নাঙ্গেলি- যিনি ভোগ্যপণ্য নন, মানুষ হতে চেয়েছিলেন
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
২১৭ বছর আগে এক অদ্ভুত-বর্বর কর আরোপ করা হয়েছিল নিম্নবর্ণের নারীদের উপর। তারা তাদের স্তন ঢেকে রাখতে পারবেন না, রাখতে হলে কর দিতে হবে! তারপরই নাঙ্গেলির সেই অবিশ্বাস্য প্রতিরোধ...
সময়ের হিসাব করলে, এই গল্পটি ২১৭ বছর আগের! ১৮০৩ সাল। ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যের ত্রিভাঙ্কুরের (এখনকার কেরালা ও তামিলনাড়ুর কিছু অংশ) রাজা অদ্ভুত অদ্ভুত সব করের প্রচলন শুরু করেছেন। এই করগুলো মূলত নিম্নবর্ণের মানুষ এবং শ্রমজীবি মানুষদের উপর আরোপ করতো রাজা। এই মানুষগুলোর উপর জুলুম করে জোরপূর্বক কর আদায় করে নিজেরা করতেন সম্পদের পাহাড়।
অলঙ্কার পরিধানের উপর কর আরোপিত ছিল। কেউ যদি অলঙ্কার পরে, এর জন্যে তাকে কর দিতে হবে। পুরুষদের মধ্যে যদি কেউ গোঁফ রাখতে চাইতো, তাকে তার গোঁফের জন্য কর দিতে হতো। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত এবং বর্বর কর আরোপ করা হয়েছিল তখনকার নিম্নবর্ণের নারীদের উপর। নিয়ম ছিল, নারীদের কেউই তাদের স্তন ঢেকে রাখতে পারবেন না। অনাবৃত করে রাখতে হবে।
শুধু ব্রাহ্মণ নারীদের অনুমতি ছিলো, এক টুকরা সাদা কাপড়ে তারা স্তন ঢাকতে পারতো। কিন্তু, বাকিরা পারতো না। আইন ছিলো এরকম যে তাদের স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হবে। তাদের বলা হয়েছে, তারা যদি সমাজের অন্যদের মতো সম্মানজনকভাবে থাকতে চায়, তাহলে তাদেরকে স্তনের মাপে কর দিতে হবে। করের বিনিময়ে স্তন ঢাকতে পারবে তারা। এই বর্বর ও ঘৃণিত করটির নাম ছিলো 'স্তনশুল্ক'(Breast Tax), স্থানীয় ভাষায় যা পরিচিত ছিলো ‘মুলাক্করম’ (Mulakkaram) নামে।
স্তনশুল্ক বা মুলাক্করম থেকে প্রাপ্ত করের বড় অংশই চলে যেত ত্রিভাঙ্কুরের রাজার পদ্মনাভ মন্দিরে। জেনে হয়ত অবাক হবেন, গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের হিসেবে এই মন্দিরটিই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মন্দির। যে মন্দিরে মিশে আছে দলিত সম্প্রদায়, নিম্নবর্ণ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, শ্রমজীবি মানুষদের মেহনতের টাকা, তাদের উপর আরোপিত বর্বরোচিত করের দীর্ঘশ্বাস।
কিন্তু, প্রতিটি বর্বরতার একসময় অবসান হয়। দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন অনেকেই হয়ত মেনেই নেয় এসব প্রথা, নিয়তির অংশ হিসেবে। কিন্তু কেউ কেউ থাকে এমন যারা ভাবে হারানোর আর কী বাকি আছে! রুখে দাঁড়াও এবার। তেমনি এক নারী রুখে দাঁড়ালেন এই স্তনশুল্কের বিরুদ্ধে।
আলাপুঝার এঝাওয়া সম্প্রদায়ের নারী নাঙ্গেলি। ৩৫ বছর বয়সের নাঙ্গেলি দেখতে ছিলেন অসাধারণ। ঈশ্বরপ্রদত্ত সৌন্দর্য কখনো অভিশাপ হতে পারে না, হয়তো এমন বিশ্বাস ছিল তার। কিন্তু, বাস্তবতা ও বর্বরতা যে তখন অন্য কথা বলছে। মেয়েদের কাছে নিজের সৌন্দর্য হয়ে দাঁড়ালো অভিশাপ। রাজাদের কথার উপরে কথাও বলা যায় না। তাই মনের বিরুদ্ধে তাদের নারীসুলভ সকল প্রকার মান সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হতো!
এই প্রথা কি শুধু বাড়তি কর আদায়ের জন্যেই শুরু হয়েছিলো? অবশ্যই না। নারীদেহকে পণ্য ভাবার, ভোগের বিষয়বস্তু চিন্তা করার যে সাইকোলজি একটা শ্রেণী গড়ে তুলেছে এখন, এই শ্রেণীর পূর্বসূরী ছিলো সে রাজারাই। জাত, ধর্ম, বর্ণ সব জায়গাতেই এই একটি বিশেষ শ্রেণীর অস্তিত্ব দেখতে পাই।
নাঙ্গেলি বিদ্রোহ করলেন। রাজার করকে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে তিনি তার মতো থাকলেন। স্তন উন্মুক্ত রাখার ব্যাপারটি তার কাছে অসুস্থ চর্চা মনে হয়। কিন্তু, নাঙ্গেলি যিনি একজন দরিদ্র নারী, জীবিকার তাগিদে তাকে ঘরের বাইরে যেতে হতো। বাইরে যখন যেতেন, তখন স্তন উন্মুক্ত না রাখার অপরাধ এবং আবৃত রাখার কর মিলিয়ে তার মুলাক্করম দিনে দিনে অনেক জমে গেলো। কিন্তু তাতে তিনি খুব একটা চিন্তিত না।
এদিকে রাজার লোকজন করের টাকা আদায়ের জন্য বের হয়। তারা খুব তাগাদা দিতে থাকে, হুমকি ধামকি দিতে থাকে। করের টাকা অমান্য করার ঘটনা খুব একটা যে ইতিহাসে নেই। নাঙ্গেলি স্তনকর সংগ্রাহকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু তিনি তো এই আইনই মানেন না। কর দিবেন কেন? কিন্তু একদিন তিনি অত্যাচারে টিকতে না পেরে ঠিক করলেন কর দিবেন। অপেক্ষা করতে বললেন ঘরের বাইরে, কর নেওয়ার লোকদের।
তিনি ঘরে গিয়ে মেঝেতে একটা কলাপাতা বিছিয়ে প্রদীপ জ্বালালেন। গৃহদেবতার সামনে আপনমনে প্রার্থনা করলেন। প্রার্থনা শেষ করে ধারালো এক অস্ত্র দিয়ে নিজের দুইটি স্তন কেটে ফেললেন নাঙ্গেলি। কাঁটা স্তন কলাপাতায় মুড়ে নিয়ে স্তনকর সংগ্রাহকের হাতে তুলে দিলেন! কাঁটা স্তন দেখে রাজার লোকেরা একই সাথে হতবাক হয় ও ভয় পেয়ে যায়। কতটা দৃঢ়চেতা হলে একজন নারী প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এমন কাজ করে ফেলতে পারেন!
নাঙ্গেলি নিজের নারীত্ব অভিশাপ হয়ে বেঁচে থাকুক সেটা চাননি। তিনি বর্ণপ্রথা মানতে চাননি। তিনি চাননি, ভোগ্যপণ্যের মতো তার শরীরের উপর কর আরোপিত হোক। স্তন কাঁটার পর নাঙ্গেলির ভীষণ রক্তপাত হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুবরণ করেন নাঙ্গেলি। নাঙ্গেলির মৃত্যুতে পাগলের মতো হয়ে যায় তার স্বামী। স্ত্রীর শেষকৃত্যের দিনে চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
এই ঘটনায় সবাই ফুঁসে উঠে। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। অবশেষে রাজা রহিত করতে বাধ্য হয় বর্বর সেই স্তনকর প্রথা। নাঙ্গেলির এই আত্মদানের ইতিহাস নিজের ক্যানভাসে তুলে এনেছেন কান্নরভিত্তিক চিত্রকর টি মুরালি। তবে তার ছবিটি আঁকার জন্যে মুরালিকে সমালোচিতও হতে হয়। অনেক ব্রাহ্মণবাদী মুরালির সমালোচনা করেন।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি হচ্ছে খোদ হিন্দু পুরোহিতরাই বলে যে, নিচু বর্ণের নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্ম বিরোধী। নাঙ্গেলির মৃত্যুতে স্তনকর রহিত হলেও শরীর আবৃত অনাবৃত রাখা না রাখা নিয়ে অনেক ঘটনার জন্ম হয় ভারতবর্ষে। এমনকি ১৮৫৯ সালে এই বিষয়টি নিয়ে দক্ষিণ ভারতে একটি দাঙ্গাও সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গাটি 'কাপড়ের দাঙ্গা' হিসেবে পরিচিত। দাঙ্গার বিষয় ছিল, নারীদের শরীর আবৃত রাখার অধিকার। যে অধিকারের জন্যে দাঙ্গার অনেক বছর আগেই প্রথমবারের মতো প্রাণ দিয়েছিলেন এক হতভাগ্য নারী নাঙ্গেলি!