আশ্চর্য হলেও সত্যি, খুলনায় এখনো টাউন সার্ভিস হিসেবে রয়ে গেছে কয়েকটি বাস, যেগুলোকে স্থানীয়রা মুড়ির টিন বলে ডাকে!
আমাদের দেশে এক ঐতিহ্যবাহী পরিবহন ছিল। দেখতে ছোট বাসের মতো, লোকে ডাকতো মুড়ির টিন বলে। বাংলা সাহিত্যের অনেক উপন্যাসে ঘুরে ফিরে এসেছে মুড়ির টিন প্রসঙ্গ। হুমায়ূন আহমেদও তার বিভিন্ন উপন্যাসে মুড়ির টিন পরিবহনকে এনেছেন। সেই থেকে অদ্ভুত নামধারী এই পরিবহনটার প্রতি আমার একটু কৌতূহল ছিল। হুমায়ূন আহমেদের 'অনীল বাগচির একদিন' উপন্যাস অবলম্বনে হওয়া সিনেমাতে একাত্তর সালকে ধারণ করতে দেখানো হয়েছে এই মুডির টিন সার্ভিসকে। একসময় তো ঢাকার গণপরিবহন মানেই ছিল শুধু এই মুড়ির টিন। ঢাকা শহরের গণপরিবহনের যাত্রা শুরুই হয় 'মুড়ির টিন' সাইজের এই বাসগুলো দিয়ে।
কিভাবে এসেছে এই মুড়ির টিনগুলো? তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। মিত্রবাহিনী তাদের পরিবহনগুলো নিলামে বিক্রি করে এই অঞ্চলে। মিত্রবাহিনীর ব্যবহার করা গাড়ি, ট্রাক এসব আর কি। সেই ট্রাকগুলোর বডিতে বাসের আদল দিয়ে বানানো হয় বাস। ট্রাকের কাঠের বডির উপর মুড়ে দেয়া হয় টিন। সেই থেকেই এই বাসগুলোর গায়ে তকমা পড়ে যায় টাইটেল- মুড়ির টিন!
ইংল্যান্ড থেকে এই মুড়ির টিনগুলোর ইঞ্জিন আমদানি করা হতো। বডি অবশ্য আমাদের স্থানীয় মিস্ত্রীরাই তৈরি করতেন। ভেতরটায় থাকত বেঞ্চের মতো সরু সিট। সেসব সিটে বসার ভাগ্য মিলত বড়জোর বিশ পঁচিশজনের। তারচেয়ে অধিক থাকত মূলত দাঁড়িয়েই। ঘামে, লোকের গায়ের গন্ধে প্রাণ যাওয়ার জোগাড়। যদিও জানালা পুরোটাই খোলার সুবিধা ছিল। এই মুড়ির টিনগুলো তখন শহরের একমাত্র গণপরিবহন হওয়ায় বিশাল চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। এতোটুকুন জায়গা, তাতে মুড়ি মুড়কির মতো যাত্রী ওঠে। কি একটা হাশফাঁস অবস্থা। লোকে তাই মজা করে বলতে শুরু করে, এগুলো বাস নয় মুড়ির টিন!
শুরুর দিকে সদরঘাট, নবাবপুর, ইসলামপুর, চকবাজার, গুলিস্তানের মধ্যে চলাচল করত মুড়ির টিন। পরে নারায়ণগঞ্জ, মিরপুর, ডেমরা, রামপুরা রুটে মুড়ির টিন বাস চলত। এ ছাড়া গুলিস্তান থেকে কালিয়াকৈর, নয়ারহাট, আরিচায়ও যাতায়াত করত। মুড়ির টিন বাস সত্তর ও আশির দশকে বেশি চলেছে। তখন ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি থাকলেও দ্রুত যাতায়াতের সুবিধার্থে মানুষ ঝুঁকে পড়ে মুড়ির টিন নামক এই ছোট ছোট বাসগুলোর দিকে।
এই গাড়িগুলো স্টার্ট দিতে হতো হাতে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে। পরে অবশ্য চাবি সিস্টেম করা হয়। হর্ণ ছিল পিতলের। আর গতি? খুব বেশি তা নয়, ঘন্টায় ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যেই ওঠানামা করত স্পিড। বাসের কন্ডাক্টরদের কাধে ঝুলত লম্বা ফিতাওয়ালা একটা ব্যাগ। ভাড়া আদায় করে রাখা হতো সেখানে। টিকেট আর টাকা রাখার জন্য তিনটা পকেট থাকত এসব ব্যাগে। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা অন্যরকম ক্ল্যাসিক ব্যাপার আছে।
আশির দশকের পর থেকে উঠে যেতে থাকে এই মুড়ির টিনগুলো। তবে কাঠের বডির বাসগুলো তারও পরে কিছুসময় ধরে চলে। ঢাকার বাহাদূর শাহ পার্কের ঐদিকটায় ছিল মুড়ির টিন সার্ভিসের পার্কিং। নারায়ণগঞ্জ রুটেও চলত মুড়ির টিন। নারায়ণগঞ্জ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ভাড়া ছিল মাত্র ছয় আনা বা আট আনা। আমাদের সাহিত্যে মুড়ির টিন অনেকভাবে এসেছে বিভিন্ন সময়।
কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনও মুড়ির টিন নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি তার স্মৃতিচারণমূলক লেখায় লিখেছেন, এই ধরনের বাসগুলোর একটা ডাকনাম ছিল মুড়ির টিন। আসল নাম ‘টাউন সার্ভিস’। ছ আনা বা আট আনায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ। গুলিস্তান থেকে ছাড়ত, ভিক্টোরিয়া পার্কের ওদিক থেকে। ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম ততোদিনে ‘বাহাদূর শাহ পার্ক’ হয়ে গেছে। সেই পার্কের দক্ষিণ দিকে রাস্তার ওপাশে ‘মিউজিক্যাল মার্ট’ নামে একটা স্টুডিও ছিল। বিখ্যাত লোকজনরা গিয়ে ছবি তুলত সেই স্টুডিওতে। নারায়ণগঞ্জের বাস ছাড়ত ওই স্টুডিওর সামনে থেকে।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল একবার এই মুড়ির টিনে চড়ার৷ যদিও খুব সুখকর অভিজ্ঞতা না, যারা চড়েছেন তার দায়ে পড়ে চড়তেন মুড়ির টিনে। এজন্য আজও আমরা কোনো গণপরিবহনের বেহাল দশা বুঝাতে বলি, শালার মুড়ির টিন মার্কা সার্ভিস। তবুও, যখন ইন্টারনেটে সেই মুড়ির টিন বাসগুলোর ছবি দেখি, কল্পনায় ভাসে আমাদের সত্তর আশির দশকের ঢাকা শহর। কত গল্প নিজের অজান্তেই মনে মনে তৈরি করে ফেলি। খুব ইচ্ছে করে, যদি একবার মুড়ির টিনে চড়তে পারতাম নিশ্চয়ই কিছু অন্যরকম অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারতাম। কিন্তু কোথায় পাব এই দুই হাজার আঠারো সালে, মুড়ির টিন টাউন সার্ভিস?
আশ্চর্য হলেও সত্যি, শুনেছি খুলনায় নাকি এখনো টাউন সার্ভিস হিসেবে রয়ে গেছে কয়েকটি বাস, যে গুলোকে স্থানীয়রা মুড়ির টিন বলে ডাকে। দেখতেও মুড়ির টিনের মতোই, আকারে ছোট। তবে, খুলনার এই টাউনি সার্ভিসও নাকি বিলুপ্তির পথে৷ খুলনার রুপসা ফেরিঘাট থেকে ফুলতলা পর্যন্ত একসময় জমজমাট ছিল এই টাউন সার্ভিস। কিন্তু এখন আর নেই সেই আগের দিন। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের আগে কোনোরকম চলত ১৫/২০ টা গাড়ি। পরে ফিটনেস সমস্যার কারণে এখন এমনিতেই গাড়ির সংখ্যা কমে গেছে। যে কয়টি আছে সেগুলোও আর কতদিন চলবে কে জানে। বর্তমানে তিন চারটি গাড়ি চললেও সেগুলোও অনিয়মিত।
জেনে অবাকই হলাম, এখনো মুড়ির টিন নামক বাসগুলো রয়ে গেছে দেশে। জানিই না, অথচ এগুলোও বিলুপ্তির পথে। পুরানো কোনো বস্তুর দৈন্যদশা দেখলে আমার মন চলে যায় এসবের শুরুর সময়কার দিকে। আমি ভাবি, যখন কোনো কিছু শুরু হয়, তখন কতই না জমজমাট ব্যাপার থাকে। তারপর সব কিছুরই আবেদন একটু একটু করে হারিয়ে যায়! শেষের খবর যদি আগেই জানা যেত, তাহলে কি বাঁচানো যেত সব পুরানো হয়ে যাওয়া বস্তুকে? কে জানে, হয়ত না। কারণ, প্রকৃতির নিয়মই এমন। সময়ের দরকারে বদলে যেতে হয় আমাকে, তোমাকে, আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি- সব কিছুকে। মুড়ির টিনও বাদ যাবে কেন তবে?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন