এখনকার কন্টেন্টময় পৃথিবীতে জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ডিয়ার এলিন আর নাস ডেইলির নাম শোনেননি এরকম খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে! নাস এবং এলিন, এই প্রেমিকযুগলের ট্রাভেলিং ভিডিও দেখেই তাঁদের সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। দুজনই আলাদাভাবে কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, তাঁদের সম্মিলিত কাজও রয়েছে অনেক। বেশ ইনফরমেটিভ কন্টেন্টই রয়েছে তাঁদের ঝুলিতে। তবে কিছুদিন আগে এলিনের একটি ভিডিও দেখে আমি এলিনের ভক্ত হয়ে যাই! সাধারণত এলিন ট্রাভেলিং ও অন্যান্য ইনফরমেটিভ ইস্যু নিয়েই ভিডিও বানায়। কিন্তু এই ভিডিওটি ছিল এলিনের সাথেই ঘটে যাওয়া এক বিব্রতকর ঘটনার বিষয়বস্তু নিয়ে।

ভিডিওতে দেখা যায়, এলিন তার সাথে ঘটে যাওয়া সাময়িক এক ঘটনার প্রেক্ষিতে নারীদের সম্পর্কে পুরুষ সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতার বিরুদ্ধে কথা বলেন। এলিনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির বিস্তারিত বিষয় উল্লেখ করলে হয়তো আপনার কাছে ব্যাপারটি আরেকটু খোলাসা হবে। তবে তার আগে একই ঘটনা নিয়ে নাস ডেইলির বানানো ভিডিও নিয়েও খানিকটা কথা বলতে হয়। ভাবছেন, একই ঘটনা নিয়ে এলিন-নাস দুজনই ভিডিও ক্রিয়েট করলো? হ্যাঁ, কারণ ঘটনাটি প্রকৃতপক্ষে দুজনের সাথেই ঘটেছে। একটি টিভি শো এর মাধ্যমে। তাহলে চলুন জেনে আসা যাক কী এমন ঘটনা ঘটলো তাদের সাথে! 

আলবেনিয়ার এক টিভি শো-তে নাস আর এলিনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এলিনের ভাষ্যমতে, শো'র শুরু থেকেই শো-হোস্ট নাসের সাথে কুরুচিপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে যাচ্ছিল। বিপত্তিটা ঘটে যখন হোস্ট একজন ফিমেল হোস্টকে স্টেজে নিয়ে আসে এবং তাকে নিয়ে নাসের সাথে আপত্তিকর মন্তব্য করতে শুরু করে! ফিমেল হোস্ট নাসদের পাশে এসে দাঁড়ানোর পরই শুরু হয় হোস্টের অশালীন ইংগিতপূর্ণ কথা।

আমি একটু খোলাসা করেই বলছি৷ ফিমেল হোস্টকে নিয়ে মেল হোস্টের ইন্ট্রোডাকশন ছিল খানিকটা এরকম- Let me introduce you to our special host. Nas, you don't turn around, because, other than her eyes, you'll see a couple of other eyes. (ফিমেল কো-হোস্টের ব্রেস্টের দিকে ইংগিত করে) নাস বিষয়টিতে বিব্রত হলেও হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। তার কিছুক্ষণ পর আরেকটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যখন মেল হোস্ট ফিমেল হোস্টকে দিয়ে নাসের উদ্দেশ্যে উদ্ভট এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করায়।

নারী হোস্টটিকে নিয়ে বিভিন্ন অশালীন ইঙ্গিত করে পুরুষ হোস্ট

প্রশ্নটি ছিল- 'When you visit various places, do you meet other girls?' (প্রশ্নটি ফিমেল হোস্ট করতে চাননি, তাকে জোর করে করানো হয়েছে, যা এলিন তাঁর ভিডিওতে উক্ত টিভি শো এর বিহাইন্ড দ্য সিন এর ফুটেজ প্রকাশ করার মাধ্যমে দেখিয়েছেন)। প্রশ্নটি করা হয়েছিল আলবেনিয়ার আঞ্চলিক ভাষায়, যা এলিন প্রথমে বুঝতে পারেননি। তাই তিনি নাসকে জিজ্ঞেস করেন যে কী প্রশ্ন করা হয়েছে। নাস এলিনকে ট্রান্সলেট করে প্রশ্নটি বলার পর এলিনের কাছে ভীষণ বিরক্তিকর আর আপত্তিকর মনে হয় বিষয়টি। এলিন ফিমেল সোসাইটির জন্য, উইমেন রাইটসের জন্য কাজ করেন। তাঁর চোখের সামনে নারীদেরকে অপদস্ত করা হচ্ছে, তাঁর কাছে বিরক্তিকর লাগবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি।

এলিন নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে হোস্টকে কড়া কিছু কথা শোনান। তখন হোস্ট ব্যাপারটি হেসে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য বারবার বলে যায়, 'This is funny!' হোস্টের এরুপ ব্যবহার দেখে এলিন রাগে ফেটে পড়েন এবং হোস্টকে উদ্দেশ্য করে আলবেনিয়ার পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উপর কটু কথা বলা শুরু করেন। কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি কান্না করে দেন এবং বলেন, 'That's not ok, I'm so sick of the world that has stuff like this, disrespecting women.' ভাবুন তো, মানুষ কতোটা অপমানিত বোধ করলে লাইভ টিভি শো-তে কান্নায় ভেঙে পড়ে! এমনকি এই বিষয়ক এলিনের করা ভিডিওতে ঘটনা সম্পর্কিত কথা বলতে গিয়েও এলিনের চোখে পানি চলে আসে।

নিজের ভিডিওতে এ সম্পর্কিত কথা বলতে গিয়েও কেঁদে ফেলেন এলিন

যা হোক, ঘটনা থেকে এখন ভিডিওর প্রসঙ্গে আসা যাক! প্রথমেই বলি এলিনের ভিডিওর বিষয়বস্তু নিয়ে। এলিন তাঁর ভিডিওতে ঘটনার নিন্দা তো করেছেনই, পাশাপাশি তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন জেনারালাইজড হয়ে আলবেনিয়ার পুরো কমিউনিটির উপর দোষ চাপিয়ে কথা বলার জন্য। সেই সাথে এও উল্লেখ করেন, সেক্সুয়্যালিটি নিয়ে বাজে জোক করা কখনোই কুল না, এটেনশন পাওয়ার জন্য ফিমেল ডিসরেস্পেক্টিং কখনোই ভালো কাজ না।

এবার আসি নাসের ভিডিওর বিষয়বস্তু নিয়ে। নাস তাঁর ভিডিওতে পরিস্কার করে বলেছেন, 'গাই টক' কখনোই গ্রহনযোগ্য হওয়া উচিত নয়। অনেকেই হয়তো ভাবছেন 'গাই টক' আবার কী? 'গাই টক' হলো মেল কমিউনিটির মধ্যে যেসব ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়, সাধারণত নারীদের নিয়ে, সেক্সুয়্যালিটি নিয়ে, ডার্টি জোক্স, এমনকি স্পোর্টসও হতে পারে! যদিও একে 'গাই টক' নামকরণ কেন করা হলো, এই বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত আছে, তবে সেদিকে আজ আর না যাই। টিভি শো-তে মেল হোস্ট যে এপ্রোচে নাসের সাথে কথা বলেছে, তা গাই টক হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। 

ভিডিও দুটি দেখার পর আমি আবিষ্কার করলাম, আমার আশেপাশে তো প্রতিদিনই অনেকেই 'গাই টক' করে! এমনকি ব্যাপারটা এতো বেশি স্প্রেড হয়েছে, শুধু দু-তিনজন ছেলে বন্ধুদের আড্ডার মাঝেই যে নারী-প্রসঙ্গ আসে, তা নয়। নারীদের সামনেও একইভাবে এরকমটা হয়ে চলছে। এখন আপনি বলতেই পারেন যে নারীদের নিয়ে কী কথাও বলা যাবে না নাকি! কিন্তু কথা হলো, ব্যাপারটি 'নারীদের নিয়ে কথা' না, বরং নারীদের অবজেক্ট হিসেবে তুলে ধরে কথা বলা।

নাসের সাথে সে হোস্টটি 'গাই টক' এ কথা বলছিল

একটা উদাহরণ দেয়া যাক। কিছু তথাকথিত 'কুল' ছেলেদের সার্কেলে একটা আলাদা টপিকই থাকে মেয়ে সম্পর্কিত। 'ঐ মেয়েটা কিন্তু সেই **' কিংবা মেয়েদেরকে তুচ্ছ করে কোনো কথা, যেমন- 'আরে বুঝস না মাইয়া মানুষ তো!' এসব কথা শোনেননি এরকম মানুষ পাওয়াও বুঝি দুস্কর!

এখন আপনারা বলতেই পারেন, আমাদের নিজেদের মধ্যকার ব্যাপার, আমরা যা ইচ্ছা আলোচনা করতেই পারি। হ্যাঁ, অবশ্যই পারেন। কিন্তু এসব আলোচনা করেই যে মানসিকভাবে ভেতর থেকে নিজের অজান্তেই আপনি নারীদের অসম্মান করে আসছেন, তার বাস্তব প্রয়োগ তো প্রতিদিনকার খবরেই পাওয়া যায়। এমনকি বাইরের দিক থেকে খুব জেন্টেলম্যান ভাব রেখেও, নারীদের সম্মান করার বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়েও শুধুমাত্র এই গাই টকের কারণেও আপনার ভেতর থেকেই অটো ফিমেল ডিসরেস্পেক্ট চলে আসে, যা হয়তো আপনি নিজেও টের পাবেন না। 

আর এখন তো নারীদের সামনেও সমানতালে গাই টক হয়ে আসছে৷ আপনি যখন আপনার মেয়ে বন্ধুর সামনে কোনো মেয়েকে অসম্মান করে বা নারী  জাতি নিয়ে কটূক্তি করেন, আপনার হয়তো মনে হতে পারে ব্যাপারটা ক্যাজুয়াল, কিন্তু আপনার মেয়ে বন্ধুটি যে মনে মনে মেয়ে হিসেবে ডিসরেস্পেক্ট অনুভব করে, তার ইন্সাল্টিং লাগে, তা বন্ধুত্বের খাতিরে হয়তো বলে না। কিন্তু তার ভেতরে ইনফেরিওরিটি কাজ করতেই পারে।

নাসের ভিডিওটিতে নাস একটা লাইন বলেন, 'When guy talk is ok in private, slowly but surely, it becomes ok in public.' অর্থাৎ আপনি হয়তোবা নারীদের সামনে ডিসরেস্পেক্টিং কথা, সেক্সিষ্ট জোক্স, নারীদের অব্জেক্টিফাই করে কিছু বলেন না (তবে এখন প্রায় সবাই বলে) কিন্তু আপনি আপনার বন্ধু মহলে যে বলছেন, কিংবা শুনছেন, এতেও আপনার সমান অপরাধ। 

'গাই টক' কুল আর সাধারণ কিছু না, এটা সবার পরিহার করা উচিত। হতাশার বিষয় হলো এই ব্যাপারটা আমাদের সমাজে এতো বেশি প্রচলিত, তাই এটাকে কেউ কোনো ইস্যু হিসেবেই হয়তো দেখবে না। তবে এলিন এর ভিডিও প্রেক্ষিতে শুধু গাই টক নিয়েই কথা বলা হয়েছে, একই বিষয় কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মেয়েদেরও ছেলেদের উদ্দেশ্য করে, ডিসরেস্পেক্ট করে, সেক্সিষ্ট জোক করা উচিত নয়। দুটো বিষয়ই সমানভাবে অন্যায়। যদিও আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের পক্ষ থেকে ব্যাপারটা খুব কমই হয়ে আসছে।

এলিনের একটি উক্তি দিয়েই শেষ করি- 'Using sexism to get attention is not ok. Sexist jokes are not funny. Disrespecting women is not ok.' 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা