বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হানা দেওয়া দলটির সামনের সারিতে ছিলেন মোসলেউদ্দিন। অনেকের দাবি, মোসলেউদ্দিন নিজে গুলি করে হত্যা করেছিলেন বঙ্গন্ধুকে।
এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস ছাপিয়ে দেশের সবচেয়ে আলোচিত খবর সম্ভবত বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার খুনী রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের গ্রেফতারের সংবাদটি। বেশ কয়েকবার শোনা গিয়েছিল, দণ্ডপ্রাপ্ত এই আসামী ভারতীয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, তাকে কলকাতা থেজে গ্রেফতার করেছে ভারতীয় পুলিশ। খবরে আরও বলা হয়েছে, ভারতীয় গোয়েন্দারা এই খুনিকে সীমান্তের কোনো একটি অরক্ষিত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তবে সরকারিভাবে এখনও কিছু জানানো হয়নি এই বিষয়ে।
বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি আবদুল মাজেদকে গত ৭ এপ্রিল মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মাজেদ রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে রিকশায় করে সন্দেহজনকভাবে যাচ্ছিলেন। লকডাউনে মধ্যে বাইরে বের হওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন তার কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হয় পুলিশ সদস্যদের কাছে।
পুলিশের দাবী, জিজ্ঞাসাবাদের মুখে মাজেদ নিজের পরিচয়ের কথা স্বীকার করে। তবে ভারতীয় গণমাধ্যমের ধারণা, সে দেশের গোয়েন্দারাই তাকে আটক করে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়। গত ১২ এপ্রিল শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মাজেদ গত ২২-২৩ বছর ধরে ভারতে অবস্থান করছিল। এই খুনির কাছে সেদেশের পাসপোর্টও ছিল।
আনন্দবাজার বলছে, মাজেদের কাছ থেকেই মোসলেহ উদ্দিনের তথ্য বের করেছিলেন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই তথ্য জানানো হয় ভারতকে। গোয়েন্দাদের সহযোগিতায় রিসেলদার (বরখাস্ত) মোসলেউদ্দিনকে উত্তর চব্বিশ পরগনায় একটি গ্রাম থেকে আটক করা হয়। আবার অন্য একটি সূত্রের খবর, মাজেদ আটক হওয়া মাত্রই নিজের মৃত্যু-সংবাদ ছড়িয়ে গা-ঢাকা দেয় মোসলেউদ্দিন।
ভারতের গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের অবশ্য দাবি, লকডাউনের সময় ভারত থেকে মোসলেউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ায় সমস্যা হতে পারে বলে ঢাকা বিষয়টি ভারতের গোয়েন্দাদের জানায়। ভারতীয় গোয়েন্দারা এই খুনিকে কার্যত তাড়িয়ে সীমান্তের কোনও একটি অরক্ষিত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেয়। প্রথম আলোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতের গোয়েন্দা সূত্রের খবর, উত্তর ২৪ পরগনার একটি আধাশহরে ইউনানি চিকিৎসক সেজে ভাড়া থাকছিলেন মোসলেউদ্দিন। সেখান থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে। এই আসামীর নামেও ফাঁসির সমন ঝুলছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হানা দেওয়া দলটির সামনের সারিতে ছিলেন মোসলেউদ্দিন। অনেকের দাবি, মোসলেউদ্দিন নিজে গুলি করে হত্যা করেছিলেন বঙ্গন্ধুকে। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর সংঘটিত জেলহত্যায়ও নেতৃত্ব দিয়েছিল এই রিসালদার মোসলেউদ্দিন। জেলখানায় যাওয়া সৈনিকদের দলের নেতা ছিল সে, জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও সব কথাবার্তা এই খুনিই বলেছে।
সেই রাতে তাজউদ্দিন আহমেদ-নজরুল ইসলামদের ওপরে ব্রাশফায়ার করেছিল মোসলেউদ্দিন। আহত তাজউদ্দিন আহমেদ যখন আহত অবস্থায় 'পানি! পানি!' বলে আর্তনাদ করছিলেন, তখন ফিরে এসে তার ওপরে বেয়নেট চার্জ করেছিল এই পিশাচটা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এই হত্যা মামলার তদন্ত শুরু করলে মোসলেউদ্দিন দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তার পরিবারের সদস্যরাও তখন বিভিন্ন স্থানে গা ঢাকা দেয়। সরকারী আদেশে মোসলেউদ্দিনের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
জাতির পিতা এবং জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে, এখনও সব খুনিকে গ্রেফতার করা যায়নি, শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি সবার। মাজেদকে সাজা দেয়া হয়েছে কিছুদিন আগে, মোসলেউদ্দিন যদি সত্যিই গ্রেফতার হয়ে থাকে, তার শাস্তিও সে পেয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই। বর্বর আর নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞের রক্ত লেগে আছে যেসব খুনীর হাতে, তাদের সবার শাস্তি নিশ্চিতের পথে ধীরে ধীরে হলেও এগিয়ে যাচ্ছি আমরা, এটাই আপাতত স্বান্তনার বিষয়...