নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী বিরোধী দলীয় নেত্রী কিংবা নারী স্পিকারের এই দেশে দিনশেষে লম্পট নূরে আলমদের জয় হয়, মঞ্জুরা হেরে যান, নৈতিকতা হেরে যায়, হেরে যায় বাংলাদেশ।

বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগদান করার সময় ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তা মঞ্জু মনোয়ারার দুচোখে নিশ্চয়ই হাজারো স্বপ্নের মেঘ খেলা করছিল। কিন্ত সেই স্বপ্নগুলো যে কয়েক বছরের ব্যবধানে এমন দুঃস্বপ্নে রূপ নেবে, সেটা তিনি জানতেন না। 

উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার অনৈতিক প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় দিনের পর দিন যৌন হেনস্থা ও মানসিক নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে, তিনি যখন গর্ভবতী ছিলেন, তখনও তার ওপর নির্যাতন চলেছে। বিচার চাওয়ায় হাজারটা ভোগান্তি সইতে হয়েছে, গতকাল তো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অফিসিয়ালি বরখাস্তই করা হলো তাকে। অথচ নিপীড়ক কিন্ত বহাল তবিয়তে আছেন, পদোন্নতি দিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছে জাতিসংঘে। নূরে আলম নামের সেই যৌন নিপীড়ককে বাঁচাতে উঠেপড়ে লেগেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।

ঘটনার শুরু ২০১২ সালে। সেবছর প্রথম সচিব হিসেবে জাপানের বাংলাদেশ দূতাবাসে বদলি করা হয় মঞ্জু মনোয়ারাকে। পরের বছর কাউন্সিলর হিসেবে সেখানে বদলি হয়ে আসেন পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা নূরে আলম। সেখানে যোগ দেয়ার পরেই মঞ্জু মনোয়ারের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তার। মঞ্জু বিবাহিত জানার পরেও তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরির জন্যে চাপ দিতে থাকেন। মঞ্জু মনোয়ারা সেই প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন।

অফিসের ভেতরেই অন্যান্য সহকর্মীদের সামনে মঞ্জুকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করতেন নূরে আলম, অকথ্য গালাগালি আর মারধরের হুমকিও থাকতো। এসব একদিন-দুদিন হয়নি, দিনের পর দিন এগুলো চলেছে। মঞ্জু মনোয়ারা তখন গর্ভবতী, তাতেও তার ওপর এসব অত্যাচার চালানো বন্ধ করেনি নূরে আলম। উপায়ন্তর না দেখে নূরে আলমের নামে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন মঞ্জু।

মঞ্জু মনোয়ারা

তাতে হিতে বিপরীত হয়, মঞ্জুকেই বদলি করা হয় ভারতের মুম্বাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে। নূরে আলমের হাত অনেক লম্বা, মুম্বাইতেও তার সহযোগীরা মঞ্জুর ওপর মানসিক নির্যাতন চালায়। দিনের পর দিন এই অন্যায় সহ্য করতে না পেরে আবারও মন্ত্রণালয়ে ধর্ণা দেন মঞ্জু মনোয়ারা, পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত জানিয়ে প্রতিকার দাবী করেন। এটা ২০১৫ সালের ঘটনা। 

এবার শুরু হয় অন্য কায়দায় তাকে হেনস্থা করা। মঞ্জু মনোয়ারাকে 'পাগল' ও মানসিক বিকারগ্রস্থ' আখ্যা দিয়ে তার করা অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেয় অভিযুক্তরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে মঞ্জু মনোয়ারার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। মেডিকেল বোর্ড রায় দেন, মঞ্জু শারীরিক এবং মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। 

কিন্ত ডাক্তারদের সেই রিপোর্টকে আমলে না নিয়েই তথাকথিত 'তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে' মঞ্জুকে চাকুরি থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মন্ত্রণালয়।সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে রিট দায়ের করেছিলেন মঞ্জু মনোয়ারা। তার রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই রিপোর্ট চাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায় মঞ্জু মনোয়ারাকে বরখাস্ত করেছে মন্ত্রণালয়। মজার বিষয় হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে যৌন হয়রানির কোন উল্লেখই নেই, উল্টো মঞ্জু মনোয়ারার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে অসদাচারণ, স্বেচ্ছাচারিতা, সরকারি চাকরির শিষ্টাচার বহির্ভূত কর্মকাণ্ড, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি উদ্ধত আচরণ এবং দুর্ব্যবহারের!

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতনবিরোধী একটি সেলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মঞ্জু মনোয়ারার সঙ্গে কথা বলে এই ঘটনার তদন্ত কাজে সহায়তা করার জন্যে। সেই কমিটির সদস্যরাও মঞ্জুর কথাবার্তা বা আচরণে অসংলগ্ন কোনকিছু খুঁজে পাননি। সেই কমিটির তদন্তকাজ যখন প্রায় শেষ, তখনই কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন একটি কমিটির হাতে তদন্তের কাজ দেয়া হয়। সেই পুতুল কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই মঞ্জুকে চাকুরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। 

ক্রমাগত মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল মঞ্জু মনোয়ারাকে

যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই নূরে আলমকে কিন্ত মন্ত্রণালয় পুরস্কৃতই করেছে। তাকে পদোন্নতি দিয়ে জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনে 'মিনিস্টার' পদমর্যাদায় দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নারী নির্যাতন আর যৌন হয়রানির এত বড় পুরস্কার পাওয়া যায় জানলে বাংলাদেশের সব ইভ টিজার আর ধর্ষক যে দারুণভাবে উৎসাহিত হবে, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

পুরো ঘটনাটা জানার পরে দেশটাকে মগের মুল্লুক ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না আপনার কাছে। একজন নারীর বিরুদ্ধে সরকারের একটা মন্ত্রণালয়, ক্ষমতাশালী কিছু আমলা যেন উঠেপড়ে লেগেছে। এই লোকগুলো একেকজন বিসিএস ক্যাডার, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম। বিসিএস পরীক্ষার্থীদের স্বপ্ন থাকে ফরেন ক্যাডারে একটা আসন পাওয়া, সেই জায়গায় বসে একদল অমানুষ একজন নারীর প্রতি চরম অবিচার চালিয়ে যাচ্ছেন গত কয়েকটা বছর ধরে। 

যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছিলেন মঞ্জু মনোয়ারা, তার হয়তো উচিত ছিল নূরে আলমের অনৈতিক প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাওয়া। তিনি নারী হয়ে জন্মেছেন, যতোই নিজের যোগ্যতায় ফরেন ক্যাডারে স্থান করে নিন, দিনশেষে তো তিনি নারী, নূরে আলমের মতো বিকৃতমনস্ক পুরুষের লোলুপ দৃষ্টির সামনে মঞ্জু মনোয়ারা ভোগ্যপণ্য ছাড়া আর কিছুই নন। নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী বিরোধী দলীয় নেত্রী কিংবা নারী স্পিকারের এই দেশে দিনশেষে লম্পট নূরে আলমদের জয় হয়, মঞ্জুরা হেরে যান, নৈতিকতা হেরে যায়, হেরে যায় বাংলাদেশ।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা