আসছে নারী দিবসে নারীমুক্তি নিয়ে হরেক রকম পোস্ট দেখা যাবে। কিন্তু ভাতে চুল পাওয়ার অভিযোগে একজন নারীকে যখন ন্যাড়া করে দেওয়া হয়, তখনই প্রশ্ন আসে- কতটুকু হলো নারীমুক্তি?

"আমারে মারে..তরকারি ভালা হইছে না, উডান ফুরা হইছে না, ভাত নরম হইয়া গেছেগা, বাপের বাড়ি থেইকা ভালা-ভুলা আইনা খাওয়াই না, ট্যাকাটুকা আইনা দেই না...আমার বাপেই চলতে পারে না, আমি কইত্তে ট্যাকা আইনা দিমু?"

কথাগুলো মুন্নীর। পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়েছিল ফরিদপুরের সায়েম এর সাথে। স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শ্বাশুড়িসহ গাজীপুরে থাকতেন মুন্নী। বিয়ের পর থেকেই সায়েমের পরিবার যৌতুকের জন্য চাপ দেয় মুন্নীকে। কিন্তু নিজের বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থাই খারাপ, এর মধ্যে যৌতুকের টাকা চান কী করে! বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে পারেন না দেখে চাকরি নিয়েছিলেন বাড়ির কাছেই একটি স্পিন হুইল ফ্যাক্টরিতে। মাস শেষে যে টাকা পেতেন, মুঠ করে স্বামীর হাতে তুলে দিতেন। কিন্তু মাদকাসক্ত স্বামী কি আর এতে তুষ্ট হয়?

তরকারি ভাল না হলে, ভাত নরম হয়ে গেলে, উঠান ঝাড়ু দিতে দেরি হলে ইত্যাদি নানা কারণেই মুন্নীর উপর নির্যাতন করে সায়েম ও তার পরিবার। চাকরী সামলিয়ে ঘরের সব কাজ করেও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পান না তিনি। কিছুদিন আগে ভাত খাওয়ার সময় ভাতে চুল পেয়েছিল তার স্বামী সায়েম। আর তাতেই রেগে আগুন হয়ে মারধোর শুরু করে মুন্নীকে এবং এক পর্যায়ে মাথার সব চুল ন্যাড়া করে দেয় তার।

শুধু তাই না, মুন্নী যাতে চিৎকার-চেঁচামেচি না করতে পারে তাই তারা টানা তিনদিন তালাবদ্ধ করে রাখে তাকে। তিনদিন পর ছাড়া পেলে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এরপর সে বাপের বাড়িতে চলে যায় এবং সায়েম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করে। 

এখানে একজন মুন্নী শুধুই একটি নাম নয়, সম্পূর্ণ বাংলাদেশের প্রতিনিধি। পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর 'ভায়োলেন্স এগেইন্সট উইমেন' এর এক জরীপে দেখা গেছে প্রতি ১০০ জন নারীর ৮০জনই নিজেদের বিবাহিত জীবনে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। গ্রামাঞ্চলে হারটা একটু বেশি হলেও শহরাঞ্চলেও কিছু কম নয়।

দু বছর আগে নারী দিবসকে কেন্দ্র করে একটি বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে জুঁই, যেখানে এক নারী পার্লারে এসে চুল এমনভাবে ছোট করার কথা বলেন, যাতে হাত দিয়ে চুল ধরা না যায়৷ গভীর অর্থবহ বিজ্ঞাপনটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল তখন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজার হাজার শেয়ার হয়েছিল, সবাইকে নাড়া দিয়েছিল সেটি। আমার এক আপু বিজ্ঞাপনটি দেখে বলেছিলেন, 'আমি হলে জীবনেও চুল কাটতাম না, জামাইয়ের হাতই কেটে ফেলে দিতাম এক কোপ দিয়ে'।

বিজ্ঞাপনটির থেকে নেয়া

সত্যিই কি তাই? নারীরা কি এমন প্রতিবাদী হয় সবসময়? না। বেশিরভাগ নারীরা অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে মেনে নেয় সবকিছু৷ বাকীরা যারা প্রতিবাদী হয় বা হতে নেয়, সমাজ তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে বলে- 'মেনে নাও সব, মেয়ে হয়ে জন্মেছো, সহ্য শক্তি বাড়াও, স্বামীর ঘর করো।' বেশীরভাগ নারীই সমাজের কথা ভেবে মেনে নেয় সব। হাতেগোনা কিছু নারীই পারে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে।

শিক্ষিত হোক, কি অশিক্ষিত; শহর হোক, বা গ্রাম; কম-বেশি সব পরিবারেই নারী নির্যাতন হয়ে থাকে। সে নির্যাতন হতে পারে শারীরিক কিংবা মানুষিক। যতদিন না প্রতিটি নারী প্রতিবাদী হবে, ততদিন এই নারী নির্যাতন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চলতেই থাকবে। সবার আগে নারীদেরই চাইতে হবে নারী মুক্তি। তবেই 'মুন্নী'দের মুক্তি মিলবে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা