নির্বাক: সৃজিত মুখার্জীর সবচেয়ে আন্ডাররেটেড সিনেমা?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
'নির্বাক' দেখা শেষ করে দাঁড়িয়ে একটা হাততালি দেয়া যায়, দর্শককে ভাবতে বাধ্য করার জন্য। বাংলা সিনেমায় মেটাফোরের এমন মেলা বসতে দেখা যায়নি এর আগে, সামনেও কখনও যাবে কিনা সন্দেহ...
** স্পয়লার অ্যালার্ট **
দু'দিন আগেও আমি ভাবতাম সৃজিত মুখার্জীর সবচেয়ে আন্ডাররেটেড সিনেমার নাম জাতিস্মর। তারপর নির্বাক দেখলাম, মুক্তির পাঁচ বছর পরে এসে। কার কাছে যেন নেগেটিভ রিভিউ শুনে সিনেমাটা দেখা হয়নি। যে সিনেমাটাকে হাফিংটন পোস্ট বলেছিল 'শকিং এক্সপেরিমেন্ট', সেটাই মিস করে গিয়েছিলাম, বাইশে শ্রাবণে যেমন করে পরমব্রত মিস করে গিয়েছিলেন প্রসেনজিতের শ্যাওলা ধরা বাড়িটাকে।
পৌনে দু ঘন্টা ধরে মেটাফোর নিয়ে মোটামুটি ছেলেখেলা করেছেন সৃজিত। চারটা আলাদা গল্পকে এক সুতোয় বাঁধার দারুণ একটা চেষ্টা ছিল। কিছু জায়গা খাপছাড়া লেগেছে; প্রথম গল্পটা বাকি তিনটের সঙ্গে মেশেনি ঠিকঠাক, তবু কোথাও অতিরঞ্জিত মনে হয়নি পুরো ব্যাপারটাকে।
চারটে গল্প, একটা নিজেকে নিজে ভালোবাসার, নার্সিসিজমের পক্ষে-বিপক্ষে কোনো দিকে কথা না বলেও সৃজিত যেন সেখানে উন্মাদ পর্যায়ের আত্মপ্রেম ব্যাপারটাকে খানিকটা নেগেটিভলিই উপস্থাপন করলেন। অঞ্জন দত্ত কি জীবনের সেরা অভিনয়টা করে ফেললেন এই পর্বে? সম্ভবত! সিনেমা হলে চেয়ারকে জড়িয়ে ধরা কিংবা নিজের মুখে কেক মেখে নিজের জন্মদিন পালনের দৃশ্যগুলো দেখে অদ্ভুত একটা মায়া লাগলো লোকটার জন্য। এই গল্পটা বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদর ডালির আত্মজীবনী থেকে ধার করেছেন সৃজিত, ডালিও নাকি নার্সিসিস্ট টাইপের লোক ছিলেন! নির্বাক সিনেমাটা উৎসর্গও করা হয়েছে কিংবদন্তি এই চিত্রকরকে।
দ্বিতীয় গল্পে একটা গাছ প্রেমে পড়ে যাচ্ছে একজন নারীর, প্রেমিকার ক্লিভেজ দেখে গাছের মনে কাম জাগছে, মেয়েটার প্রেমিক যখন তাকে যখন শহর কলকাতা থেকে নিয়ে যেতে চাইছে, তখন প্রতিদ্বন্দ্বীকে রুখে দেয়ার সব চেষ্টাই করেছে গাছটা, তাতে বিফল হয়ে বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। গোটা ব্যাপারটাই অদ্ভুত, তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে, সত্যিই এমনটা ঘটছে বুঝি!
এই গল্পের খোঁজও সৃজিত পেয়েছিলেন সালভাদর ডালির কাছে। নির্বাক সিনেমাটাকে বুঝতে হলে আপনাকে সিনেমার বাইরের কিছু ঘটনাক্রম জানতে হবে, নইলে অনেক কিছুই মাথার ওপর দিয়ে চলে যাবে। এই সিনেমার দ্বিতীয় গল্পটার জন্ম হয়েছে এভাবে- সৃজিত আমেরিকায় গিয়েছেন বেড়াতে, কিংবা কোন কাজে। ফ্লোরিডার দ্য ডালি মিউজিয়ামে গিয়ে সালভাদর ডালির অ্যান্থ্রোপোমরফিক সুররিয়ালিজম সিরিজের একটা ছবি চোখে পড়লো তার, ছবিটা হচ্ছে একটা গাছের, কিন্ত খানিকটা দূর থেকে সেটার দিকে তাকালে মানুষের মতোই লাগে। সেই চিত্রকর্ম দেখার পরেই সৃজিতের মাথায় গল্পের থিমটা এলো- একটা গাছ যদি মানুষের মতো চিন্তা করে, মানুষের মতো করে আরেকটা মানুষের প্রেমে পড়ে, তার মনে প্রেমিকাকে হারিয়ে ফেলার ভয়, ঈর্ষা বা কামলিপ্সা জাগে- তাহলে কেমন হবে ব্যাপারটা?
কেমন হয়েছে, সেটা সিনেমা দেখলেই বোঝা যাবে। সুস্মিতা সেন 'নির্বাক' দিয়েই বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে অভিষেক ঘটিয়েছেন, তার বাংলা উচ্চারণ কানে লেগেছে অবশ্য। তবুও এই পর্বটা অনন্য হয়ে থাকবে দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফির জন্যে। কম্পিউটারে লিখতে লিখতে গোটা শহর চক্কর দেয়ার যে দৃশ্যটা- অসম্ভব ভালো লেগেছে সেটা। গোটা সিনেমাজুড়ে আবহ সঙ্গীতও ভালো লাগার পালে হাওয়া যুগিয়ে গিয়েছে।
হতাশ করেছেন যীশু সেনগুপ্ত। একমাত্র তাকেই আনাড়ি অভিনেতা মনে হয়েছে গোটা সিনেমায়। অথচ তিন নম্বর গল্পটায় আরও অনেক কিছু করার ছিল তার। যদিও সেই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তিনি নন, বরং একটা কুকুর, নারী কুকুর, বিঙ্গি যার নাম। প্রভুর জীবনে নতুন নারীর আগমন যে মেনে নিতে পারে না কোনভাবেই, তার মনের মধ্যে এসে হাজির হয় সীমাহীন ঈর্ষা, যেটা হয়তো প্রেমেরই একটা অংশ। ট্রাস্ট মি, এই কুকুরটা সিনেমায় যীশুর চেয়ে ভালো অভিনয় করেছে, দুর্দান্ত কিছু লুক এবং এক্সপ্রেশন দিয়েছে। পুরো ক্রেডিটটা পাবেন সৌমিক হালদার, নির্বাকের ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি।
শেষ গল্পটা মর্গের। সৃজিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাইশে শ্রাবণের শুটিং করার সময় নাকি তার মাথায় এই গল্পটার আইডিয়া এসেছিল। বাইশে শ্রাবণে প্রসেনজিতের একটা সিকোয়েন্স ছিল মর্গে, কয়েক সেকেন্ডের মাত্র। সেটার শুট করতে গিয়ে সৃজিত মর্গের প্রতিটা ড্রয়্যারকে একেকটা ফ্ল্যাট ভাবতে শুরু করেছিলেন। প্রতিটা ফ্ল্যাটে মানুষ আছে, হোক না মৃত, মরা মানুষের কি ভালোবাসা থাকতে নেই? মৃতের কি প্রেম হতে পারে না?
মরা লাশ প্রেমে না পড়লেও, ঋত্বিক চক্রবর্তী কিন্ত লাশের প্রেমে পড়ে গেলেন। বেচারা মর্গে কাজ করেন, সেই মর্গেই আচমকা একটা লাশ এলো, দুর্ঘটনায় মারা গেছে সেই নারী। বাতাসে মুখের ওপর থেকে কাপড়টা যেই না সরলো, অমনি সিগারেট ফুঁকতে থাকা ঋত্বিক দুম করে পড়ে গেলেন প্রেমে; গরীব হয়েছে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট হবে না- এরকম তো কোন কথা নেই। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে 'তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম...' সেই মৃত লাশকে ঘিরে ঋত্বিকের চোখে কত রঙবেরঙয়ের স্বপ্ন খেলা করে, সেই স্বপ্ন ভাঙতেও সময় লাগে না খুব একটা।
অল্প সময় পেয়েই দুর্দান্ত অভিনয় করলেন ঋত্বিক, গানের লাইনের মতোই 'তেরি বাহো মে মার যায়ে হাম' দিয়ে যেভাবে সিনেমার শেষটা টানলেন পরিচালক, তাতে গোটা সিনেমার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো মনে রইলো না খুব একটা। ভালোবাসা যে প্রেমিককে দম বন্ধ করে দেয়া অদ্ভুত একটা অনুভূতি উপহার দেয়, ভালোবাসা যে আসলে মৃত্যুদূতও- সেটা এভাবে চারটে গল্পকে পরপর না সাজালে এত চমৎকারভাবে বোঝানো যেতো না৷
তবু সমালোচনার জায়গা থাকে। গাছের আত্মহত্যার ধরন আর মর্গে মৃত লাশের চেহারার সাফ-সুতরো ভাব- এই দুটো ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন না তুললেই নয়। সুস্মিতার সংলাপ আর যীশুর অভিনয়ের কথা তো বললামই। তারপরও নির্বাক দেখা শেষ করে দাঁড়িয়ে একটা হাততালি দেয়া যায়, দর্শককে ভাবতে বাধ্য করার জন্য। বাংলা সিনেমায় মেটাফোরের এমন মেলা বসতে আর কবে দেখা গেছে? সামনেও কখনও যাবে কিনা সন্দেহ। দু হাজার পনেরোর সৃজিত তো বেঁচে নেই এখন আর, এক্সপেরিমেন্টের ভূত তার মাথা থেকে নেমে গেছে সেই কবেই। নির্বাক বোধহয় সেজন্যেও সৃজিতের ক্যারিয়ারে অন্যরকম একটা অধ্যায় হয়ে থাকবে সবসময়...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন