নচিকেতা চক্রবর্তী: মায়ের ক্যান্সার যাকে বানিয়েছিলো গায়ক!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
অভাবের তাড়নায় নামলেন গান গাইতে। যে গান আক্রমণ করলো বড় বড় কেউকেটাদের। হুমকি, ধামকি আর বিতর্কের মধ্যে দিয়ে যে জীবন কাটালেন নচিকেতা, সে জীবন কী সহজ ছিলো মোটেও!
নব্বই এর দশকে কলকাতায় একটা বড়সড় সাঙ্গীতিক বিস্ফোরণ হয়। মান্না দে, হেমন্ত, কিশোর কুমার, হৈমন্তী শুক্লা'দের যুগ পার হয়ে গানের নতুন এক ধরণ চালু হয়। জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তবতা, সমাজ-সম্পর্কিত টানাপোড়েন আর রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অসঙ্গতি'কে নিয়ে গান লেখা হয়, গাওয়া হয়। গানগুলোকে ডাকা হয়- জীবনমুখী গান নামে। এরমধ্যেই বাজারে আসে একটা এ্যালবাম- এই বেশ ভালো আছি। হুট করেই যেন বাজারে অ্যাটম বোমা পড়ে। মুড়িমুড়কির মত বিক্রি হওয়া শুরু হয় অ্যালবামটি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, গলির এখানে-ওখানে সবখানে বাজতে শুরু করে এই অ্যালবামের গান। 'জীবনমুখী গান' এর সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে দেন একজন গায়ক। নাম তার- নচিকেতা চক্রবর্তী৷ খুব অল্পসময়েই হয়ে ওঠেন উঠতি তরুণদের ক্রেজ।
গান গাইতে যখনই স্টেজে উঠছেন, পুরো আলো তাঁর দিকে। মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল, মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল, পরনে হিপ্পিদের মত পোশাক- রংচটা জিন্স আর ঢোলাঢালা শার্ট। অপরিষ্কার, রুক্ষমূর্তি অবয়বেও কন্ঠ যেন নিখুঁত পরিষ্কার, পরিপাটি, ঝকঝকে! একেকটা গান গাইছেন, স্টেজে হুল্লোড় উঠছে। 'ওয়ান্স মোর, ওয়ান্স মোর' স্বরে কান পাতা দায়। নচিকেতার উত্থান এভাবেই।
পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের বরিশালের পিরোজপুরে। এই তো সেদিনই বাপের ভিটেয় এসে কান্নাকাটিও করে গেলেন। তবে নিজের বড় হওয়া কিন্তু কলকাতায়। পড়াশোনা কলকাতার মণীন্দ্র কলেজে। লেখাপড়ায় মনোযোগ কম, মনোযোগ গান আর রাজনীতি-চর্চায়। নিজের মত করে গান গাওয়া। বাংলা গানে একটা নতুন ধারা শুধু আনলেনই না, সেই ধারাকে পৌঁছে দিলেন এক ঈর্ষণীয় উচ্চতায়। ফুল,পাখি,লতা,পাতা'কে কচুকাটা করে উঠিয়ে আনলেন খাপখোলা ধারালো তলোয়ার!
অবশ্য এরকমটা তো হওয়ারই ছিলো! নচিকেতার গানে যে বিদ্রোহের স্বর পাবো, তা একরকম নিশ্চিতই ছিলো। তাঁর গাইতে নেমে পড়া তো অভাবেরই তাড়নায়। নচিকেতার মায়ের তখন ক্যান্সার। নিজের চাকরটিও চলে গিয়েছে হুট করেই। মা বাঁচবেন কী না, নিজেদের পেটে কিছু পড়বে কী না... নানান সব দোটানার মধ্যে গানকে আঁকড়ে ধরলেন প্রানপণে। আমরা দেখলাম স্টেজে এক তরুণ বিশ্বসংসার ভাংচুর করা একেকটি গান গেয়ে যাচ্ছেন। দর্শকেরা হয়তো তাঁর সুরে সুর মেলাচ্ছেন, কিন্তু হৃদয়ের অন্তরালে যে লড়াই তিনি লড়ছেন নিজেকে বাঁচানোর জন্যে, মা'কে বাঁচানোর জন্যে... সে লড়াই বোঝার সামর্থ্য হয়ে ওঠেনি আমাদের। সে লড়াইয়ে সুর মেলানোর আস্পর্ধাও হয়ে ওঠেনি আমাদের।
গান কে মাঝেমধ্যে Gun(বন্দুক) এর মত করেই তিনি ব্যবহার করেছেন। সেই 'গান' এর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছেন শাসকদের, শোষিতের পক্ষে গলা মিলিয়েছেন। সংস্কৃতিক্ষেত্রে অসাধুতার বিপক্ষে গেয়েছেন 'বক্স অফিস', রাজ্য সরকারকে বিদ্রুপ করে গেয়েছেন 'উলটো রাজার দেশে', 'আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ'। দুর্নীতিবাজের উদ্দেশ্যে দরাজ গলায় গেয়েছেন 'হাল্লা বোল', বিয়েতে পণপ্রথা'কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন 'না না চাইনা' গান দিয়ে। সঙ্গীতযোদ্ধা তিনি, সঙ্গীত দিয়েই তাই ঘুনেধরা সিস্টেমকে নাড়াতে চেয়েছেন, সুরই তার অস্ত্র, সুরই তার যুদ্ধক্ষেত্র, সুরই তার প্রতিবাদ। তিনি তার প্রতিবাদের ক্ষেত্রে সফলও। আধুনিক গান মানেই যেখানে শুধু প্রেম, ভালোবাসার একঘেয়ে চর্বিতচর্বন, ন্যাকামির আদিখ্যেতা, সেখানে নচিকেতার গান বরাবরই মারণাস্ত্র। প্রত্যেক শিল্পীরই যে একটা দায়বদ্ধতা থাকে নিজের সময়কে গানে লিখে যাওয়ার, বলে যাওয়ার...তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া দৃষ্টান্ত এই মানুষ।
যে মানুষ গেয়েছেন এরকম মারাত্মক সব গান, তিনিই আবার হাজারো কোমল হৃদয়ে 'প্রেম' নামের প্রজাপতির পাখনাকে ওড়ানোর দায়িত্বও নিয়েছেন। বাসবেই ভালো, তুমি কী আমায় ভালোবাসো?, তার দুটি চোখ, দুজন মানুষ ঘর করে... একেকটা গান যেন একেকটা সময়! একেকটা অনুভূতি! নচিকেতার গানের যারা নিয়মিত শ্রোতা, তারা এতটুকু পড়েই নিশ্চয়ই উশখুশ শুরু করেছেন। আসল নাম দুটোই বলা হয়নি এখনো। 'নীলাঞ্জনা' আর 'রাজশ্রী' সিরিজের গানগুলো গেয়ে বাঙালীর বুকে “ভালোবাসা” নামক ফানুশকে জিইয়ে রাখার জন্যে নচিকেতার ভূমিকাই তো প্রধান। তবে, এটাও ঠিক, তাঁর রোমান্টিক গানগুলোও ঠিক রোমান্টিক হয়ে থাকেনি সে অর্থে, সেখানে যাপিত সমাজকে নানাভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে প্রচলিত বিভিন্ন সংস্কারকে। “নচিকেতা” নামক সুরের দোয়াত এখানেই সফল, এখানেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
নচিকেতার গানের আরেক অদ্ভুত দিক, তার গান সবাইকেই স্পর্শ করে যায় , কোনো না কোনো ভাবে। বিশ তলা ইমারতের সর্বোচ্চ তলায় বিশাল কক্ষের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে গদিআঁটা স্যুইভেল চেয়ারে বসে থাকা বড় কর্মকর্তা যেমন নচিকেতার গান উপলব্ধি করেন, ওই ইমারতের ঠিক নীচেই রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে চা-পাউরুটি খেয়ে দুপুরের খিদেকে প্রশমিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করা বেকার যুবকটিও গানগুলোকে উপলব্ধি করে একইভাবে। নচিকেতার গানগুলো যেন একেকটা শক্তপোক্ত সংযোগসেতু, বিপরীত দুই মেরু কেমন এক করে দেয়, সুরের মায়াজালে, অক্ষরের টানে।
কাদের জন্যে গান গাননি নচিকেতা? বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটানো জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষদের জন্যে গেয়েছেন, ডিভোর্সড হওয়া বাবা- মা’র দলছুট সন্তানের জন্যে গেয়েছেন, গেয়েছেন সারাদিন ঘামে ভেজা, শতমুখ তবু একা মানুষের জন্যেও, গেয়েছেন বেকারের জন্যে, আধুনিক প্রজন্মের জন্যে, রাজনীতিকদের জন্যে... নচিকেতার কলম, নচিকেতার গলা বঞ্চিত করেনি কাউকে, রেহাইও দেয়নি কাউকে। উদার আগ্নেয়াস্ত্রের মতই রক্তাক্ত, আঘাত করেছে সবাইকে।
শুধু গানেই থেমে থাকেননি। গল্প লিখেছেন। বই বের হয়েছে। নতুন বইয়ের জন্যেও লেখালেখি শুরু করেছেন, লিখছেনও নিয়মিত। বই পড়েন প্রচুর। বেশ কিছুদিন পর সিনেমা পরিচালনায়ও আসছেন তিনি। ‘সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা', লাইনটি চেনা লাগছে নিশ্চয়ই? নচিকেতার গানের প্রথম লাইন দিয়ে করা এ টাইটেলের সিনেমার পরিচালকও তিনিই। নিজের আত্মজীবনীই সিনেমার গল্প। সিনেমায় নীলাঞ্জনার পরিচয়ও খোলাসা করবেন তিনি। অভিনয় করবেন তিনিও। তবে মূল চরিত্রে নয়। তাছাড়া পুরোপুরি আত্মজীবনীই সিনেমার গল্প নয়। কিছু কল্পনাও থাকবে। এখন এই সিনেমা নিয়েই ব্যস্ত সময় যাচ্ছে তাঁর।
প্রচারের এ যুগে এসেও তাঁর নেই কোনো ফেসবুক-টুইটার একাউন্ট, নেই স্মার্টফোনও। নেই ক্রেডিট কার্ড- ডেবিট কার্ড। যে মোবাইল তিনি চালান, তা দিয়ে শুধু কল আসে ও কল দেয়া যায়। মোবাইলকে মজা করে ডাকেন 'হারাধন'। সস্তা প্রচারে বিশ্বাসী নন। চোখে সানগ্লাস দিয়ে, শার্টের বোতাম খুলে, ভেতরের কালো স্যান্ডো গেঞ্জি দেখিয়ে এখনো হাঁটতে পারেন, সস্তার বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে। নচিকেতার ব্রাণ্ড লাগবে কেন, তিনি নিজেই তো ব্রাণ্ড!
যদিও নিজের নামের পাশে অসাধারণ সব গান আছে তাঁর, তবুও বর্তমানে যে গানগুলো তিনি গাচ্ছেন, সেগুলোর সাথে আগের নচিকেতার গান মেলাতে কষ্ট হয়। দু'টি মানুষ যে একই, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। গলার সেই নিখুঁত আওয়াজটিও নেই। তবু ড্যামকেয়ার নচিকেতা। 'কেয়ার অব ফুটপাত' যে নচিকেতা, তিনি নিজেই বলেন-
আমার ভালো লাগে তাই আমি গাই। আমার দরকার ছিলো, তাই আমি গেয়েছি। আমি কারো কথা ভেবে গাইনি। আমি চাইলে অনেক কিছুই হতে পারতাম। কিন্তু আমি চাইনি। আমি ভবঘুরে হবো, এটাই আমার অ্যাম্বিশন। আমি গাধাদের রাজা হতে চাই নি। সিংহদের রাজা হতে চেয়েছিলাম। পেরেছি কী না, সে সবাই জানে। আমি আর কী বলবো! তবে জীবনের শুরুতে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়েছি, যে সংঘর্ষ এখনো আছে, এ সংঘর্ষ চলবেই। চিতায় ওঠার আগপর্যন্তই চলবে। সফল হলাম কী হলাম না, সেটা মূখ্য না। সংঘর্ষ চালিয়ে যাওয়াই মূখ্য। যেদিন সংঘর্ষ শেষ হবে, মাটির কাছে ফিরে যাবো, যেখান থেকে এসেছিলাম। এটাই তো জীবন!
এভাবেই সোজাসাপটা কথাবার্তায় অদ্বিতীয় নচিকেতা, যিনি রাখঢাকে বিশ্বাসী নন। যা বলার দরকার, তা তিনি আগেও বলে এসেছেন। এখনো বলছেন। রেয়াত করছেন না কাউকেই। করার দরকারও দেখেননা তিনি। নাইন্টিজের কিশোর-কিশোরীদের'কে দেখিয়েছিলেন অন্যরকম এক গানের জগৎ। যে গান নিয়ে, যে গানের স্রষ্টাকে নিয়ে আজও বহু আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্কে হয়। তবে যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, তিনি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেন না, অন্ধের দেশে একমনেই তিনি চশমা বিক্রি করে যাচ্ছেন, সেটাতেই তাঁর তৃপ্তি।
আজ নচিকেতার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, বাউন্ডুলে আগুনপাখি। গানের সুরে বিক্ষোভ আর প্রতিবাদ চলুক সামনেও।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন