মেডিকেল সায়েন্সে 'নিয়ার ডেথ এক্সিপিরিয়েন্স'-এর অনেকগুলো রিপোর্ট পাওয়া যায়, যেখানে মৃত্যু-দুয়ার থেকে ফিরে আসা কোনো কোনো মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। ঠিক কী হয়েছিলো সেই সময়টায়? কেমন ছিল মৃত্যুর পরবর্তী অভিজ্ঞতা?
মানুষটা মরে গেলো। ডাক্তার সাহেব টিপে টুপে দেখলেন, রোগীর সব বন্ধ। কোনো ছিদ্র দিয়েই আর বাতাস বের হয় না। তিনি একটা ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে বললেন, "হায়াত-মওত সব উপরওয়ালা'র হাতে..." রোগীর আত্মীয় স্বজন বিশেষ করে বাড়ির যত মহিলা তারা বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করলেন। এই কান্না থামার কোনো লক্ষণ নাই।
যাকে মারা গিয়েছে ধরে সবাই চিৎকার করে কাঁদছে সে চিৎকার চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়ে গেলো। হুট করে আন্ডারটেকারের মতো চোখ খুলে পিট পিট করে তাকালো চারপাশে। দেখলো, সবচেয়ে বেশি আহাজারি করছে, তার চার মাস বয়সী নতুন বউটা। অথচ, এই বউয়ের জ্বালায় বেঁচে থাকাটা কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল! বউ তো না, যেন ট্রাফিক পুলিশ! জীবনের সব মোড়ে মোড়ে থামিয়ে বাঁধা না দিলে চলতো না তার। আর টিকতে না পেরে লোকটা বিছানা থেকে উঠেই বললো, কী সমস্যা, এত কান্নার কী হলো! কেউ কি মরসে নাকি? কান্না বন্ধ করে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও।
উপরের অংশটুকু একটা দারুণ গল্পের ভালো শুরু হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পাঠককে ধরে রাখার জন্য, খানিকটা বিনোদন দেওয়ার জন্য বেশ ভালো একটি ইন্ট্রো। কিন্তু বাস্তবতা গল্পের চেয়েও অদ্ভুত, বড্ড বেশি কঠিন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, কিছু মানুষ ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরও সত্যি সত্যি জীবন ফিরে পেয়েছেন!
মেডিক্যাল সাইন্সে এরকম 'নিয়ার ডেথ এক্সিপিরিয়েন্স'-এর অনেকগুলো রিপোর্ট পাওয়া যায়, যেখানে মৃত্যু-দুয়ার থেকে ফিরে আসা কোনো কোনো মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। ঠিক কী হয়েছিলো সেই সময়টায়? কী দেখেছেন তিনি, এই বিষয়গুলোই মূলত তারা জানিয়েছেন।
২০১২ সালে টটেনহাম হটস্পারের বিরুদ্ধে একটি খেলায় বোল্টন ওয়ান্ডারার্সের মিডফিল্ডার ফেব্রিক মুয়াম্বা হঠাৎ করেই মাঠের মধ্যে লুটিয়ে পড়েন। হার্ট এট্যাক হওয়ার ফলেই এমনটি হয়। তাকে ক্লিনিক্যালি ডেডও ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ মুহূর্ত ধরে তার শরীরে কোনো সাড়া পাওয়া যায় নি। যখন সবাই শোকাহত মুয়াম্বা মারা গিয়েছে ভেবে, তখন হুট করেই সে জীবন ফিরে পায়। অলৌকিক এই ঘটনা কীভাবে ঘটেছে, সেটা এক রহস্য। তবে মুয়াম্বাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তার মৃত্যুর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, তার একটি পরাবাস্তব অনুভূতি হয়েছিল। তিনি কি বাস্তবে আছেন নাকি কল্পনায়, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। যদিও তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি প্রাণপণে দৌড়াচ্ছেন- তবে তা নিজের দেহে নয়! অন্য কারো শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে দৌড়াচ্ছিলেন! এছাড়া চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে তিনি টটেনহামের দুইজন খেলোয়াড়কেও দেখতে পেয়েছিলেন! তবে, কোনো প্রকার শারীরিক যন্ত্রণা তিনি টের পাননি।
এইরকম নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্সের সবচেয়ে পুরানো একটি মেডিক্যাল বর্ননা পাওয়া যায় ১৮'শ শতকের। সেখানে একজন ফ্রেঞ্চ নাগরিকের কথা উল্লেখ আছে, যার শরীর অচেতন এবং অনুভূতিশূন্য হয়ে গিয়েছিল অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। যখন আবার তার চেতনা ফিরে আসে, তিনি জানান- তিনি এমন তীব্র আলোর দেখা পেয়েছিলেন, যা সে আগে কখনো তার জীবদ্দশায় দেখেননি, যা দেখে তার মনে হয়েছিলো তিনি স্বর্গে এসে পড়েছেন। মৃত বলে ঘোষিত হওয়ার পরও জীবন ফিরে পাওয়া এই সৌভাগ্যবানদের বিভিন্ন ধরণের অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। মৃত্যু-জীবনের মাঝের সময়টায় তারা যে অনুভূতিগুলো টের পান, তার কিছু কিছু বর্ণনা দেয়া যেতে পারে-
১. তীব্র ঝাঁঝালো আলো: যারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার পর ফিরে আসে তাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই এই অনুভূতির কথা জানিয়েছে। তারা একটি সুড়ঙ্গ দেখতে পায় যার শেষমাথায় তীব্র আলো হাতছানি দিয়ে ডাকে।
২. অভিভাবকসুলভ এঞ্জেল: কিছু মানুষ তাদের অভিজ্ঞতায় বলেছেন, তারা যখন টেকনিক্যালি ডেডন ঠিক ওই মুহুর্তে এঞ্জেল কিংবা পরীর মতো দেখতে আত্মারা আসে, তারা মৃত মানুষটার সেবা যত্ন নেয়। মৃত্যুর পর যে ট্রান্সফর্মেশন ঘটে শরীরে, তারা সেটি ঘটাতে সাহায্য করে।
৩. মৃত আত্মীয়: অনেকেই মৃত্যুপরবর্তী সময়টায় তাদের বড় পরিবারের সকল সদস্যের একে একে দেখতে পায়। কেউ কেউ দাবি করে, ইতিপূর্বে তার পরিবারের যে মানুষগুলো মারা গিয়েছিল, তাদের দেখা পেয়েছে এবং তারা তাকে স্বাগতম জানাচ্ছে।
৪. পুনর্জন্ম: কেউ কেউ তাদের অভিজ্ঞতায় জানিয়েছে, মৃত্যু পরবর্তীতে নিজেদেরকে সেই অবস্থায়ই আবিষ্কার করেছিল যেন সে তার আগের জীবনের মধ্যেই আছে। অর্থাৎ, আমরা যে পুনর্জন্ম নিয়ে কথা বলি, অনেকটা সেরকম।
৫. ফিরে আসতে অনিচ্ছুক: অনেকে তাদের মৃত্যু অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে ওই মুহুর্তকে তাদের খুব শান্ত এবং একটি অন্যরকম প্রশান্তির ব্যাপার মনে হয়েছে, যা আগে কখনো অনুভব হয়নি। এই প্রশান্তিটা এতটাই শক্তিশালী মনে হয়েছে যে তারা সেটি ছেড়ে আবার জীবনের মাঝে ফিরে আসতে চাননি।
৬. সব কিছু দেখতে পাওয়া ও শুনতে পাওয়া: অনেকেই জানান, তারা যখন ক্লিনিক্যালি ডেড হলেন, আশেপাশে কী হচ্ছে সেটি বুঝতে পারেন। রুমের মধ্যে মানুষের আনাগোনা দেখতে পান, তারা কি বলছে সেটিও শুনতে পান। নিজের শরীর যে অচেতন এটিও তারা বুঝতে পারেন, ফলে সব বুঝে শুনেও রুমে থাকা মানুষের সাথে কোনো ইন্টারেকশন করা সম্ভব হয় না তাদের।
* মৃত্যু একটি আজন্ম রহস্য। আসলেই মৃত্যুর পর কি হয় সেটি আক্ষরিক অর্থেই বর্ণনা দেয়া কোনো মানবের পক্ষে সম্ভব কি না, কে জানে! তবুও অলৌকিক ঘটনা যে একেবারেই ঘটে না, তা নয়। পৃথিবী অপার রহস্য নিয়ে আমাদের ঘিরে রেখেছে। সেসব রহস্যের কতটুকুই বা আমাদের জানা! মৃত্যু কিংবা আফটার লাইফ নিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা করে চলেছে, মেডিক্যাল সাইন্সও এটি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সুন্দর কোনো ব্যাখ্যাও চলে আসবে। তখন কি মানবজাতি মৃত্যুরহস্যের সমাধান করে ফেলবে পুরোপুরি? সেটা সময়ই বলে দেবে। ততদিন পর্যন্ত মৃত্যুজয়ী কিছু ভাগ্যবানের এসব অভিজ্ঞতা আমাদের মৃত্যুপরবর্তী ভাবনাকে আরো রহস্যের মধ্যে ডুবিয়ে রাখুক। আমরা যে বড্ড রহস্যপ্রেমী!
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, পিপল হু ডাইড এন্ড ক্যাম ব্যাক