করোনার থাবায় একটি পরিবার ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো যেভাবে
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বিজ্ঞাপনে 'অযথা বাড়তি খরচ কেন করবেন' বলা ডা. আবুল মোকারিম মারা গেলেন করোনায়, তিনি ডা. মুরসালিনের বাবা। তারপর বোন, তারপর নানি। মা'ও ভর্তি হাসপাতালে। ২০২০ সালের মে মাসটাকে কখনও ভুলতে পারবেন না মুরসালিন...
২০২০ সালের মে মাসটাকে কখনও স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারবেন না ডা. মুরসালিন। পাঁচজন সদস্য ছিলেন তার পরিবারে। গত মাসেই করোনার করাল থাবা মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে কেড়ে নিয়েছে তিনজনকে, বাকী দুজনও পজিটিভ হয়েছিলেন, রোগে ভুগে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে। বাবা, নানি এবং এক চাচাতো বোনকে হারানোর এই ক্ষত কবে সেরে ওঠবে মুরসালিনের জানা নেই। তিনি শুধু জানেন, তিনি বেঁচে আছেন, বাকীটা জীবন ২০২০ সালের মে মাসের এই বিচ্ছেদের বেদনা বুকে চেপেই তাকে পার করতে হবে।
দুঃসংবাদের শুরুটা হয়েছিল ডা. মুরসালিনের বাবা ডা. মেজর (অব) আবুল মোকারিম মোহাম্মদ মহসিন উদ্দিনের মাধ্যমে। ইবনে সিনা হাসপাতালের চিকিৎসক, রেডিওলজি বিভাগের প্রধান এবং দেশসেরা রেডিওলজিস্ট ছিলেন তিনি। আবুল।মোকারিমকে বিটিভির দর্শকেরা চিনবেন। নাটকের বিরতিতে, ক্রিকেট খেলায় দুটো ওভারের মাঝখানে টিভি কমার্শিয়ালে তিনি অজস্রবার হাজির হয়েছেন আমাদের সামনে। ইবনে সিনা হাসপাতালের একটা বিজ্ঞাপনে একদম শেষ প্রান্তে তাকে দেখা যেতো কয়েক সেকেন্ডের জন্যে, হাস্যোজ্জ্বল মুখে তিনি বলতেন- 'অযথা বাড়তি খরচ কেন করবেন?'
বাবার মতো মুরসালিন নিজেও ইবনে সিনার রেডিওলজিস্ট। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর তার অনেক সহকর্মীই কর্ম্বিরতি নিয়েছেন, ছুটি নিয়ে সরে গেছেন যুদ্ধের।ময়দান থেকে। মুরসালিন সেটা করেননি। ডা. আবুল মোকারিম ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কর্মজীবনে সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন। বাবার রক্ত তো ছেলের শরীরেও আছে। মুরসালিন সিদ্ধান্ত নিলেন, পরিস্থিতি যেদিকেই গড়াক, তিনি দায়িত্ব থেকে সরবেন না, পিছু হঠবেন না। কারণ এই মুহূর্তেই রোগীদের সবচেয়ে বেশি দরকার ডাক্তারের সেবা। সহকর্মীদেরও বোঝালেন তিনি। কিন্ত অনেকেই শুনলো না তার কথা। প্রস্থানের নিরাপদ রাস্তা বেছে নিলো তারা।
ডা. মুরসালিন তার বাবাকে বলেছিলেন বাড়ি থেকে বের না হতে। ডা. আবুল মোকারিমের অ্যাজমার সমস্যা ছিল, হার্টের কন্ডিশনও খুব একটা ভালো ছিল না। করোনায় আক্রান্ত হলে ব্যাপারটা বিপজ্জনক দিকে মোড় নেবে, তাই বাবাকে বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন মুরসালিন। কিন্ত বাবা আবুল মোকারিমও নিজের দায়িত্ব থেকে পিছু হঠেননি, তিনিও কাজ করে গেছেন সমানে।
করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ায় পরিবারের সবার করোনা টেস্ট করিয়েছিলেন ডা. মুরসালিন। মে মাসের ৫ তারিখে দুঃসংবাদটা এলো, পাঁচ সদস্যই করোনা পজিটিভ! ডা. আবুল মোকারিমকে ভর্তি করা হলো ইবনে সিনা হাসপাতালে। সেখান থেকে নেয়া হলো কল্যাণপুরের ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় নিয়ে যাওয়া হলো সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। ১২ তারিখে সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে গেলেন ডা. আবুল মোকারিম। এক ব্যাগ প্লাজমার জন্যে হন্যে হয়ে ছুটলেন সবাই, ফেসবুকে সারা পড়ে গেল। প্লাজমা ডোনার জোগাড়ও হলো, কিন্ত ক্রসম্যাচিংয়ে মিললো না নমুনা। কিন্ত আবুল মোকারিমের হাতে এতটা সময় ছিল না। চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সেই রাতেই তিনি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। দেশ হারালো কিংবদন্তীতুল্য এক চিকিৎসককে।

বাবার মৃত্যুর খবরটা যখন ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সবাইকে জানাচ্ছেন ডা. মুরসালিন, তখনও তার কল্পনায় ছিল না যে, ঝড়ের কেবল শুরু, এই কালবৈশাখী তার জীবনকে তছনছ করে দেবে, তার জীবনটাকে এলোমেলো করে ফেলবে। বাবাকে হারানোর মাত্র তিনদিন পরে, ১৫ই মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন তার চাচাতো বোন। সেই বোন তাদের সঙ্গেই একই বাসায় থাকতেন, পাঁচ সদস্যের একজন ছিলেন তিনি। মুরসালিনের নানি'ও তখন হসপিটালাইজড, ঘাতক সেই একই- করোনা।
চাচাতো বোন মারা যাওয়ার পরেরদিন ডা. মুরসালিনের মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তার। আইসোলেশনে থাকা মুরসালিন তখন জানতেন না, মায়ের মুখটা আর কখনও তিনি দেখতে পাবেন কিনা! একদিকে মায়ের অবস্থা অপরিবর্তিত, অন্যদিকে হাসপাতালে থাকা দাদীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তাদের পাশে গিয়ে যে দাঁড়াবেন, বা পাশে থাকবেন, সেটাও করতে পারছিলেন না মুরসালিন, কারণ করোনা আক্রান্ত করেছে তাকেও। এই মানুষটার জায়গায় নিজেকে একবার কল্পনা করুন। জীবনের ভয়াবহ একটা রূপ প্রত্যক্ষ্য করেছেন মুরসালিন, খুব বেশি মানুষ এমন ধাক্কা সইতে পারবে না।
তবে বিপদের তখনও বাকী ছিল। ২৩শে মে মুরসালিন খবর পেলেন, তার দাদীর অবস্থা খুব খারাপ। যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে। শেষমেশ খারাপ খবরটাই এলো, পরিবারের আরও একজন সদস্যকে করোনার কারণে হারালেন মুরসালিন। পরদিন, ২৪শে মে ছিল তার জন্মদিন। জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ, সবচেয়ে কষ্টদায়ক একটা জন্মদিন পার করেছেন মুরসালিন। বারবার মনে পড়ছিল বাবার কথা, নানির কথা, এই মানুষগুলোর সাথে এক বছর আগের এই দিনটাতে কত আনন্দই না করেছেন! অথচ দশটা দিনের ব্যবধানে এতগুলো মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন!

মুরসালিনের মায়ের অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল এরমধ্যে। মে মাসের ২৬ তারিখে তার করোনা টেস্টের রেজাল্ট এলো নেগেটিভ। ২৮ তারিখে মুরসালিনও নেগেটিভ হলেন। সেদিন ফেসবুকে করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেটে নেগেটিভ লেখাটা দেখাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, একসঙ্গে এতগুলো প্রিয়জন হারানোর কি অসীম এক বোঝা তিনি বুখের ভেতরে চেপে রেখেছেন! দুঃস্বপ্নের মতো কাটানো পুরোটা মে মাসজুড়ে এই দুটো ভালো খবরই পেয়েছেন মুরসালিন, নিজের এবং মায়ের করোনা নেগেটিভ হবার সংবাদটা!
মুরসালিন নিশ্চিত, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোন পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেই তার পরিবারে রোগটা ছড়িয়েছে। তবুও তিনি নিজের কাজটা করে যেতে চান। বাবাকে তিনি দেখেছেন, সব প্রতিকূলতার মাঝেও দায়িত্ব পালন করতে। বাবার শিক্ষাটা নিজের জীবনেও কাজে লাগাতে চান তিনি। বাবা ছিলেন তার কাছে সুপারহিরো, তার আইডল। সেই মানুষটাকে তিনি হারিয়েছেন করোনার কারণে, হারিয়েছেন নানি এবং বোনকে, নিজে ভুগেছেন বিস্তর। তবুও তিনি আক্রান্ত মানুষের জন্যে কাজ করে যাবেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরবেন না। পালিয়ে যাওয়াটা যে তার রক্তে নেই।
আপনারা যারা করোনার ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারছেন না, খোলা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তারা ডা. মুরসালিনের ঘটনাটা থেকেই শিক্ষা নিতে পারেন। ডা. মুরসালিন তো রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। আপনারা যারা করোনাকে পাত্তা দিচ্ছেন না, সামান্য অসাবধানতায় পরিবারে এমন দুর্যোগ নেমে এলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন তো?
আরো পড়ুন- 'অযথা বাড়তি খরচ কেন করবেন' বলা মানুষটা চলে গেলেন করোনায়!