিদ্ধান্তের সব ধরণের সমীকরণকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। ওবায়দুল কাদের আজ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিনিধিত্বকে আমরা বাদ দেব এটাতো চিন্তাও করা যায় না।’

মোদি না থাকলেই ভারতের প্রতিনিধিত্ব বাদ যাবে কেন, সেটাই বোধগম্য নয়। মনে রাখতে হবে, মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে বছরজুড়ে। এজন্য একসঙ্গে সকল বিদেশি অতিথিকে আমন্ত্রণও জানানো হচ্ছে না। যেমন, মোদির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসার কথা থাকলেও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী আসবেন ২২ মার্চ জাতীয় সংসদের এক বিশেষ অধিবেশনে। সোনিয়া গান্ধী আসবেন ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানে। কাজেই বছরজুড়ে চলা অনুষ্ঠানসূচিতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব থাকছেই। মুজিববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বাভাবিকভাবেই ভারতের প্রতিনিধিত্ব থাকা অত্যাবশ্যক, ভারতের অসামান্য সহযোগিতার কারণেই আমাদের স্বাধীনতার পথ ত্বরান্বিত হয়েছিল। সেজন্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সামরিক ও বেসামরিকভাবে সহযোগিতা করা ভারতের অসংখ্য গুণী মানুষকেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আনার তো সুযোগ আছেই। তাহলে?

নরেন্দ্র মোদিকে এনে বঙ্গবন্ধুকে অপমান করাটা কি খুব জরুরী?

ভারতবর্ষের দাঙ্গার অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুর ছিল। ধর্মের নামে হানাহানির ঘটনা দেখেছেন তিনি। পাকিস্তানি শাসনামলে ধর্মকে সামনে রেখেই পাকিস্তানিরা বাঙালিকে শাসন ও শোষণ করেছে। তাই সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করলেও বঙ্গবন্ধু ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করতেন। বঙ্গবন্ধু একটা অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে বাংলাদেশে সংখ্যায় কম হওয়ার কারণে কোন ধর্মের মানুষকে নির্যাতিত হতে হবে না। সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্যে সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি জেল খেটেছেন, শত অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশের নামের আগে 'ইসলামিক রিপাবলিক অফ' লাগানোর কথা বলেছিলেন সৌদি বাদশাহ, বঙ্গবন্ধু তখন মুখের ওপর না বলে দিয়েছিলেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হবে এই সাম্প্রদায়িক নরকীটের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। কী নিদারুণ অপমান বঙ্গবন্ধুর প্রতি! 

ওবায়দুল কাদের আরও বলেছেন, ‘মুজিব বর্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোর মূল কারণ তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছে। আমাদের রক্তের সঙ্গে ভারতের রক্ত মিশে আছে। কাজেই ভারতকে এই মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানানো অকৃতজ্ঞতার পরিচয়।’ তার মানে মোদিই কি ভারতের প্রতিবিম্ব? প্রেমকান্ত বাঘেল, ছয়জন মুসলমানকে বাঁচিয়ে নিজে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন যেই মানুষটা, তিনিই কি সত্যিকারের সেক্যুলার ভারতের প্রতিবিম্ব নন? যখন তার দেশের রাজধানীতে আগুন জ্বলছে, হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে দিল্লি- আর মোদি কিনা তিনদিন পর একটা টুইট করেই নিজের দায়িত্ব খালাস করেছেন! সেই মোদির প্রতি আমাদের এমন ঔদার্য!

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা অনুধাবন করতে পারি এত বড় অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দাওয়াত না দেওয়াটা ঠিক কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ভেতর পড়ে না। পাশাপাশি এতে দুটি দেশের বিদ্যমান ঐতিহাসিক সম্পর্কও ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনায় পড়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারকে এখনই ভাবতে হবে যে মোদির এই অনুষ্ঠানে আসা স্রেফ এখন আর ‘বঙ্গবন্ধুর লিগ্যাসির জন্য অপমান’ হিসেবে বিবেচিত থাকছে না। মোদির আসাকে কেন্দ্র করে খোদ বাংলাদেশেও বাজে রকমের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগার পেছনে উস্কানি দিতে পারে। নগর পুড়লে কি দেবালয় এড়ায়? না। ভারত পুড়লে, এভাবে ক্রমাগত পুড়তে থাকলে বাংলাদেশও রক্ষা পাবে না, নিশ্চিত।

সব কূটনৈতিক সমীকরণ ভুলে যাই। একবার ভাবুন, স্রেফ একবার ভাবুন, ভারতের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোদির রক্তাক্ত হাতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে দেওয়া ‘স্পিচ’ কি বঙ্গবন্ধু ডিজার্ভ করেন? যে লোক নিজের দেশকে ধর্মের নামে ভাগ করে ক্ষমতায় থাকতে চায়- তার মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম শুনতেও লজ্জা লাগবে আমাদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার লাগবে না?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা