চুলে রঙ করা বন্ধ হলেই কি দেশের যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
রাস্তা আটকে মানুষের ভোগান্তির কারণ হওয়াটা অপরাধ, কেউ রাস্তা ছাড়তে বললে তাকে দল বেঁধে পেটানোটা অপরাধ, চুলে রঙ করা বা টিকটকে ভিডিও আপলোড করাটা অপরাধ নয়। কিন্ত মরাল পুলিশিং করে লম্বা চুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা লোকগুলোকে এসব কে বোঝাবে?
গতকাল থেকে নিউজফিডে একটা ভিডিও ঘোরাফেরা করছে, পুলিশের পোষাক পরিহিত জনৈক কর্মকর্তা একটা সেলুনে গিয়ে এক তরুণকে তার চুলের ব্যাপারে কৈফিয়ত তলব করছেন, কেন সে এই স্টাইলে চুল কেটেছে, কেন চুলে রঙ করিয়েছে- এসব হচ্ছে তার প্রশ্নের ধরণ। মোবাইলের ক্যামেরা ওপেন করে ফেসবুক লাইভে এসে কোন নাগরিকের কাছে এই কৈফিয়ত চাওয়ার অধিকার ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে কে দিয়েছে, সেটা আমার জানা নেই। তবে তিনি যে নিজের পোষাক এবং পদবির প্রভাব খাটিয়ে অন্যায়ভাবে সেই তরুণকে 'নৈতিক শিক্ষা' দিতে চাইছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ভিডিওর ক্যাপশনে পুলিশ কর্মকর্তাকে ফরিদপুরের 'ভাঙ্গা' থানার সাব-ইন্সপেক্টর 'আজাদ স্যার' হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। কোন মানুষ কি পোষাক পরবে, কিভাবে চুল কাটবে, চুলে কি রঙ করবে, সেসব তার একান্ত ব্যক্তিগত অধিকার। এই ব্যাপারগুলোতে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারো নেই, পুলিশেরও নেই। সেটা এই আজাদ স্যারকে কে বোঝাবে? পুলিশের দায়িত্ব বাদ দিয়ে তিনি তো মরাল পুলিশিংয়ের কাজ করছেন, নৈতিক শিক্ষা দেয়ার মিশনে নেমেছেন।
টিকটক সেলিব্রেটি অপু-মামুনদের দেখাদেখি অনেক তরুণের মাঝে এখন চুলে অদ্ভুত রকমের রঙ করা বাহারি স্টাইলে কিংবা কাটিং দেয়াটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এরকম কাউকে রাস্তাঘাটে দেখলে আমার নিজের কাছেও উদ্ভট লাগে, তাকে এলিয়েন বলে মনে হয়, কিন্ত যতক্ষণ না সেই তরুণ আইন পরিপন্থী কোন কাজ করছে, ততক্ষণ তাকে ঘৃণা করার, কিংবা যেচে পড়ে তাকে উপদেশ দেয়ার কোন কারণ আমি খুঁজে পাই না।
অনেকেই বলবেন, এসব ছেলে-মেয়েদের কারণে সমাজ উচ্ছন্নে যাচ্ছে। এই সমাজ ঘুষখোরদের কারণে উচ্ছন্নে যায় না, দুর্নীতিবাজদের কারণে উচ্ছন্নে যায় না, দাঙ্গানাজ ধর্মান্ধদের নিয়েও এই সমাজ বহাল তবিয়তে টিকে আছে, ধর্ষকেরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে, তাতেও সমাজের কিচ্ছু হচ্ছে না, কেবল কিছু ছেলে-মেয়ে রঙ-বেরঙয়ের চুল নিয়ে ঘুরে বেড়ালে সেটাই অপরাধ? তাতেই সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে, উচ্ছন্নে চলে যাবে? এজন্যেই কি 'চলো যাই যুদ্ধে, লম্বা চুলের বিরুদ্ধে' টাইপের মিশনে নামা?
স্পষ্ট করেই বলে রাখি, টিকটকার অপুকে উত্তরা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল কয়েক তরুণের ওপর হামলার অভিযোগে, চুল রঙ করার কারণে নয়। সিম্পল একটা জিনিস অনেকেই বোঝার চেষ্টা করে না, রাস্তা আটকে মানুষের ভোগান্তির কারণ হওয়াটা অপরাধ, কেউ রাস্তা ছাড়তে বললে তাকে দল বেঁধে পেটানোটা অপরাধ, চুলে রঙ করা বা টিকটকে ভিডিও আপলোড করাটা অপরাধ নয়।
তবে এদেশের হুজুগে মানুষজনের এত কিছু ভাবার সময় কোথায়? মরাল পুলিশিংয়ে তো আমরা জন্মলগ্ন থেকেই ওস্তাদ। তাই আমাদের এমপিরা পার্কে ঘুরে ঘুরে স্কুল পালিয়ে প্রেম করতে আসা ছেলে-মেয়েদের ধরেন, ভ্রাম্যমান আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিনোদন কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে তরুণ-তরুণীদের আটক করে বাবা-মাকে খবর দেন, পুলিশ কর্মমর্তা চোর-ডাকাত বা ধর্ষক-ইভটিজারদের বাদ দিয়ে সেলুনে ঘুরে ঘুরে কে চুলে রঙ করছে, কে কোন স্টাইলে চুল কাটছে সেসবের খোঁজ নিয়ে বেড়ান!
আমাদের দেশে সিংহভাগ মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে একঅটা ছেলে তার খুশি অনুযায়ী চুলে রঙ করলে সমস্যাটা কোথায়- জবাব পাবেন, চুলে রঙ তো করে বখাটে ছেলেরা! চুলে রঙ করাটা যদি বখাটেপনার চিহ্ন হয়, তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক মানুষ যে দাড়ি-টুপিওয়ালা মুসলমান দেখলেই জঙ্গি ভাবে, তাদের ভাবনাকেও আপনি ভুল বলতে পারবেন না, কারণ শতকরা পঁচানব্বই ভাগ জঙ্গির মুখেই দাড়ি আছে, তারা আল্লাহ'র নাম নিয়েই মানুষ মারে। কিন্ত মুসলমান মানেই যেমন জঙ্গি নয়, কেউ লম্বা চুল রাখলে বা চুলে রঙ করলেই তাকে বখাটে ট্যাগ দেয়ার কোন মানে নেই।
দেশে অজস্র সমস্যা আছে। প্রতিদিন আইন ভাঙার শত শত ঘটনা ঘটছে। গতকালই কক্সবাজারে মা-মেয়েকে গরু চুরির অপবাদ দিয়ে বেঁধে পেটানো হয়েছে, সেই প্রহারে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। সরকারী প্রকল্পে একটা ময়লার ঝুড়ির দাম ধরা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সামাজিক দূরত্ব না।মেনে বাসভর্তি যাত্রী তুলেও আদায় করা হচ্ছে দ্বিগুণ ভাড়া। এসবের কোন সুরাহা না করে কে চুলে রঙ করলো, কে লম্বা চুল রাখলো- এসবের পেছনে পড়ে থাকাটা আমাদের মানসিক শক্তির অপ্রতুলতাটাই প্রমাণ করে। কাজের চেয়ে অকাজে যে আমরা ভীষণ পারদর্শী, সেটার প্রমাণ রোজ রোজ না দিলেও তো চলে, তাই না?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন