ছবি আঁকার জন্যে গিয়েছেন জেলে। একাত্তরে শরনার্থী শিবিরে দেখিয়েছেন পাপেট শো। নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন 'নতুন কুঁড়ি'র মতন অসাধারণ মঞ্চ। কিছু মানুষের জীবনের গল্প শুনলে মুগ্ধতা চলে আসে। আমাদের পাপেট ম্যানের গল্পটি সেরকমই...

আমাদের এ দেশে অল্প কিছু মানুষ এখনো আছেন, যারা অনেক বড় হওয়া সত্বেও ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে মিশে যেতে পারেন অনায়াসেই। সেরকমই এক মানুষ তিনি, আজ যার গল্প শুনবো আমরা। বিটিভি'তে 'মনের কথা' নামের একটা প্রোগ্রাম হতো। সেখানে পারুল, বাউল, ষাঁড়, ডাক্তার...পাপেটগুলোর পাগলামি বেশ লাগতো তখন। আর আসতেন একজন হাসিখুশি মানুষ। বড় বড় চুল ব্যাকব্রাশ করে পেছনে আঁচড়ানো, চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা আর হাতে রংতুলি, সাথে সাদা ক্যানভাস। কী সুন্দর করে সেখানে জলরং এ ছবি আঁকতেন। দেখে মুগ্ধ হতাম।

বিটিভি'র দুইটা অনুষ্ঠান নিয়ে খুব আগ্রহ ছিলো আমার। এক- মনের কথা। দুই- মীনার কার্টুন। মজার বিষয়- উনি যুক্ত ছিলেন দুইটা অনুষ্ঠানের সাথেই। 'মুস্তাফা মনোয়ার' নামের এই মানুষটির যে অবদান বাংলাদেশের সংস্কৃতির উন্নয়নে, শিশুকিশোরদের মানসপট পরিবর্তনে,তা নিয়ে পুরোটা লিখতে গেলে কখনোই শেষ হবেনা। তাই, চোখের তারায় যতটুকু আসে, ততটুকুই জানা যাক।

বিখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফার ছেলে তিনি। কবি'রা একটু উদার, উদাস, ভাবুক প্রকৃতির হয়। গোলাম মোস্তফাও ছিলেন না ব্যতিক্রম। মুস্তাফা মনোয়ার তাই সবসময়েই পেয়েছিলেন উদার এক পারিবারিক পরিবেশ। বাবা সবসময় সবাইকে ভালোবাসতে বলতেন, সম্মান করতে বলতেন, অসাম্প্রদায়িক হওয়ার কথা বলতেন। এই শিক্ষাগুলো খুব ছোটবেলাতেই মুস্তাফা মনোয়ারের চিন্তাভাবনা পাল্টে দেয়। তিনি হয়ে ওঠেন মানবিক এক মানুষ। তাছাড়া তাঁর যখন বয়স মাত্র পাঁচ, মা মারা যান। তাই পরিবারেও শাসনটা ওভাবে করা হয়নি তাকে। ছোট ছিলেন সবার। আদরে আদরেই বড় হয়েছেন।

জন্ম ঝিনাইদহে হলেও বাবার চাকরীসূত্রে শৈশব কেটেছে কলকাতায়। কলকাতার যে সময়টাতে তিনি বড় হয়েছেন, তখনো নগরায়ন শিল্পায়নের এতটা বাড়াবাড়ি হয়নি। মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াতেন নিজের মতন। হুগলিতে গঙ্গার ধারে ব্রিটিশ কায়দার এক বাড়িতে তারা থাকতেন। বাড়ি থেকেই গঙ্গা আর সে গঙ্গায় ভেসে যাওয়া নৌকা, স্টীমার লঞ্চ দেখতেন। বাইরে বেরোলে গাছপালা, ময়দান এগুলো তো আছেই। সবকিছু মিলিয়ে একটা যেন রঙিন চশমা। শৈশবের যে 'রঙিন চশমা' আজও খুলতে ভুলে গিয়েছেন মানুষটি। তখনই শুরু করলেন আঁকাআঁকি। করবেন নাই বা কেন, চারপাশে যার রং ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে যে রং নিয়েই থাকবেন, সেটা ধারণা করাই যাচ্ছিলো।

তবে আঁকাআঁকির শুরুতেই কিন্তু আছে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। জেলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। তখন ১৯৫২ সাল। ঢাকায় এসেছেন জিন্নাহ। এসেই দুম করে বলে বসলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সেদিন কিশোর মুস্তাফা মনোয়ারও বাবার সাথে গিয়েছিলেন জিন্নাহ'র এই অনুষ্ঠানে, কার্জন হলে। এই অনুষ্ঠানের পরেই শুরু হলো ভাষা আন্দোলন। মিছিলে গেলেন মুস্তাফা মনোয়ারও। তখন তিনি মাত্র ক্লাস নাইনের ছাত্র। মিছিলে যাওয়ার পরদিন খবর পেলেন- বিক্ষোভকারী অনেক ছাত্রকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি তখন নিজের মত করে ছবি আঁকতে লাগলেন। প্রতিবাদের ছবি। বর্ণমালার উপর কেউ জাল বিছিয়ে দিচ্ছে, কেউ গলা টিপে কথা বলা বন্ধ করে দিচ্ছে এরকম সব ছবি। ছবিগুলো বেশ আলোড়ন তুললো। তবে বেশিদিন ছবি আঁকা গেলোনা। পাকিস্তানী আর্মি এসে ধরে নিয়ে গেলো তাকে। জেলে এক মাসের মত থাকতে হলো। এরপর আবার ছেড়ে দেয়া হলো। ছবি এঁকে কোনো পুরস্কার, স্বীকৃতি, মূল্যায়ন... কিছু পাওয়ার আগেই জেলে যাওয়ার বিরল অভিজ্ঞতা হলো তাঁর।

এরপর আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন মানুষটি। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হলেন কলকাতা আর্ট কলেজে। তবে প্রথমে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে, বিজ্ঞান বিভাগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লোহালক্কর আর প্রযুক্তির ব্যবহার দেখে বিজ্ঞানকে বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়েছিলো তাঁর। কিন্তু যখন পড়তে গেলেন, বুঝলেন- এটা খুব বাজে সাবজেক্ট। বের হয়ে এলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যে প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছিলেন; কলকাতা আর্ট কলেজে, সে প্রতিষ্ঠানে পড়ার আগ্রহ তৈরী হলো। কিন্তু ভর্তি হতে পারছিলেন না তিনি। ভর্তির সময় পেরিয়ে গিয়েছিলো যে আগেই! চার মাস তো স্কটিশ চার্চ কলেজে নষ্ট করেছেন। কী করা যায়!

তখন সৈয়দ মুজতবা আলী ত্রাতা হিসেবে আসেন। তাঁর সাহায্যে ভর্তি হন তিনি কলকাতা আর্ট কলেজে। স্কুলে থাকাকালীন গান নিয়ে বেশ ভালো আগ্রহ ছিলো মুস্তাফা মনোয়ারের। আর্ট কলেজে ঢোকার পর সব আগ্রহ বাদ দিয়ে পুরো সময় তিনি আঁকার পেছনেই দিয়ে দেন। আঁকাআঁকির সূত্রে দেখা হয় একসময় সত্যজিৎ রায়ের সাথেও। যিনিও মুস্তাফা মনোয়ারের আঁকার খুব প্রশংসা করেছিলেন।

নিজের মত করে শিল্পকর্ম বানাচ্ছেন তিনি

এরমধ্যেই একবার চলে যান বাঁকুড়ার এক মেলায়। সেখানে দেখেন বড় বড় সব পাপেট। দেখে কৌতূহলী হন বিষয়টা নিয়ে। বাংলাদেশ, কলকাতাতেও পাপেট দেখেছেন তিনি। সেগুলো ছোট ছোট পুতুলের পাপেট ছিলো। কিন্তু এখানে ইয়া বড় বড় পাপেট দেখে বিষয়টা দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর কী করেছেন, সেটা তো আমরা সবাই-ই জানি। তবে পাপেট নিয়ে তাঁর যে গল্প আমরা অনেকেই জানিনা, সে গল্পটি কিন্তু অনেকটাই অন্যরকম।

দেশে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। শরনার্থী শিবিরে হাজির হয়েছে লাখে লাখে মানুষ। তাদের মধ্যে শিশুরাও আছে। যাদের চোখেমুখে সারাক্ষণই তীব্র আতঙ্ক। মুখ থেকে মুছে গিয়েছে হাসি। কী করা যায়! সিদ্ধান্ত নেয়া হলো- পাপেট শো করবেন মুস্তাফা মনোয়ার। এমনিতেও শরনার্থী শিবিরে যাওয়া আসা করতেন তিনি। সেখানে যখন পাপেট শো এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়কে তিনি তুলে ধরলেন। বাচ্চাদের মুখে কী হাসি!

এরপর পাপেটে তিনি আনলেন পারুল, বাউল, ষাঁড়কে। তাদের হাস্যরসাত্মক কথাবার্তার মধ্যেও মাঝেমধ্যে অদ্ভুত সব জীবনদর্শন খুঁজে পাওয়া যেতো। যেটা এই পাপেট শো'কে দিতো অন্য দ্যোতনা। তিনি চেয়েছিলেন যাদের নিয়ে তিনি পাপেট শো করবেন, তাদের মধ্যে যেন বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতি উঠে আসে। সেটার ক্ষেত্রে তিনি যে বরাবরই সচেতন ছিলেন, তা বলা বাহুল্য।

বাউল, পারুলের সাথে পাপেট ম্যান! 

শুধু মনের কথা'ই না, মীনার কার্টুন এবং সিসিমপুরের সাথেও যুক্ত ছিলেন তিনি। 'নতুন কুঁড়ি' নামের প্রবল জনপ্রিয় এক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার মঞ্চও গড়ে উঠেছিলো, তাঁর হাত ধরে। যদিও বিভিন্ন পলিটিক্যাল পার্টির ট্যাগ লেগে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনি আশাবাদী, আবার শুরু হবে হয়তো অনুষ্ঠানটি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপ-মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। জনবিভাগ উন্নয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এবং এডুকেশনাল পাপেট ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।  অনেকগুলো ক্ষেত্রে থাকার কারণে তিনি সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমকে দেখেছেন খুব কাছ থেকেই। উপলব্ধি করেছেন। বুঝেছেন সংস্কৃতির রকমফের। পালাবদল।

সংস্কৃতিক্ষেত্রে অবদানের জন্যে পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার। পেয়েছেন একুশে পদকও। যদিও নিজেই বলেন, আমার পুরস্কার আমি পেয়েছি অনেক আগেই। আমার জীবনটাই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এই পুরস্কার নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট।

আজ থেকে পঁচাশি বছর আগে জন্ম নিয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলার ঝিনাইদহে। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে পঁচাশি বসন্ত। অথচ তাকে দেখে কে বলবে, তিনি ইতিহাসের  এতগুলো ঘটনা দেখে এসেছেন জন্ম থেকে এ অবধি! যিনি নিজেও হাসতে হাসতে বলেন-

বয়স তো মাত্র একটা সংখ্যা। মনের বয়স আমার বাড়েনি একটুও

এই পঁচাশি বছরের 'কিশোর' মানুষটির দীর্ঘজীবন কামনা করি আমরা। বাংলাদেশের শিশুকিশোরদের জীবনকে রঙিন করার জন্যে যে রংতুলি তিনি তুলে নিয়েছিলেন হাতে, সেই তুলির রং কখনো না শুকিয়ে যাক, ক্যানভাস ভরে উঠুক বিচিত্র সব রং এর সমাবেশে, সেটাই প্রার্থনা।

শুভ জন্মদিন, পাপেটম্যান।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা