
নেপোটিজম শব্দটি শুনলেই আমাদের দেখা যাচ্ছে এখন বলিউডের কথা সবার আগে মনে পড়ে। সুশান্তের আত্মহত্যা অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিয়েছে আমাদের। যে নেপোটিজম শব্দটি নিয়ে সিনেমা গ্রুপগুলোতে কয়দিন আগেও হাসি-ঠাট্টা হতো, এখন তা হন্তারক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কফি উইথ করনের সিলি প্রশ্নগুলো এখন অভিনেতাদের ডিপ্রেশনের জন্য দায়ী বলা হচ্ছে। তাই চলুন একটু নেপোটিজম নিয়ে আলাপ করা যাক।
নেপোটিজম শব্দটি এসেছে মূলত ইতালিয়ান শব্দ নেপোটিজমো থেকে আর নেপোটিজমো শব্দটি এসেছে নিপোতে থেকে যার অর্থ কাজিন বা নেফিউ। মূলত সে সময় ইতালিতে পোপের নেফিউরা পোপের মতোই অনেক সম্মান ও মর্যাদা পেতো, যেটা তারা ডিজার্ভ করে না।
যারা দীর্ঘদিন চার্চের হয়ে কাজ করে বা প্রথা মেনে একটা পর্যায়ে আসে, তারা এতে অসন্তুষ্ট হয় এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। নেপোটিজম শব্দের অরিজিন কয়েকশ বছর আগে হলেও নেপোটিজমের প্র্যাকটিস হয়ে আসছে আদিকাল থেকেই।
এমন না যে শুধু এন্টারটেইনমেন্ট জগতেই এর অস্তিত্ব। রাজার ছেলেই রাজা হয়েছে যুগ যুগ ধরে। তালিকা ধরে আমরা তাদের নামও মুখস্থ করেছি। এখন যেহেতু রাজা-রাজরাদের জমানা নেই তাতে মনে হতে পারে যে সময় আধুনিক হয়েছে। কিন্তু এখনো স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র কোনটিই নেপোটিজমের বাইরে যেতে পারে নি। স্বৈরতন্ত্রে এখনো পরিবারের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষেত্রেও সরকার প্রধানের পরিবারের মাঝেই ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। আপনি একটি গণতান্ত্রিক দলের মাঠ পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে আসলেও কখনো প্রধান হবার স্বপ্ন দেখতে পারবেনই না। আর আমরা সেটা মেনেও নিয়েছি।
আপনি ভাবছেন বড় বড় জায়গাতেই এই অবস্থা, আমরা সাধারণরাই ভালো আছি। এরই মাঝে আপনার বাবার ডাক আসলো, ডেকে বললেন- যা, তোর সিভিটা ঠিকঠাক কর। কাল তোর মামার অফিসে দিয়ে আসবি। ওনার অফিসে একটা জায়গা খালি হয়েছে। আপনি খুশিতে গদগদ হয়ে নিজের সিভিতে সিজিপিএ আপডেট করে নিলেন থ্রি পয়েন্ট জিরো জিরো। ওদিকে আপনার মামার কেবিনের বাইরে বসে আছে থ্রি পয়েন্ট ফাইভ সিজিপিএওয়ালা কেউ। হ্যাঁ, এটাও নেপোটিজম।
এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির দিকে আসা যাক। আমরা যদি ভাবি শুধু বলিউডেই নেপোটিজম আছে, তাহলে ভুল ভাবা হবে। চলুন হলিউড থেকে ঘুরে আসি।
ছোটবেলা থেকেই আমরা হ্যারি পটারের অন্ধ ভক্ত। মাঝে মাঝে ভাবতাম ইশ যদি আমি হ্যারি পটার চরিত্রে অভিনয় করতে পারতাম। কিন্তু কীভাবে পারবেন? যদি আপনার বাবা নামকরা এজেন্ট হন ও মা কাস্টিং ডিরেক্টর, তাহলে হাজারটা বাচ্চাকে পেছনে ফেলে কোন অভিনয় দক্ষতা না থাকা সত্ত্বেও আপনি হয়ে যেতে পারেন সিনেমা ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রের অভিনেতা।
টোয়ালাইট বই পড়ার পর কতো মেয়েই ভেবে নিয়েছিল নিজেকে বেলা সোয়ানের জায়গায়। কিন্তু আপনি প্রভাবশালী প্রডিউসার জন স্টুয়ার্টের মেয়ে হলে ভিন্ন কথা।

বাইরের দেশেই এরকম হয় বেশি, আমাদের দেশে তো দেখি না। বাপ্পারাজের কথা ভুলে গেলেন? রুবেল? সুচন্দা, ববিতা, চম্পা তিন বোন? শত শত উদাহরণ আছে সামনে। শুধু সিনেমা সেক্টর নয়, আপনি গান দেখুন, নাচ দেখুন, কোরিওগ্রাফারের ছেলে/মেয়ে কোরিওগ্রাফার, একশন মাস্টারের ভাগ্নে/ভাতিজা একশন মাস্টার। এটা নেভার এন্ডিং একটা লুপ।
কিন্তু এসব বলিউডে থাকা সত্ত্বেও বলিউড কেন অন্যদের চেয়ে আলাদা, অন্যদের চেয়ে বেশি অবিচার কেন হয় বলিউডে? শুধুই কি নেপোটিজমের কারণে? না। বলিউডে নেপোটিজম, পাওয়ার প্র্যাক্টিস, ক্যাম্পিং, সবকিছু মিলিয়ে অসহ্য একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে। নেপোটিজম একটা টিকিং টাইম বম্ব এখন বলিউডে।
বলিউড পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ বলিউডে কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে মুম্বাইতে আসে। কেউ এক্টর হতে চায়, কেউ ছোটখাটো রোল পেলেই খুশি, কেউ প্রোডাকশনে কাজ করে, কেউ কাস্টিং এ, কেউ ক্যামেরা টানে, কেউ এক্সট্রা ড্যান্সার থাকে, কারও কাজ স্রেফ ট্রলি টানা। এভাবেই হাজার হাজার মানুষ মিলে তৈরি করে বলিউডের রঙিন দুনিয়া। প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন এখানে আলাদা, প্রতিটি মানুষের স্ট্রাগল আলাদা। একদম সবচেয়ে প্রিভিলেজড মানুষটিরও নিজস্ব স্ট্রাগল থাকে যেমন, তেমনি দিনে ৫০ রূপি পারিশ্রমিক পাওয়া বয় ছেলেটিরও নিজস্ব সুখী অনুভূতি থাকে।
জেনারালাইজ করে দেখতে গেলে কিছুই দেখা যাবে না, সবাইকেই দোষী মনে হবে। রোজ ধর্মা প্রোডাকশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি চাইলেই করন জোহরকে গালি দিতে পারে উঠতে-বসতে। থিয়েটারে মুহুর্মুহু তালি পাওয়া অভিনেতাটি টাইগার শ্রফের বন্ধুর চরিত্রের জন্য অডিশন দিয়ে বাদ পড়ে। নব্বইয়ের মাঠ কাঁপানো কোরিওগ্রাফার মর্ডার্ন ড্যান্স ফর্মে মাহির না হওয়ায় কাজ না পেয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারে। এমন ক্ষেত্রে আপনি চাইলেও দোষ দিতে পারবেন না দুই পক্ষের কাউকে। কারণ এই সিস্টেমটা একদিনে গড়ে ওঠে না। এই সিস্টেমের ফল্টও একদিনে গড়ে ওঠেনি। এমন না যে বলিউডে নেপোটিজম বিগত কয়েক বছরেই এসেছে, তাহলে এখন এতো কথা উঠছে কেন?
১) মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া পেয়েছে নিজের মত ব্যক্ত করার জন্য
২) নেপোটিজমের প্রোডাক্টদের প্রতিভাহীনতা
এই দুটো ফ্যাক্টরই এই ক্ষেত্রে প্রভাব রাখছে বলে আমার ধারণা। রাজ কাপুর থেকে শুরু করে হালের অনন্যা পান্ডে নেপোটিজমের কারণেই বলিউডে এসেছেন।
এখন রাজ কাপুরের সাথে কেন অনন্যাকে এক ব্র্যাকেটে রাখলাম এটা দেখে ক্ষেপে না গিয়ে ভাবুন যে রাজ কাপুর, আমির খান, ঋত্বিক রোশনরা কেন আলাদা ব্র্যাকেটে আর অনন্যা, অর্জুন, সারারা কেন আলাদা ব্র্যাকেটে পড়ে গেলেন?
কারণ, প্রথম সেটের অভিনেতারা ঠিকই বলিউডে নেপোটিজমের হাত ধরে ঢুকলেও নিজের জায়গা গড়ে নিতে হয়েছে তাদের। দ্বিতীয় সেটের অভিনেতারা ঢুকেছেন বটে বলিউডে, জায়গা গড়ে নিতে লড়ছেনও যতটুকু তাদের ট্যালেন্ট আছে, কিন্তু তারা বাড়তি যেটা পেয়েছেন সেটা হল রেডিমেড মিডিয়া এটেনশন।
ফোর্বসের সেলেব্রিটি লিস্ট দেখে আসুন, এর মাঝে কয়জন অভিনেতা আর কয়জনই বা সিঙ্গার। যারা টপে আছেন, তারা মূলত কিছু করেনই না। রিয়েলিটি শো, বিউটি ব্র্যান্ড দিয়েই তারা পপুলার সকল সোশ্যাল মিডিয়ায়।
অর্জুন কাপুর আর সুশান্ত সিং রাজপুত কাছাকাছি সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছেন। সুশান্তের সাকসেস রেশিও অর্জুনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া বলেন, নামকরা টক শো বলেন, এফেয়ার বলেন, বলিউড পার্টি বলেন, আপনি অর্জুনকে পাবেন না এমন কোন জায়গা নেই। মিডিয়া এটেনশনে সুশান্ত তার চেয়ে কয়েকগুণ নয় বরং কয়েক হাজার গুণ পিছিয়ে আছে। তবুও অর্জুনের হাতে কাজের কমতি নেই, আর সুশান্ত দেড়শ কোটি টাকার দুটো ব্লকবাস্টার দিয়েও একাকী জীবন যাপন করছিলেন।
এক পক্ষ বলতেই পারে যে সুশান্ত কেন নওয়াজ, মনোজ, রাজকুমারদের মতো হতে পারে না। অভিনেতাদের তো আলাদা জাতই আছে। কিন্তু সুশান্ত তো সেরকম হতে চায়নি। বলিউডে যারা অভিনয় করতে আসে, তাদের ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জনের স্বপ্ন থাকে সে বলিউডি সিনেমার নায়ক হবে। কেউ এটা ভেবে আসে না যে আমি নায়কের বেস্ট ফ্রেন্ড হবো, ক্যারেক্টার এক্টর হবো, ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার হবো।
সুশান্ত সে স্ট্রাগলগুলো করেই এসেছে আগে। সে নায়কই হতে চেয়েছে, সে ভালো কাজে অভিনয়ও করতে চেয়েছে। সে বক্স অফিস সাকসেসও চেয়েছে আবার সুঅভিনেতা হিসেবে প্রশংসাও। পেয়েছেও এগুলো কমবেশি সে। কিন্তু পায়নি কী? এটেনশন! এমন না যে একজন অভিনেতা এটা চায়, একজন নায়ক আশা করে যে সবাই তাকে নোটিশ করবে। কিন্তু বারবার যখন তার প্রাপ্য এটেনশন থেকেও তাকে ডিনাই করা হয় তখন একটা অভিমান সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিকই। বলিউডে সেটাই হয়ে আসছে, সুশান্তের ক্ষেত্রে বেশিই হয়েছে, সামনেও হবে যদি আমরা না বাঁধা দেই।

দোষ তো করন জোহরের। দোষ তো সালমান খানের। এগুলো বলে লাভ নেই কারণ দোষ আদতে আমাদেরই। আমরা ইনজাস্টিস হতে দেখেছি এবং ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে সেগুলোকে জাস্টিফাইও করেছি। অবশ্যই আমরা ঠিক করে দিতে পারবো না একজন মানুষ কোন সিনেমা দেখবে, কোন গান শুনবে।
কিন্তু একজন অভিনেতা বা পার্সোনালিটি যখন এতই বড় হয়ে যাবেন যে বেসুরো গলায় নিজের গান নিজেই গাইবেন, ব্যক্তিগত ঝামেলার কারণে নিজের সিনেমায় সময়ের সবচেয়ে সেরা শিল্পীকে দিয়ে যেন গান না করানো হয় সে শর্ত জুড়ে দেবেন, নিজের টকশোতে নিজের কাছের মানুষদের ডেকে সেটাকেই বলিউড বোঝাবেন, আউটসাইডারদের নাম সিলি সব প্রশ্নে জুড়ে দিয়ে নীচু দেখাতে চাইবেন, পুরস্কার থেকে শুরু করে সকল ফাংশনে একই মুখ বারবার দেখানোর চেষ্টা করবেন তখনই আমাদের সরব হতে হবে।
আমরা চুপ করে থাকি এটাই আমাদের সমস্যা। আমাদের সুশান্তের মতো উদাহরণ হাতে পাওয়া লাগে, কঙ্গনার কথা শুনে টের পাওয়া লাগে। আমি আবারও বলছি যে সুশান্ত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বা কঙ্গনা যে কথা বলেছে সেগুলোর সাথেও যে আমি পুরোপুরি এগ্রি করি এমনটা নয়।
কিন্তু বলিউডে পাওয়ার প্র্যাকটিস, ট্যালেন্টলেস নেপোকিডদের এন্ডরসমেন্ট যে পর্যায়ে চলে যাচ্ছে তাতে এরকম উদাহরণ আরও তৈরি হতে আর বেশি দেরি নেই। তৈমুর, আব্রামদের নিয়ে যে পরিমাণ এটেনশন দেই আমরা, সুশান্তরা ওটুক এটেনশন পেলেও বোধহয় বর্তে যেত।
নেপোটিজম কখনোই চলে যাবে না, এটা নিশ্চিত। পাওয়ার প্র্যাক্টিস, গ্যাং এগুলোও থেকে যাবে। কিন্তু কতটুকু থাকবে, কতটুকু নিবো, কতটুকু এটেনশন আমরা দিবো সেগুলো কিন্তু আমাদের হাতেই।
আমরাই ঠিক করে দিবো আমরা কাদের চাই। যান এখন গিয়ে সোনচিড়াইয়া, ব্যোমকেশ বক্সী দেখে আসুন। প্লিজ বলবেন না দেখা আছে এগুলো। আপনি-আমি সংখ্যায় খুবই কম। খুবই কম।