নো ব্রা ডে বলতে অনেকেই বোঝেন বক্ষবন্ধনী খুলে আকাশে ছুঁড়ে দেয়াটাকে। 'ব্রেসিয়ার' শব্দটাকে যেখানে 'অশ্লীল' একটা শব্দ হিসেবে ভাবা হয়, সেদেশের মানুষের কাছে 'নো ব্রা ডে' ব্যাপারটা যে হাসিঠাট্টা বা তীর্যক মন্তব্যের শিকার হবে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই...
প্রতি বছর অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখে বিশ্বজুড়ে 'নো ব্রা ডে' পালিত হয়। এই দিনটা নিয়ে আমাদের দেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে কিছু ভুল ধারনা আছে। 'ব্রেসিয়ার' বা বক্ষবন্ধনী শব্দটা শুনলেই যে দেশের অনেক মানুষ লজ্জায় মুখচাপা দেয়, কিংবা এটাকে 'অশ্লীল' একটা শব্দ হিসেবে গ্রহণ করে, সেদেশের লোকজনের কাছে 'নো ব্রা ডে' ব্যাপারটা যে হাসিঠাট্টা বা তীর্যক মন্তব্যের শিকার হবে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এই 'নো ব্রা ডে' পালনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নারীর স্বাস্থ্য, স্তন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সচেতনতার দীর্ঘ ইতিহাস। সঠিক জ্ঞানের অভাবে না জেনেই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে কটু মন্তব্য করি আমরা।
যেভাবে শুরু হয়েছিল
প্রাচীন গ্রীসে নারীরা একটি বিশেষ পোশাক পরিধান করতেন। একে বলতো অ্যাপোডিসমোস যার অর্থ ‘স্তন-বন্ধনী’। এক টুকরো কাপড় সামনে থেকে স্তন যুগলকে ঢেকে পিঠ বরাবর বাঁধা হতো। সেই থেকে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য নারীদের মধ্যে বক্ষবন্ধনীর প্রচলন হয়। বর্তমান বিশ্বে প্রতিদিন কোটি কোটি মহিলা যে অন্তর্বাসটি পরিধান করে থাকেন, ইংরিজিতে সেটির নাম ‘ব্রেসিয়ার’ কিংবা ‘ব্রা’, বাংলায় বক্ষবন্ধনী। এর পেটেন্ট নথিভুক্ত করা হয় আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে, ১৯১৪ সালে।
‘নো ব্রা ডে’ এর মুভমেন্টটি শুরু হয় ২০১১ সালে, শুরুতে এটির প্রচারণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে মহিলারা হ্যাশট্যাগে ‘নো ব্রা ডে’ ব্যবহার করতেন। সিডনি রস সিঙ্গার এবং সোমা গ্রিজমজারের লেখা বই 'ড্রেসড টু কিল' এর রেফারেন্স টেনে আয়োজকেরা দাবী করেছিলেন, দিনের বেশিরভাগ সময় বক্ষবন্ধর পরে থাকায় নারীদের ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বইটিতে দাবী করা হয়েছিল যে, মেয়েদের মধ্যে যারা দিনে ১২ ঘন্টার বেশি সময় বা ২৪ ঘন্টাই ব্রা বা অন্তর্বাস পরে থাকেন, তাদের স্তন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা যারা ব্রা পরেন না তাদের চেয়ে অনেক বেশি।
অনেকেই বলেন, এই অভ্যাসের কারণেই পশ্চিমা বিশ্বের নারীদের স্তন ক্যানসার বেশি হয়। তাদের ধারণা, ব্রা পরলে স্তনের লিম্ফেটিক ড্রেইনেজ বাধাগ্রস্থ হয়, ফলে স্তনের ভেতর টক্সিন জমা হতে থাকে, যা স্তন ক্যানসারের কারণ! যদিও লেখকদ্বয় এই সিদ্ধান্তে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে পৌঁছাননি, বরং 'দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা' এবং পর্যবেক্ষনের ফলে প্রাপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নাকি তারা এসব কথা বইয়ে লিখেছিলেন।
ভুল সবই ভুল!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২০১১ সালে নো ব্রা ডে মুভমেন্ট শুরু হবার আগে খুব বেশি মানুষ এই বই সম্পর্কে জানতো না, একারনে স্তন ক্যান্সার নিয়ে সিডনি এবং সোমা যে বইয়ের ভেতর ব্যক্তিগত মতামত ঢেলে দিয়েছেন, সেটাও জানা ছিল না কারো। আলোচনায় আসার পরেই বিজ্ঞানীরা তাদের এই দাবীকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে ভুল প্রমাণিত করেন। বিজ্ঞানীরা জানান, স্তনের লিম্ফেটিক সিস্টেম স্তনের ভেতর লিম্ফ ড্রেইন করেনা, তারা স্তনের বাইরে বগলের লিম্ফনোডে লিম্ফ বা লসিকা রস নিষ্কাশন করে। যেকোন ধরনের ব্রা বা অন্য কোন আঁটসাঁট পোষাকের জন্য স্তনের ভেতর লসিকা রস ও টক্সিন জমা হয় না। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত এমন কোন নির্ভরযোগ্য গবেষণা পাওয়া যায়নি যাতে তাদের এই দাবী সঠিক প্রমাণ হয়।
সারাদিন অন্তর্বাস পরে থাকা, বা রাতে অন্তর্বাস পরে ঘুমানো, আঁটসাঁট অন্তর্বাস, বা স্পোর্টস ব্রা পরার সঙ্গে আর যাই হোক স্তন ক্যানসারের কোন যোগসাজশ এখন পর্যন্ত খুঁজে পাননি বিজ্ঞানীরা। অন্তর্বাসের চেয়েও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে যেগুলো স্তন ক্যানসারের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ। সেগুলোর মধ্যে কিছু ঝুঁকির উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রন নেই, যেমন নারী হয়ে জন্ম নেয়া, বয়স বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। আবার কিছু ঝুঁকি আমরা চাইলেই এড়াতে পারি, যেমন শারীরিক স্থূলতা, জন্মনিয়ন্ত্রনের পিল খাওয়া- এসব এড়িয়ে চললে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
ভুল থেকে যদি দারুণ কিছু হয়...
একটি ভুল ধারনা থেকে জন্ম হলেও, 'নো ব্রা ডে' মুভমেন্টটি কিন্ত ইউরোপ-আমেরিকায় দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন তো বিশ্বজুড়ে পঞ্চাশটিরও বেশি দেশে এই দিবস পালন করা হয়। ২০১১ সালে শুরুর পর প্রথম তিন বছর জুলাইয়ে নো ব্রা ডে পালন করা হলেও, পরবর্তীতে অক্টোবরের ১৩ তারিখ থেকে পালন করা হয়ে আসছে এই বিশেষ দিনটি। কারণ অক্টোবর হচ্ছে 'ব্রেস্ট ক্যান্সার এওয়ারনেস মান্থ'। স্তন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতেই মূলত এই নো ব্রা দিবস পালন করা হয়।
ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে চাইলে তো অনেক কিছুই করা যায়, নো ব্রা ডে কেন পালন করতে হবে? এরকম প্রশ্ন নিশ্চয়ই অনেকে করবেন। তাদের জন্য উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি- এই আন্দোলনটা পুরোটাই প্রতীকী। এই দিনে নারীরা বক্ষবন্ধনী না পরে বাইরে বের হবে- এটা এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য নয়, মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিটি নারী সাহস করে, জড়তা ও লজ্জা ভেঙে ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিষয়ে সচেতন হবেন। যে সচেতনতাটা বাংলাদেশের এক পার্সেন্ট নারীর মধ্যেও নেই, এমনকি উন্নত বিশ্বেও ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে নারীরা খুব একটা সচেতন নন। একজন সচেতন নারী যদি সামাজিক ট্যাবু ভেঙে আরও দশজনকে সচেতন করতে পারেন, তবেই বাড়বে সচেতনতা। কমবে ব্রেস্ট ক্যান্সারে মৃত্যুর হার।
অথচ পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর ক্যান্সারে আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে শতকরা ১.৭ ভাগই স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। বিশ্বে প্রতি ৮ জন নারীর মধ্যে ১ জন নারী তার জীবদ্দশায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। যেসব মহিলা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান না কিংবা ত্রিশ বছর বয়সের পরে প্রথম সন্তান জন্ম দিয়েছেন অথবা নিঃসন্তান, যেসব মহিলার বয়স ৩৫ বছরের বেশি কিংবা যেসব নারীর স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে অথবা যেসব মহিলা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খান- তাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
নো ব্রা ডে কোন নোংরামির মহোৎসব নয়, বরং দারুণ একটি উদ্যোগ। স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, নারীদের নিয়মিত নিজেকে নিজে পরীক্ষা করতে উৎসাহ দেয়া, স্ক্রিনিংয়ের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং স্তন ক্যানসার নিয়ে গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহ করাই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য। এই দিনে স্তন ক্যানসার আক্রান্ত রোগী, সারভাইভারসহ সকল নারীকে আহ্বান করা হয় সারা দিন ব্রা বা অন্তর্বাস না পরেই স্বাভাবিক কাজকর্মে অংশ নিতে। আর কেউ যদি সেটা করতে না চায় তাহলে অন্তত পার্পল কালারের পোশাক পরে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারেন। পুরুষরাও একই রঙের পোশাক পরে এই দিবসটি পালন করতে পারেন, পারেন স্তন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে নারীর পাশে দাঁড়াতে।
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- অ্যাওয়ারনেস ডে ডটকম, সারাবাংলা ডটকম।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন