মুনাইবা মাজারি: দ্য আয়রন লেডি অফ পাকিস্তান
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
জীবন তাকে চমকে দিয়েছিল এক দুপুরে, তিনি হার মানেননি, তিনিও জীবনকে চমকে দেয়ার মিশনে নেমেছেন। প্রতিটা মূহুর্তে ছাপিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে, অনুপ্রাণিত করছেন বিশ্বের লাখো নারীকে, কোটি মানুষকে।
২০০৭ সালের কথা, বেলুচিস্তান থেকে আমার নিজের শহরে যাবার পথে ভয়াবহ একটা কার এক্সিডেন্টের শিকার হই আমি। আমার শরীরের অনেকগুলো জায়গায় বিশ্রী রকমের চোট লেগেছিল। ঘাবড়াবেন না, সবে তো মাত্র শুরু হলো। ডান হাতের রেডিয়াস আলনায় চিড় ধরলো, কবজি ভাঙলো, শোল্ডার বোন আর কলার বোন ভেঙে গেল। ফুসফুস আর লিভার ভয়াবহ রকমের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, পাঁজরের হাড় ভাঙলো কয়েকটা।
কিন্ত যে আঘাতটা আমাকে পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছিল, সেটা হচ্ছে, আমার মেরুদণ্ড প্রায় দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল এই দুর্ঘটনায়। অনেক যুদ্ধ করে আমাকে গাড়ির ভেতর থেকে বের করা হয়েছিল। এরপরে আরেকটা বিপদ, অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিল না। খানিকটা সময় রাস্তার পাশেই শুইয়ে রাখা হয়েছিল আমাকে, আমি তখন পুরোপুরি অচেতন। কিছুক্ষণ পরে একটা জীপের মেঝেতে শুইয়ে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই জীপেই আমার সংজ্ঞা ফিরে এসেছিল, আমি হাত পা কিছুই নাড়াতে পারছিলাম না, শুধু মনে হচ্ছিল, সারা জীবনের জন্যে বুঝি আমি পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে গেছি!
আমাকে কাছাকাছি একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো, তারা আমার শারিরীক অবস্থা দেখেই আমাকে রাখা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিলো। সেখান থেকে আবার জীপে উঠিয়ে আমাকে নেয়া হলো আরেকটা হাসপাতালে, কিন্ত তারাও আমার চিকিৎসা করতে চাইলো না। তারা জানালো, তাদের কাছে যথাযথ যন্ত্রপাতি নেই আমার চিকিৎসা করার মতো, এখানে রাখা হলে পরদিনই আমি মারা যাবো। তখন আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হলো করাচীর একটা হাসপাতালে। ভাগ্য ভালো, তারা আমাকে বের করে দেয়নি বাকীদের মতো।
সেই হাসপাতালটাই পরবর্তী আড়াই মাসের জন্যে আমার ঘরবাড়ী হয়ে উঠলো। কয়ক সপ্তাহের ব্যবধানে আমাকে তিনটা মেজর আর দুটো মাইনর সার্জারীর মধ্যে দিয়ে যেতে হলো, আমার শরীরটাকে কেটেকুটে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করলেন সার্জনেরা। আমার হাত আর মেরুদণ্ডে প্রচুর লোহার দণ্ড বসালেন ডাক্তারেরা, সেখানকার হাড়গুলো ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড শারিরীক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হচ্ছিল, সেগুলো ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। কিন্ত তারচেয়ে বেশী ছিল মানসিক যন্ত্রণা। একে তো নিজেকে হারিয়ে ফেলার শোকটা কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না আমি, তার ওপরে যে মানুষগুলোর দিকে আমি সবটুকু ভরসা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম, যারা আমার হাত ধরবে ভেবেছিলাম, তারা আমাকে একা রেখে সরে গেল সেই মূহুর্তে। এই যন্ত্রণাটা আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না।
আঠারো বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়েছিল। আমি একটা রক্ষণশীল বেলুচ পরিবার থেকে এসেছি, যেখানে পরিবারের নারী সদস্যদের ‘না’ বলার অধিকার নেই। যখন দুর্ঘটনাটা ঘটে, তখন আমার বয়স একুশ। গাড়িটা আমার স্বামীই চালাচ্ছিলেন, আমি তার পাশে বসে ছিলাম। যদিও সৌভাগ্যবশত দুর্ঘটনার আগেই তিনি লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন, খুব বেশী আহত হননি। তবে আহত একটা মানুষকে তিনি নিজের পাশেও রাখতে চাননি। পঙ্গুত্ব বরণ নিশ্চিত হবার পরে আমার জীবনসঙ্গী তার মন থেকে আমার নামটা অবলীলায় মুছে দিলেন। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম আমার কাছের মানুষগুলোর দূরে সরে যাওয়া। ওদের এই চেহারাটা আমি কোনদিন দেখিনি, দেখতে হবে এমনটাও ভাবিনি।
একদিন সার্জারী টিমের প্রধান যে চিকিৎসক ছিলেন, তিনি আমার কেবিনে এলেন। আমাকে বললেন, “আমি শুনেছি তুমি শিল্পি হতে চেয়েছিলে। তোমার জন্যে একটা দুঃসংবাদ আছে, হয়তো তোমাকে বাকীটা জীবন গৃহিনী হয়েই কাটাতে হবে। কারণ তুমি আর কখনও রং-তুলি ধরতে পারবে না।” পরদিন তিনি আবার এলেন, বললেন- "তোমার মেরুদণ্ডের আঘাতটা খুব মারাত্নক, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, কিন্ত তুমি আর কখনোই হাঁটতে পারবে না, এটা হচ্ছে বাস্তবতা।” শুনে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, তাকে বললাম, “ঠিক আছে, আপনাকে ধন্যবাদ।”
তার পরেরদিন তিনি আবারও এলেন আমাকে দেখতে, আমি অপেক্ষা করছিলাম, এবার কোন দুঃসংবাদটা শুনতে হয় আমাকে। কিন্ত তিনি যেটা বললেন, সেটা শোনার প্রস্ততি শুধু আমার কেন, কোন মেয়েরই থাকে না। তিনি বললেন, মেরুদণ্ডের এই আঘাতের কারনে আমি কখনও সন্তান জন্ম দিতে পারবো না, আমি কোনদিন মা হতে পারবো না! সেই দিনটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন। এত আঘাত, শারিরীক যন্ত্রণা, কাছের মানুষদের চলে যাওয়া কোনকিছুই আমাকে ভাঙতে পারেনি, যেটা পেরেছিল দুই লাইনের এই বাক্যটা। নিজের উপস্থিতি নিয়েই আমার মধ্যে বিরক্তি তৈরী হলো, নিজেকে আমি প্রশ্ন করলাম, কেন আমি বেঁচে আছি? কেন আমি সেদিনই মরে গেলাম না?
হতাশা আমাকে ঘিরে ধরছিল। আমি শুধু মুক্তির উপায় খুঁজছিলাম জীবনের কাছে। একদিন আমি আমার ভাইকে বললাম, “হাসপাতালের এই সাদা দেয়ালটা দেখলেই আমার হাত নিশপিশ করে, আমি স্থির থাকতে পারি না, দয়া করে আমাকে ব্রাশ আর রঙ এনে দাও, আমি আঁকতে চাই।” রং-তুলি পেয়ে সেই দেয়ালে আমি আমার ব্যান্ডেজে মোড়ানো ভাঙা হাত নিয়ে প্রথম যে ছবিটা আঁকলাম, সেটা ছিল আমার নিজের মৃত্যুশয্যার একটা কাল্পনিক ছবি। কোন কথা না বলেই আমি আমার হৃদয়ের জমাট দুঃখগুলোকে বের করে দিতে চেয়েছিলাম, ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম বাতাসে। সবাই খুব প্রশংসা করলো, আমাকে বাহবা দিলো। কিন্ত ছবির পেছনে উড়তে থাকা কষ্টের পুঞ্জিভূত মেঘগুলো হয়তো কারো চোখে পড়েনি।
সেদিনই আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম, যে ক’টা দিন বাঁচি, শুধু নিজের জন্যে বাঁচবো; জীবনটাকে পুরোপুরি উপভোগ করবো। কারো জীবনের পারফেক্ট পারসন হওয়াটা আমার কাজ নয়, সেটা করার জন্যে আমি জন্ম নেইনি। আমি শুধু সময়টাকে পারফেক্ট করে তুলবো, আমার নিজের জন্যে। আমি আমার ভয়গুলোকে জয় করবো, যেকোন মূল্যে। আমি একটা কাগজে তালিকা করা শুরু করলাম, কোন ব্যাপারগুলোকে আমি ভয় পাই, কিসের সামনে আমি পিছিয়ে যেতে চাই। একটার পর একটা ব্যপার জড়ো হতে থাকলো খাতার পাতায়, আর আমি নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম, যেকোন মূল্যে এগুলোকে পেরিয়ে আসতে হবে আমাকে।
আমার সবচেয়ে বড় ভয়ের নাম কি ছিল জানেন? ডিভোর্স। আমি আমার স্বামীর পাঠানো ডিভোর্স লেটারটাতে নির্দ্বিধায় সই করে দিলাম। যেদিন আমি খবর পেলাম যে সে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে, আমি দারুণ খুশী হয়েছিলাম, তাকে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে বলেছিলাম, তার জীবনের পটপরিবর্তনে আমি খুব খুশী, শুভকামনা জানিয়েছিলাম তাকে। সে’ও জানে, আমি আজও তার ভালোর জন্যে প্রার্থনা করি। আমার দ্বিতীয় ভয় যেটা ছিল, আমি কখনও মা হতে পারবো না। এটার কোন সহজ সমাধান ছিল না, পরে আমি ভাবলাম, আমার আশেপাশে এত শিশু, তাদেরকেই আমি মায়ের ভালোবাসাটা দিতে পারি। শুধুশুধু কান্নাকাটি করার তো কিছু নেই। এমন অনেক শিশুর জন্ম হয় এখানে, যাদের বাবা মায়েরা হয়তো তাদের দায়িত্ব নিতেই চায় না। এমন কাউকে দত্তক নিলেই তো হয়! আমি সেটাই করলাম।
হুইলচেয়ারে বসে থাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা কি জানেন? লোকে ভাববে আপনি দূর্বল। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষেরা নিজেদের পারফেক্ট ভাবতে পছন্দ করে, বাকীদের তারা ইমপার্ফেক্ট মনে করে। শুধু এই তথাকথিত দুর্বলতা ঢাকতেই আমি জনস্রোতের মাঝে মিশে গেলাম। আমি আঁকাআঁকি শুরু করলাম, মডেলিং ক্যাম্পেইনে নাম লেখালাম, উপস্থাপিকা হিসেবে টিভিতে দেখা গেল আমাকে। একটা সময়ে আমি জাতিসংঘের পাকিস্তানবিষয়ক ওম্যান অ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব পেলাম। এখন আমি নারী আর শিশুদের অধিকার নিয়ে কথা বলি, বিবিসির একশো সেরা নারীর তালিকায় আমার নাম আসে। ফোর্বসের চোখে সেরা ত্রিশ নারী অনুপ্রেরনাদাত্রীর একজন আমি। এসব কিন্ত একদিনে হয়নি।
যখন আপনি আপনার বর্তমান অবস্থাটাকে গ্রহণ করে নিয়ে ভবিষ্যতকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন, দেখবেন, আপনি অদ্ভুত একটা শক্তি পাচ্ছেন মনের ভেতরে। বিজয়ের শুরুটা মনের ভেতর থেকেই করতে হয়। আমরা একটা প্ল্যান করে এগিয়ে যাই, যখন সেই পরিকল্পনাটা ব্যর্থ হয়, আমরা অনেকেই হাল ছেড়ে দেই। এটা মস্ত বড় একটা ভুল। আমি কোনদিন হুইলচেয়ারে বসতে চাইনি। আমি কখনও ভাবিনি, আমার বাকীটা জীবন হুইলচেয়ারে কাটবে। পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু হবে না, সেটার জন্যে জীবনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, জীবনকে চ্যালেঞ্জ করুন।
ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক, হতাশায় মুষড়ে পড়ে কান্নাকাটি করাটাও স্বাভাবিক। সবকিছু মেনে নেয়াটা ঠিক আছে, কিন্ত হাল ছেড়ে দেয়াটা কখনোই কোন ‘অপশন’ নয়। লোকে বলে ব্যর্থতা নাকি অপশন নয়। ব্যর্থতা সবচেয়ে ভালো অপশন হতে পারে, যদি আপনি সেই ব্যর্থতাটাকে পুঁজি করে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। আর যদি চুপচাপ হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেন, তাহলে লোকের কথাই ঠিক। জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত, প্রতিটা সেকেন্ডকে উপভোগ করুন, সাফল্য-ব্যর্থতা সবকিছুই উদযাপন করুন। প্রতিটা মূহুর্ত মূল্যবান। জীবন তো একটাই। মরে যেতে হবে একদিন। মৃত্যুর আগে দয়া করে মৃতদের কাতারে নাম লেখাবেন না প্লিজ!
-মুনাইবা মাজারি- পাকিস্তানের আয়রন লেডি নামে যাকে খেতাব দিয়েছে মিডিয়া। ভয়াবহ দূর্ঘটনা, শারিরীক অক্ষমতা কিংবা পঙ্গুত্ব- কোনকিছুই যাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। হুইলচেয়ারে বসেই যিনি হয়ে উঠেছেন নারীত্বের দুর্বার শক্তির প্রতীক। জীবন তাকে চমকে দিয়েছিল এক দুপুরে, তিনি হার মানেননি, তিনিও জীবনকে চমকে দেয়ার মিশনে নেমেছেন। প্রতিটা মূহুর্তে ছাপিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে, অনুপ্রাণিত করছেন বিশ্বের লাখো নারীকে, কোটি মানুষকে। ভালো থাকবেন মুনাইবা মাজারি, আপনার জন্যে শুভকামনা। নারী বলতে আমরা আপনার মতো দুঃসাহসীদেরই বুঝি, যারা ভেঙে পড়ে, কিন্ত মচকে যায় না কখনও।
আরও পড়ুন-