ভালো অভিনেত্রী অনেকেই হতে পারে, কিন্ত স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে মনের কথা শুনে বেঁচে থাকতে পারে ক’জন? এই জায়গাটাতেই নীনা গুপ্তা অনন্য, অনুকরণীয় আদর্শ বললেও ভুল হবে না বোধহয়।

২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বাধাই হো’ সিনেমাটা দেখেননি, এমন সিনেমাপ্রেমী বোধহয় পাওয়া যাবে না খুব একটা। প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে থাকা এক দম্পতি আচমকা যখন শুনলেন, তারা আবার সন্তানের জন্ম দিতে চলেছেন- সমাজ, সংসার আর পারিপার্শ্বিক জীবনে এই একটা ঘটনা কতটা প্রভাব ফেলে, সেটাই হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছিল সিনেমায়। প্রথা ভাঙা একটা চরিত্রে অভিনয় করে ফিল্মফেয়ারে পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন নীনা গুপ্তা।

সিনেমার চরিত্রের মতো নিজের জীবনটাও নীনা গুপ্তা কাটিয়েছেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থেকে, সমাজ-সংসারের ভ্রান্ত নিয়মগুলোকে বুড়া আঙুল দেখিয়ে। দিল্লির এক রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের জীবনটা বদলে গিয়েছিল ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় গিয়ে, সেখান থেকে মুম্বাই যাত্রা, সিনেমায় নাম লেখানো, তারকাখ্যাতি পাওয়া- গল্পটা অনেক দীর্ঘ।

এর বাইরেও নিজের ব্যক্তিগত জীবনটাকে বরাবরই খোলা ডায়েরীর মতো রেখেছেন নীনা গুপ্তা। ক্যারিবীয়ান ক্রিকেট কিংবদন্তী ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে তার সম্পর্ক বা লিভ টুগেদার নিয়ে মুখরোচক আলোচনা হয়েছে, রক্ষণশীল ভারতীয় সমাজ তার সমালোচনায় মত্ত হয়েছে, কিন্ত নীনা সেসবের জবাবই দিতে যাননি কখনও, নিজের কাজটা করে গেছেন একমনে, কারো চাপে পড়ে জীবনটাকে বদলানোর চেষ্টা করেননি তিনি।

ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে

বাড়িতে পড়ালেখার চল ছিল, পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষিত, নীনাকেও তাই হাঁটতে হয়েছে সেই পথে। কিন্ত সিনেমা দেখতে দেখতে বড় হওয়া মেয়েটার মাথায় অভিনয়ের ঝোঁক ছিল বরাবরই। নার্গিসের অন্ধভক্ত ছিলেন, জয়া কিংবা রেখাদের কাজও মুগ্ধ করেছিল তাকে। আর তার জেরেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আবেদন করলেন দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায়। সুযোগ পেয়েও গেলেন, শুরু হলো অভিনয়যাত্রা।

১৯৮২ সালটা নীনার জীবনে খুব স্পেশাল। একটা-দুইটা নয়, ছয় ছয়টা সিনেমায় নাম লেখালেন তিনি। সবার আগে মুক্তি পেলো ‘সাথ সাথ’ নামের সিনেমাটা, তবে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারলো না সেটা। সেবছরই মুক্তি পাওয়া ‘গান্ধী’ প্রশংসিত হলো, স্ততির বৃষ্টিতে ভিজলেন নীনা নিজেও। এরপর মির্জা গালিব’, ‘ইন কাস্টডি’, ‘মাণ্ডি’, ‘সুরজ কা সাতওয়া ঘোড়া’, ‘দৃষ্টি’ ‘জানে ভি না দো ইয়ারো’ বা ‘খলনায়ক’-এর মতো ছবিতে নাম লিখিয়েছেন তিনি, ১৯৯২ সালে ‘ওহ ছোকরি’ সিনেমায় অভিনয় করে জিতেছেন ভারতের সবচেয়ে সম্মানজনক ‘ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড’। আর গতবছর তো ‘বাধাই হো’ সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয় করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। আশির দশকে টেলিভিশনেও পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি, সেখানেও এসেছে সাফল্য।

জীবনে বেশ কয়েকদফা সম্পর্কে জড়িয়েছেন নীনা, এবং কোনবারই লুকোছাপার আশ্রয় নিতে দেখা যায়নি তাকে। অভিনেতা অলোক নাথের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল একটা সময়ে, পণ্ডিত যশরাজের ছেলের সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন, সেটা এঙ্গেজমেন্ট অবদি গড়িয়েছিল, কিন্ত পরিণয়ে গড়ায়নি সম্পর্কটা। ১৯৮৮ সালে ক্যারিবীয়ান ক্রিকেটার ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে পরিচয়, সেই সম্পর্ক গড়িয়েছিল বহুদূর। ১৯৮৯ সালে নীনার কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিল ভিভ-নীনা জুটির একমাত্র মেয়ে মাসাবা, যদিও দুজনের সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত যায়নি, এবং সেটা স্বীকারের সৎ সাহস নীনা বরাবরই দেখিয়েছেন।

ভিভ-নীনার মেয়ে মাসাবা

আশির দশকের কথা বলছি, সেই সময়ের রক্ষণশীল সমাজে একা একজন নারীর টিকে থাকাটাই ছিল ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ। সেখানে নীনা গুপ্তা সিঙ্গেল মাদার হিসেবেই লড়াই করেছেন। একটা সময়ে মুম্বাইতে বাড়িভাড়া দেয়া হতো না তাকে, লোকজন ‘চরিত্রহীন মহিলা’ হিসেবে ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছিল তাকে। নীনা সেসবে দমে যাননি, সম্পর্ক নিয়ে লুকোচুরি খেলার কথা ভাবেননি, তিনি বরাবরই নিজের স্বাধীনচেতা মনোভাবটা পুষে রেখেছেন বুকের ভেতরে।

উনপঞ্চাশ বছর বয়সে গিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসেছেন, যখন একাকীত্ব তাকে ঘিরে ধরেছে, মনে হয়েছে জীবনে একজন সঙ্গী দরকার, তখন বেছে নিয়েছেন নিজের জীবনসঙ্গীকে। সমাজ কী বলবে, লোকে কী ভাববে- এসব বাজে চিন্তাকে নীনা কখনও মনে প্রশ্রয় দেননি, এই জায়গাটায় নীনা গুপ্তার কাছে শেখার আছে অনেক কিছুই। ভালো অভিনেত্রী অনেকেই হতে পারে, কিন্ত স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে মনের কথা শুনে বেঁচে থাকতে পারে ক’জন? এই জায়গাটাতেই নীনা গুপ্তা অনন্য, অনুকরণীয় আদর্শ বললেও ভুল হবে না বোধহয়।


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা