মোরাল পুলিশিং জিনিসটা সৌদি আরবে আছে। আপনি মাহরাম ছাড়া কেন বের হয়েছে, কেন শপিং এ গিয়েছেন, কেন লিপস্টিক দিয়েছেন- ইচ্ছে মতো জেরা করবে, এদেরকে বলা হয় মুতাওয়া পুলিশ। ভুলে যাবেন না, এটা বাংলাদেশ, এখানে এই মামদোবাজি চলবে না...
গতকাল একটা ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়েছিলো, দেখেছেন কি? ঐ যে একটা মেয়ে তার বন্ধুর সাথে সিগারেট ফুঁকছে আর বীর বাঙালী অস্ত্র ফেলে হা রে রে রে করে তেড়ে এসেছে মেয়েটাকে উচিত শিক্ষা দিতে, ঐ ভিডিওটা। ঘটনা হচ্ছে, এই যে মোরাল পুলিসিং এই জিনিসটা সৌদী আরবে আছে। আপনি মাহরাম ছাড়া কেনো বের হয়েছে, শপিং এ গিয়েছেন, লিপস্টিক দিয়েছেন কেনো এই সেই ইচ্ছে মতো জেরা করবে, এদেরকে বলা হয় মুতাওয়া পুলিশ। এরা আজানের পরে নামাজের ওয়াক্তে রাস্তায় রাস্তায়, শপিং মলে, বাজারে ঘুরে বেড়ায় যে কে কে নামাজে যায়নি দেখার জন্য। বাংলাদেশে কি এটা আপনি দেখেছেন? দেখেন নি? মনে করার চেষ্টা করে দেখুন, মনে না আসলে আপনার বান্ধবী বা বোনকে এই প্রশ্ন গুলো করুন তো, দেখুন তো কি বলে-
১) তোকে কি রাস্তাঘাটে ওড়না না থাকলে বা এক পাশে করে রাখলে কোন আন্টি এসে ঝাড়িপট্টি, নিদেনপক্ষে কানে কানে বলে গিয়েছে? কোন মধ্যবয়স্ক বা বয়স্ক পুরুষ হেঁটে যেতে যেতে শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে নাউজুবিল্লাহ পড়েছে?
২) ব্রেসিয়ার এর স্ট্র্যাপ দেখা গেলে কি আশেপাশের অপরিচিত আন্টিরা আকাশ পাতাল এক করে চেচামেচি করেছে?
৩) সন্ধ্যাবেলায় কোন বান্ধবীর বাসায় বান্ধবীর মা বলেছে যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখনও বাড়ি যাওনি কেনো, সন্ধ্যার পরে ভালো ঘরের মেয়েরা বাইরে থাকে না?
৪) বন্ধু বান্ধবীদের সাথে ট্যুরে যেতে চাইলে, ছেলে বন্ধু আছে, গেলেই বাচ্চা হয়ে যাবে ভেবে যেতে না দেয়া, হয়েছে এরকম?
এরকম বলতে শুরু করলে কোনদিন শেষ হবে না। তো, এই যে মোরাল পুলিশিং এইটা আমরা অনেকদিন ধরেই হতে দিচ্ছি। আজকে নতুন না। আজকে যেটা হয়েছে, সেটা আগের চেয়ে আরেকটু এগ্রেসিভ, এই যা পার্থক্য। এবার একটু ভয় দেখিয়ে দেই। এই যে একটু এগ্রেসিভ বললাম, সামনে যতোদিন যাবে, এই এগ্রেশন বাড়বে, কমবে না। আজকে মেয়ে বিড়ি খেয়েছে বলে পারে না ওখানেই খুন করে ফেলে। একজন প্রতিবাদও করেনি, শুধু পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা করতে চেয়েছিলো, উৎসুক জনতা তাকে পারলে ওখানেই মাটিতে গেড়ে দেয় এমন অবস্থা। কালকে কিন্তু গায়েও হাত তুলবে।
আপনারা যে মনে করেন, “ভাস্কর্য নিয়া যা মন চায় হোক, আমার কী! আমি কি ভাস্কর্য বানাই নাকি ঠিকাদারির কাজ নেই? আমার কি যায় আসে!” আপনি বা আপনারা এইটা বুঝেন না যে এই সব কিছু নিতম্ব এক জায়গায়। সেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা, রাজাকারী, গণহত্যা, গণধর্ষণ থেকে শুরু করে আজকের নারী নীতির বিরোধীতা, নারী শিক্ষার বিরোধীতা, নারীর বাইরে কাজ করবার বিরোধীতা, নারীর সম অধিকার, সমান সম্পত্তি বন্টন সব কিছুর বিরোধীতা, হাল এর ভাস্কর্যের বিরোধীতা- এসব কিছুর পেছনের মানুষগুলো কিন্তু এক। আজকে ভাস্কর্য বানাতে দিবে না, কালকে সহ শিক্ষা বন্ধ, পরশু দিবস পালন বন্ধ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শোক দিবস পালন সব বন্ধ, তরশু নারীর বাইরে কাজ করাই বন্ধ, তার পরদিন ঘর থেকে বের হওয়াই বন্ধ, তার পরদিন ঘরে আসবে চার বৌ, তারপরে আসবে দাসী, এভাবে চলতেই থাকবে।
এরা একটাবার চিন্তা করে না, এই দেশের অর্থনীতিতে এদের একটা ফুটো পয়সার কোন অবদান তো নেই-ই, উলটো ওয়াজের নামে যে লক্ষ কোটি টাকা কামাচ্ছে, এ টাকার কোন ট্যাক্সও দেয় না, কারণ ওয়াজ করে টাকা কামানোর যেখানে নিয়মই নাই, সেখানে ট্যাক্স এর খাত আসবে কোত্থেকে? অপরদিকে দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে যে গার্মেন্টস শিল্পের উপর ভর করে, সেই গার্মেন্টস শিল্প এর জীবন চালিকা হচ্ছে আমাদের মেয়েরা। অর্থাৎ এই দেশের মেয়েদের ঘামের পয়সায় এই খয়রাতি বাহিনীর রুটি আসে ঘরে, আর এই গোষ্ঠীই কিনা বলে গার্মেন্টস এর মেয়েরা সব জিনাকারী। জিনা শব্দের অর্থ না জানলে, জেনে রাখেন এর অর্থ হচ্ছে ব্যাভিচার।
আপনারা ভাবতেই পারেন, নিশম ভাই, আপনি আসলে মোল্লাবিদ্বেষী, তাই একটু বাঁড়ায় চাড়ায় বলেন, তাহলে প্রমান দেই। পুরো লেখার লিংকটা কমেন্ট বক্সে দিয়ে দিবো, শুধু সারাংশ টুকু এখানে লেখি।
“২০১৭ সালের ইসলামী ব্যাংকের একটি ডায়েরী থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, একদম ম্যানেজার পোস্ট থেকে শুরু করে এমডি পর্যন্ত মোট ৫৯৬টি পোস্টের মধ্যে নারীর অংশগ্রহন ১.০০৭% এবং নন মুসলিমদের অংশগ্রহন ০.০০%”।
এই যে চিত্র, এগুলোর পিছের কারিগরগুলো কিন্তু কাঠমোল্লা নয়, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া, জামাত-শিবির এগুলো। এবার চিন্তা করুন তো, এই মামুনুল হক, চরমোনাই, হেফাজতিদের মতো কাঠমোল্লাগুলো ক্ষমতায় আসলে কি হতে পারে? আমি বলি কি হতে পারে, আপনার সন্দেহ থাকলে আপনার নিকটবর্তী মসজিদের ইমাম এর থেকে ভেরিফাই করে নিতে পারেন। আপনাকে যদি ধর্ষণ করা হয়, আপনার চারজন সত্যবাদী পুরুষ সাক্ষী লাগবে। সাক্ষী যোগাড়ে আপনি যদি ব্যর্থ হন তবে আমি যিনাকারী হবেন এবং মিথ্যাবাদী হিসেবে শাস্তি পাবেন। আবারও বলছি, আমার কথা ভুল মনে হলে নিজে একবার সুরা আন-নূর এর আয়াত ১৩- এর অর্থ পড়বেন। এরপর পছন্দের ইমাম এর থেকে শুনে নিবেন। জাকির নায়েক মার্কা কারও কাছে গেলে অবশ্য এমন যুক্তি দিবে তখন মনে হবে, আরে এটাই তো ঠিক! ঠিক যেভাবে তিনি মৌলবাদী, জঙ্গী অর্থ চেঞ্জ করে তাদের সমর্থন করেছিলেন এবং বলেছিলেন প্রত্যেক মুসলিমেরই মৌলবাদী, জঙ্গী হওয়া উচিত।
এবার একদম উপরের পয়েন্টে চলে আসি। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, নিশম ভাই, একটা খোলা জায়গায় সবার সামনে মেয়েটা যে এভাবে সিগারেট খাচ্ছে এইটা কি ভালো কাজ? অবশ্যই এইটা খারাপ কাজ! কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু আপনি তাকে ভিডিও করা, গালিগালাজ করবার অধিকার রাখেন না। আপনি আইন প্রয়োগকারীর সংস্থার সাহায্য নিবেন, ওপেন স্পেস এ ধুমপান এর শাস্তির জন্য যে আইন সে আইন অনুযায়ী তার জরিমানা হবে, আপনি এইটা করতে পারেন। কিন্তু পাবলিকলি তাকে হেনস্থা করতে পারেন না।
আমি ঐ মেয়ের জায়গায় হলে আপনাকে আইসিটি আইন, মানহানীর মামলা সহ আরও কি কি যে করতাম, সেটা ভাবলেও আপনার পিছনের নরম জায়গাটা লাল হয়ে যাবে। ধুমপান একটা খারাপ অভ্যাস। নিজের জন্য তো অবশ্যই, আশেপাশের মানুষের জন্য। আপনি নারী পুরুষ নির্বিশেষে সতর্ক করতে পারেন, কিন্তু ‘একটা মেয়ে সিগারেট খাইতাসে’- এই ব্যাপারটাকে উপজীব্য করে তাকে নিয়ে নোংরামো করতে পারেন না, কোন ভাবেই না।
আপনাকে মনে রাখতে হবে দুইটা জিনিস, এক- সে আপনার বা আপনার বাপের টাকায় খায়ও না, পরেও না। দুই, এইটা সৌদী আরব না, এইটা বাংলাদেশ। এইটা একটা ধর্মান্ধ জাতির সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া দেশ। আর পরাজিত শক্তির এই রেখে যাওয়া বাচ্চাকাচ্চাদের আমরা যুগে যুগে পরাজিত করছি, সামনেও করবো। স্টাম্প পেপার আনবেন, লিখে দেবো। পারলে ঠেকিয়ে দেখান।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন