লুঙ্গি পড়লেও তাকে হিরোই মনে হয়, একদম সাদামাটা এক্সপ্রেশন ডেলিভারি দিলেও! এই সাধারণত্ব দিয়েই নিভিন পৌলি মন জয় করে নিয়েছেন অগণিত দর্শকের!

মালায়ালাম সিনেমা পাড়ায় এখন স্বর্ণযুগ চলছে। বিগত কয়েক বছরে এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বেশ কজন তরুণ অভিনেতা অভিনেত্রী যেমন তৈরি করেছে, তেমনি মালায়ালাম সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি থেকে এসেছে অনেকগুলো সফল সিনেমা। সেসব সিনেমা গল্পে, সিনেমাটোগ্র‍্যাফিতে, পরিচালনায়, অভিনয়ে সব মিলিয়েই অন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। সে সিনেমাগুলো এখন রিমেক হচ্ছে বলিউডেও!

মালায়ালাম সিনেমায় তরুণদের উত্থানকে যদি তাদের বর্তমান গোল্ডেন জেনারেশন বলা হয়, তাহলে এই জেনারেশনের অন্যতম শক্তিশালী অভিনেতা নিভিন পৌলির নাম বিশেষভাবেই উচ্চারিত হবে। নিভিন পৌলি অভিনীত যে সিনেমাটা প্রথম দেখে তার অভিনয়ের প্রতি আমার মুগ্ধতা জেগেছিল তার নাম ‘প্রেমাম’। এই সিনেমাটি মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম ব্যবসা সফল ছবি, তার চেয়ে বড় কথা আপনি যদি জীবনে একটিও মালায়ালাম সিনেমা না দেখে থাকেন এই সিনেমাটি নিশ্চিতভাবে আপনাকে এই ইন্ডাস্ট্রির প্রতি নতুনভাবে আগ্রহ জাগাবে। এই সিনেমাটি গোটা ভারতজুড়েই তীব্র স্তুতি পেয়েছে৷ শুধু চেন্নাইতেই একটানা ২৫০ দিন সিনেমা হলে হাউজফুল শো গিয়েছে এই সিনেমার!

নিভিনের অভিনয়ের শুরু হয় ২০১০ সালে। কখনো ভাবেননি তিনি অভিনয় করবেন। ছেলেবেলায় এমন কোনো স্বপ্নও দেখেননি নিভিন। হতে চেয়েছিলেন উদ্যোক্তা। এমনকি প্রথমবার যখন অভিনয়ের জন্য অডিশন দিলেন, তখনো নিজের উপর সেরকম বিশ্বাস ছিল না তার। আশাই করেননি তিনিও ডাক পেতে পারেন অভিনয়ের জন্য। কিন্তু, প্রেমামের সাফল্য তার জীবন পালটে দেয়। গত সাত বছরে ত্রিশটির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেন এবং বেশিরভাগ সিনেমাই বক্স অফিস হিট। 

'প্রেমাম' এ নিভিন পৌলি

নিভিনের অন্যতম গুণ হলো, ন্যাচারাল অভিনয়ের ক্ষমতা। একজন হিরো লুঙ্গি পড়লেও যখন তাকে হিরোই মনে হবে, একজন হিরো সাধারণ এক্সপ্রেশন ডেলিভারি দিলেও যখন তাকে অসাধারণ মনে হবে, তখনই তো তিনি সত্যিকারের অভিনেতা, সত্যিকারের হিরো। নিভিন সেইরকমই একজন। দেখতে সাধারণ তিনি। মনে হয় সাধাসিধে। কিন্তু, যখন স্ক্রিনে তার রোল -প্লে শুরু হয়, সেখানে নিজের সেরা অভিনয় মুন্সিয়ানা দেখিয়ে ছাড়েন তিনি। 

তার অভিনয় করা সিনেমার গল্পগুলো যেন আমাদেরই গল্প। চেনা গল্পের ভিন্ন উপস্থাপনই তাকে অনন্য করে তুলেছে। ১৯৮৩ (1983) নামক ছবির বিষয়বস্তু ক্রিকেট। কিন্তু, অন্য সব খেলানির্ভর প্লটের চেয়ে এই গল্পটি একটি ভিন্ন। আমাদের শৈশব কৈশোরে যারা খেলোয়াড় হতে চেয়েছেন, যাদের পাড়ায় একটা ক্রিকেট দল ছিল, তারা একবার দেখে বুঝতে পারবেন, এই গল্পটা কত আপন। নিভিনের ছেলের মধ্যে নিভিন নিজের স্বপ্ন লালন করেছিলেন। এরকমই প্রত্যেকটা সিনেমায় নিভিন আলাদা করে চরিত্র মনে হয় না, মনে হয় বাস্তবেই এই ধরণের কিছু ঘটছে। নিভিন শুধু প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, অনুভূতির খেলায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন দর্শকদের।

ব্যাঙ্গালোর ডেইজের (Bangalore Days) নিভিনের চরিত্রটাও ভীষণ বাস্তব। একজন ভদ্র, দায়িত্ববান, লাজুক, সহিষ্ণু, খানিক বোকা এবং সরল ছেলের চরিত্র। যে ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে পড়ার পর ব্যাঙ্গালোরে চাকরি নিয়েছে এবং স্বপ্ন দেখে একজন খাঁটি মালায়ালাম নারীকে নিজের স্ত্রী হবে। 

ওম শান্তি ওশানায় (Om Shanti Oshana) তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন নাজরিয়া নাজিম। সেই সিনেমায় তিনি এক যুবক, নাজরিয়া ছিলেন টিনএজ মেয়ে। একজন টিনএজ মেয়ের সাথে অসম প্রেমের গল্প। মেয়েটাকে তাকে ভালবাসে, সে মেয়ের কথা ভেবেই তাকে এড়িয়ে চলে। তারপর শেষের দিকে এসে সিনেমা অন্যদিকে মোড় নেয়। যারা দেখেননি, গল্প পুরোটা বলে তাদের মজা নষ্ট না করলাম। এই সিনেমাটিও নিভিনের অন্যতম সেরা এক মাস্টারপিস। 

একশন হিরো বিজু (Action Hero Biju) সিনেমায় নিভিন অভিনয় করেছিলেন পুলিশ অফিসার হিসেবে। কিন্তু, চরিত্রটি তথাকথিত ধুম ধারাক্কা মারপিট আর পুলিশ অফিসারের অলীক বীরত্বগাঁথার ক্যারেকটার না। যা বাস্তবে হয়ে থাকে, একজন পুলিশ অফিসারকে কত তুচ্ছ বিষয়ও সামলাতে হয় থানায় সেসব রিয়েল লাইফ সিনারিও উঠে এসেছে সিনেমায়। হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল এই সিনেমা দেখে আমার।

ব্যাঙালোর ডেজ সিনেমায় অভিনয় করেছেন সহজ-সরল গ্রামের ছেলের ভূমিকায়

নিভিন পৌলি অভিনয় করেছেন তামিল সিনেমাতেও। সেখানেও তামিল সিনেমার নিজস্বতার চেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে তার স্বকীয়তাই। ‘রিচি (Richie)’ ও ‘নিরাম (Neeram)’ নামক দুইটা তামিল সিনেমাও তার সেরা কাজের মধ্যেই থাকবে। নিভিনের সিনেমার গল্পে আপনি নিশ্চিতভাবে আপনাকে খুঁজে পাবেন কোনো না কোনো ভাবে। যার ফলে নিভিনকে যেমন আপন মনে হবে, আরো কাছের মনে হবে তার সিনেমার গল্পকে। তারা অভিনয় দক্ষতার জন্য তাকে মালায়ালাম সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সুপারস্টার মোহনলালের সাথে তুলনা করা হয়। যদিও বিনয়ী নিভিন এটাকে হেসেই উড়িয়ে দিতে চান। তাকে কখনো কখনো তুলনা করা হয় আরেক সুপারস্টার পৃথ্বীরাজের সাথেও। তিনি বিনয়ী হয়ে বলে দেন, পৃথ্বীরাজ তার চেয়ে ভাল অভিনেতা। তিনি আসলে নিজের আলাদা একটা ট্রেডমার্ক তৈরি করে ফেলেছেন এরই মধ্যে। যেখানে নিভিন মানেই সাধারণ গল্পের অসাধারণ উপস্থাপনা।

কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। নিভিনও নন। তাকে ঘিরে সমালোচনা আছে, তিনি এক্সপিরিমেন্টাল কাজ করতে ভয় পান। নিজের কম্ফোর্ট জোন থেকে বের হতে চান না। এই ব্যাপারে তার বক্তব্য খুব সিম্পল। তার কথা হচ্ছে, একজন অভিনেতাকে সবসময়ই কোনো না কোনো সমালোচনার মুখে পড়তে হয়ই। যদি একজন অভিনেতা বেশি বেশি ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন, কেউ কেউ বলবে কেনো সে আরো সিলেক্টিভ হয় না। সিলেক্টিভ হলেও কেউ না কেউ বলে সে কেনো এক্সপিরিমেন্টাল রোল প্লে করে না। সিনেমা সফল হলে অভিনেতার গায়ে তকমা পড়ে যায়, সে কমার্শিয়াল। সিনেমার প্রতি ভালবাসা নেই। আবার সিনেমা ফ্লপ গেলে অভিনেতাকে শুনতে হয় সে ক্যারিয়ারের প্রতি সিরিয়াস না। তাই নিভিনের কথা হচ্ছে, নিজের মনের কথা শোনা।

সহজাত মানসিক অবস্থা থেকে যে সিনেমাটা তিনি করবেন বলে ভাবেন সেটাই করতে চান। একটা ভাল সিনেমা করার চেষ্টাই মূল কথা। সিনেমা হিট, ফ্লপ, চরিত্র এসব দিয়ে বিবেচনাটা পুরোটাই একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। এতো কিছুর উপর কারো হাত নেই, শুধু ভাল সিনেমা করার চেষ্টা করাটাই নিজের উপর থাকে। নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকাটাই তো সার কথা। 

‘আওয়ার ভাদাক্কান সেলফি (Our Vadakkan Selfie)’ ছিল অভিনেত্রী মানজিমা মোহনের অভিষেক সিনেমা। এই সিনেমায় তিনি নিভিনের সাথে অভিনয় করেছেন। কাছ থেকে দেখেছেন মানুষটাকে। তিনি বলেন, “অভিনয়ের প্রতি ত্যাগ, প্রতিজ্ঞা আর প্যাশনই নিভিনকে সবার চেয়ে আলাদা করেছে।” তিনি দেখেছেন, নিভিন একটি নীল রঙের ডায়েরি রাখেন তার সাথে সবসময়। মানজিমা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কেনো এই ডায়েরি?” নিভিন জানান, সেই ডায়েরিতে তিনি সিনেমার খুঁটিনাটি লিখে রাখেন। স্ক্রিপ্ট পড়ে যেসব জায়গা নিয়ে মনে অস্পষ্টতা তৈরি হয়, সেগুলো লিখে রাখেন ডায়েরিতে। পরে এগুলো নিয়ে পরিচালকের সাথে আলোচনা করেন যেন আরো ভাল আউটপুট দেয়া যায়। মানজিমা দেখেছেন, কিভাবে নিভিন একটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। তার এই ডেডিকেশন আর স্ট্রাগল তাকে আজকের নিভিন বানিয়েছে!

‘কায়ামকুলাম কৌচুন্নি (Kayamkulam Kochunni)’ সিনেমার জন্য নিজের শরীরের ওজন কমিয়েছেন। চরিত্রের প্রয়োজনে অনেক চ্যালেঞ্জিং দৃশ্যে অবলীলায় অভিনয় করেছেন। তিনি জানান, এই সিনেমায় অভিনয় করে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। যেহেতু তাদের ইন্ডাস্ট্রি ছোট তাই এধরণের কাজ করার সুযোগ পেয়ে তিনি রোমাঞ্চিত। এই সিনেমায় তাই ১০০ না, তিনি নিজের ১০১ পার্সেন্ট পারফর্মেন্স নিবেদন করেছেন। 

কয়েক বছর আগেও  নিভিন একেবারেই মিডিয়ার কাছ থেকে আড়ালে থাকতেন। তিনি এখন সুপারস্টার। কিন্তু, স্টারডম নিয়ে থাকার চেয়ে তিনি সাধারণ নিভিন হয়েই থাকতে চান। তিনি নিজে যেমন তার সিনিয়রদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেন, তেমনি তিনি নিজের কো-আর্টিস্টদের, নতুনদের নিজের অভিজ্ঞতা জানান মন খুলে।

একজন ভাল আর্টিস্ট হওয়াটাই যদি লক্ষ্য হয়, নিভিন সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছেন। নিভিন সাধারণ হয়েও তাই অসাধারণত্ব অর্জন করেছেন। নিভিন আরো সেরা সেরা কাজ উপহার দিক, আমরা ভেসে যাই মুগ্ধতায়, ডুবে থাকি নিভিন পৌলির সরলতায়।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা