বাংলাদেশী সমাজে কালো ভাইদের নিয়ে খুব বেশী রকমের ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, আমি মনে করি সেগুলোর অবসান হওয়া দরকার।

শুভ কামালঅনেকেই শুধু এযাবতকালে কার কাকাতো ভাইয়ের ফুপাতো ভাইয়ের শ্বাশুরীর ননদকে কোন কালো ভাই আহত করেছে সেসব গল্প শুনে তাদের জাজ করতে চায়। অথচ যদি সমস্ত ইতিহাস খুলে বলা হয়, তবে আমি বিশ্বাস করি মানুষ বুঝতে পারবে কেন তাদের কেউ কেউ এমন হয়েছে।

আমার ধারণা এতটা বঞ্চিত অন্য কোন জাতি পৃথিবীতে নেই। আমি একেবারে সাল ধরে ধরে দেখাতে পারবো তারা যতবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে সম্পূর্ণ সিস্টেমেটিকভাবে তাদের গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে যে স্বাধীনতা সেটা তারা দুই জেনারেশনের বেশি সময় ধরে পায়নি।

ধরুন আপনার বাঙ্গালি জাতি হাজার বছর ধরে ইন্ডিয়া উপমহাদেশে জ্ঞানচর্চা করেছে, তার ফল আপনি আধুনিক যুগে ভোগ করছেন নিজেকে অনেক মার্জিত আর গোছানো ভেবে। অথচ তারা শুরু করার সুযোগ পেয়েছে এই কেবল সেইদিন।

১৮৬৩ সালে দাসপ্রথার বিলোপ হয় আমেরিকায়। তার আগে তাদের পড়াশুনা করা নিষিদ্ধ ছিল। ভাববেন না এর পর সব ঠিক হয়ে গেছে। তাদের জন্য এর পরেও ছিল না কোন শিক্ষার সুযোগ। আব্রাহাম লিঙ্কন সাউথের জমি দখল করে সেই জমি কালো ভাইদের দিয়েছিলেন। কিন্তু তার তিন বছর পরেই আরেক প্রেসিডেন্ট এসে তাদের জমি কেড়ে নিয়ে পুরনো শাদা মালিকদের দিয়ে দিল। হঠাত করে তারা দেখলো সিস্টেমের মারপ্যাঁচে তাদের আবার সাবেক মালিকের প্ল্যান্টেশনেই কাজ করতে হচ্ছে। সেখানে তাদের অবস্থা আবার হলো দাসের মতোই।

এর মাঝে হাতে গোণা কিছু সংখ্যক কালো ভাই শিক্ষিত হলেন। তারা নিজেরা স্কুল বসালেন সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে এনে। সেখান থেকে কিছু লোক কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মিডল ক্লাস হলেন। কিন্তু সেটাও ছিল লিঞ্চিং এর যুগ। কেউ যদি প্রভাব প্রতিপত্তিসম্পন্ন হয়ে উঠতো তাহলে তাদের অনেককেই শাদা ভাইরা ধরে ধরে গণধোলাই দিয়ে মেরে ফেলতো। তখন শাদা ভাইদের কোন বিচার হতো না এভাবে মেরে ফেললেও। তারা স্যুট টাই পড়ে পড়ে দল বেঁধে ভদ্র বেশে কালো মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতো। সব সময় তাদের ভয়ে থাকতে হতো কখন কাকে মব লিঞ্চিং এর শিকার হতে হয়।

আমেরিকার কয়েকটি শহরে কালো ভাইরা মিডলক্লাশে উন্নীত হয়ে উন্নতি করছিলো। কিন্তু যেখানেই তারা উন্নতি করতো সেখানেই দাঙ্গা করে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হতো, মেরে ফেলা হতো। আটলান্টায় এমন হয়েছে, নর্থক্যারোলিনার এক শহরে এমন হয়েছে, হয়েছে অকলাহোমা'র তুলসা'য় ১৯২০ সালে যেটা আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম দাঙ্গা, শাদা ভাইরা করেছিলো। তাদের পুরো শহরের ঘরবাড়ি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সব গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তবুও তারা ফিনিক্স পাখির মতো বার বার ফিরে আসতে চেয়েছে।

যেখানেই তারা উন্নতি করতো, দাঙ্গা করে তাদের মেরে ফেলা হতো 

তো দাসপ্রথা বিলোপের পর শুরু হলো 'কনভিক্ট লিজিং' এর নিয়ম। অর্থাৎ কেউ জেলে থাকলে তাকে বিভিন্ন কারখানা কিংবা জমির মালিকেরা ভাড়ায় জেল থেকে কাজে নিয়ে যেতে পারবে। তখন শুরু হলো লঘু পাপে গুরু দন্ড দেয়ার প্রচলন। পুলিশেরা বসেই থাকতো কখন কালা ভাইরা ছোটখাট অপরাধ করবে, আর তাদেরকে বিশাল পরিমানের সাজা দিয়ে কয়েক বছর জেলে পাঠিয়ে দিবে। একই অপরাধে কোন শাদা লোকের তিন মাসের কারাদন্ড হলে, কালো ভাইয়ের সাজা হতো দশ বছর।

সাম্প্রতিককালে ইন্ডিয়ায় এমন উদাহরণ দেখা যাচ্ছে, কয়েকদিন আগের সিএএ বিরোধী আন্দোলনে এক হিন্দু সন্ত্রাসী বন্দুক নিয়ে মিছিলে আক্রমণ করতে গিয়েছিলো, তাকে সরকার  জামিন দিয়ে দিয়েছে। অথচ সফুরা জারগার নামের এক পিএইচডি শিক্ষার্থী আন্দোলনকারী সেখানে শুধু বক্তৃতা দিয়েছিলো, সে গর্ভবতী হওয়া সত্ত্বেও, করোনার মতো দুর্যোগ চলাকালীন সময়েও তাকে ইন্ডিয়ান কোর্ট জামিন দেয়নি, তার অপরাধ সে শুধু বক্তৃতা দিয়েছিলো! 

যাইহোক, তখন এইসব কনভিক্ট লিজিং এও কোনপ্রকার মানবাধিকার ছিল না, ৫৫% আসামীই মারা যেতো কঠোর পরিশ্রম করতে গিয়ে। তারা শ্রম দিয়েছে আমেরিকার রাস্তাঘাট বানানোয়, খনিতে- কোথায় নয়! রিকনস্ট্রাকশন যুগে তাদের পরিশ্রমেই আজকের আমেরিকা গঠিত হয়েছে! ও হ্যাঁ, আসামী ধরায়ও কোনপ্রকার মানবাধিকার ছিলনা, শিশুদেরও ধরা হতো। ছয় বছরের এক কালো মেয়ে শিশুরও কয়েক বছরের সাজা হয়েছিলো শুধুমাত্র একটা হ্যাট চুরির অপরাধে। ছোটখাট অপরাধে কালো ভাইদের জেলে পুরার সেই রীতি আজও চালু আছে। গাঁজার জন্য অনেক কালোভাই প্রায় সারাজীবন জেলে কাটিয়ে দিয়েছে, অথচ এখন আমেরিকার অনেক স্টেটেই গাঁজা লিগ্যাল! 

এসবের বেশিরভাগই শেষ হয়েছে ১৯৬৪ সালে সিভিল রাইটস আন্দোলনের মাধ্যমে। সে বছরেই প্রথম কালো মানুষেরা আইনী স্বীকৃতি পেয়েছে সমধিকারের, এর আগে আইন ছিল শাদা ভাইদের জন্য একরকম, আর অন্যজাতের জন্য ভিন্ন রকম।তাদের টয়লেটও ছিল আলাদা, ট্রেনে বাসে বসার জায়গাও আলাদা। যেসব বাঙ্গালি কালা ভাইদের নিয়ে কটু কথা বলে, কালো ভাইয়েরা আন্দোলন না করলে তাদেরও আজকের যুগে এসে আলাদা টয়লেট ব্যবহার করতে হতো, যতোই শিক্ষিত হোক না কেন লিফট ব্যবহার করতে পারতো না, হেঁটে বিল্ডিং এ উঠতে হতো, বসতে হতো বাসের পেছনের সিটে 'কালার্ড' লোকের জন্য সংরক্ষিত আসনে! ও হ্যাঁ, ভাল কোন সরকারী চাকরিও পেতো না! 

আমি সবই সংক্ষেপে বললাম, বিস্তারিত ভেঙ্গে বললে আমি জানি মানুষমাত্রেই না কেঁদে পারবে না, এবং কালো ভাইদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পালটে যাবে। সিস্টেমেটিক রেসিজম জিনিসটা কী, সেটা মানুষ বুঝতে পারবে, যেটা আসলে আজও আছে।

১৯৬৪ সাল থেকে কয় বছর হলো? ষাট সত্তর বছর। কালো ভাইদের দুই জেনারেশনও হয়নি প্রকৃত মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। অনেক আগের ব্যাপার ভাববেন না, আপনাদের অনেকেরই বয়স ত্রিশ চল্লিশ হয়ে গেছে। তারা যে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসেছে, সেখান থেকে এই কয় বছরে যা করেছে সেটাই তো বেশী। শূন্য থেকে শুরু করে সবরকম প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ষাট সত্তর বছরে একটা জাতি এর চেয়ে বেশী আর কী করতে পারে? এসবের জন্য দায়ী কে?

বাংলায় এসব বিস্তারিত ইতিহাস নিয়ে কোন বই নেই। আমি যদি জীবনে একটা বই লিখি সেটা লিখবো কালো ভাইদের নিয়ে। দাসপ্রথার গল্প মানুষ জানে, কিন্তু ভাবে এর পরেই বুঝি সব ঠিক হয়ে গিয়েছিলো! মিডিয়া দেখে, আর আশেপাশের দুই একটা ঘটনা শুনে মানুষের যে জাজমেন্ট, আমি বিশ্বাস করি বিস্তারিত ইতিহাস জানলে সেসব আমূল পালটে যাবে!

আরও পড়ুন- ট্রাম্পের কাপুরুষত্ব ও আমেরিকান বসন্ত: কেন এই আন্দোলনটি আলাদা?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা