হিউস্টন আমাদের টেক্সাসের দক্ষিণের একটি বড় শহর। আয়তনে ডালাসের চেয়েও বড়। সুমদ্রের পাশে হওয়ায় বাণিজ্য নগরী বলা চলে। লাখে লাখে মানুষের বাস সেখানে।
কয়েক বছর আগে একটি ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল সেখানে। পুরো শহর খালি করে লোকজনকে উত্তরে চলে যেতে বলা হয়েছিল। কোটি মানুষের শহর নিমিশেই ভুতুড়ে নগরী হয়ে গিয়েছিল। হারিক্যান হার্ভি এল, লোকজন না পেয়ে বাড়িঘর তছনছ করে দিল। খুব বেশি মানুষ মারতে পারল না। ১ লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার বাড়ি ধূলিস্যাৎ হলো, দশ লাখের বেশি গাড়ি আস্তাকুড়ে গেল, সেই তুলনায় একশো মানুষও মরলো না। যারা মারা গেলেন, নিতান্তই দুর্ভাগ্যের কারণে মারা গেলেন।
যাই হোক। হিউস্টন তছনছ হওয়া মানে টেক্সাসের জ্বালানি তেলের ভান্ডার লন্ডভন্ড হওয়া। ডালাসের গ্যাস স্টেশনগুলোতে নিমিষেই তেল (পেট্রল) ফুরিয়ে যেতে লাগলো। ডালাসের বাসিন্দারা তাঁদের গাড়ির উপর এতটাই নির্ভরশীল যেমনটা আমরা আমাদের দুই পায়ের উপর নির্ভর করি। এখানে গাড়ি নেই মানে আপনি পঙ্গু। আমরা হেঁটে বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ে অভ্যস্ত নই। বুঝতে পারছেন কেমন প্যানিক সিচুয়েশন তৈরী হয়েছিল শহর জুড়ে? গ্যাস স্টেশনগুলোর সামনে মাইল ব্যাপী দীর্ঘ গাড়ির লাইন। সুশৃঙ্খলভাবে সবাই তেল নিচ্ছে। কেউ কেউ গাড়ির ট্যাংক ভরেতো তেল নিলেনই, সাথে বাড়তি ক্যান ভরে ভরে তেল নিয়ে রাখলেন যাতে মজুত থাকে। কিন্তু কেউ কোন চিৎকার চ্যাঁচামেচি বা ঝগড়া করেনি। তেল ফুরিয়ে গেলে অনেকেই ছুটেছেন অন্য কোন গ্যাস স্টেশনে। যে যেখানে পেয়েছেন, ট্যাংক মজুদ করেছেন।
আমাদের কোরবানির ঈদ ছিল সে সময়ে। পশু জবাই, নামাজ, আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার চেয়েও বেশি চিন্তা ছিল গাড়ির তেল নিয়ে। যদি সেটা না থাকে, কিছুই করতে পারবো না।
এইরকম ভয়াবহ অবস্থায়ও আমাদের বাজারে তেলের দাম আকাশচুম্বি হয়নি। যা ছিল, সেই দামেই তেল বিক্রি করতে হয়েছে। এক ফাজিল মওকার ফায়দা তুলতে দুই ডলার গ্যালনের তেল এক লাফে এগারো ডলারে বিক্রির চেষ্টা করেছিল। পুলিশ এসে ব্যাটাকে ধরে নিয়ে গেছে। সাথে তার ব্যবসা বন্ধ করে গেছে। শুধু তাই না। এই যে কোটি কোটি মানুষ বাড়ি ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ভিন্ন শহরে (বেশিরভাগই ডালাস, অস্টিন, সান আন্তনিও) আশ্রয় নিয়েছিলেন, কোথাও হোটেল মোটেলের রুম ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার লাখো অসহায় মানুষের ফায়দা কিছু ব্যবসায়ী তুলতে পারবেনা। কড়াকড়িভাবে আইনের প্রয়োগ চলে।
আমাদের দেশে যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঠিক উল্টোটা ঘটে। নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুর দাম বাড়িয়ে দেই। যে মানুষগুলো এমনিতেই বাড়িঘর হারিয়ে চোরাবালিতে পড়েছে, তাঁদের আরও ঠেলে মাটি চাপা দেয়ার জন্য আমরা উঠে পড়ে লাগি।
পেঁয়াজ নিয়ে যা ইদানিং হচ্ছে, তা অসভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পেঁয়াজ আমাদের রান্নার রেসিপির একটি অংশ মাত্র, ভাতের মতন প্রধান খাদ্য নয়। অথচ এই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করতেই আমাদের দেশের বাজারে আগুন ধরে গেল। লোকে হাহাকার করে উঠলেন। যেন পেঁয়াজ ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব একটি ব্যাপার!
এই ব্যাপারটা ঘটে কোরবানির ঈদের সময়েও। ভারত গরু রপ্তানি কমিয়ে দিলেই গরুর হাটে আগুন ধরে যায়। যেন গরু কোরবানি না দিলে আমাদের ঈদই হবেনা। আমি অমুসলিম হয়ে যাব। যেই গরু আগের বছরও পনেরো হাজার টাকায় কিনেছি, একই গরু এইবার তিরিশ হাজারে কিনতে হয়েছে। পরের বছরই এই গরুর দাম পঞ্চাশ হাজার হয়েছে। এইভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বৃদ্ধির সাক্ষী আমি নিজে। এখন দেশে আঠাশ লাখে গরু বিক্রি হয়। চিন্তা করা যায়?
আমরা ভাবছি, যেহেতু এই বছর পেঁয়াজের সংকট বেড়েছে, এবং পেঁয়াজ অনেক দামে বিক্রি হচ্ছে, তাহলে অবশ্যই দেশের কৃষকরা আগামী মৌসুমে প্রচুর পেঁয়াজ উৎপাদন করবেন। দাম তখন নেমে আসবে। খুব সুখের খবরতো? না। ভারত তখন অল্প দামে নিজেদের পেঁয়াজ আমাদের বাজারে ছেড়ে দিবে। তখন আবারও দেশি কৃষকরা পথে বসে যাবে। আমরা মেরুদন্ড ভেঙে বড় ভাইয়ের লাঠি ধরার চেষ্টা করবো। আন্তর্জাতিক বাজারে এই খেলা সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই ঘটে আসছে।
এইসব ফাজলামি ততদিন চলবে যতদিন আমরা কেবল একটি দেশের উপর একটি নির্দিষ্ট উপাদানের নির্ভরশীল থাকবো। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, আপনার বাড়ির সামনের দোকানে যদি কেউ চা পাতা বিক্রি করে, এবং আপনার বাড়ির আশেপাশের পঞ্চাশ মাইল এলাকায় চাপাতা ওয়ালা কোন দোকান নেই, তাহলে যেদিন এই দোকানে চাপাতা বিক্রি হবেনা, সেদিন আপনার বাড়ির চুলায় চায়ের কেতলি চড়বে না। কিন্তু যদি ঐ একই দোকানের লাগোয়া দোকানগুলোতেও চাপাতা বিক্রি হতো, তাহলে এই ব্যাটা চা বেঁচলো কী বেঁচলো না, তাতে কার কীই বা যেত আসতো? পেঁয়াজ সহ অন্যান্য দ্রব্যাদি "কেবলমাত্র" ভারত থেকে আমদানি করে নির্ভরশীল হয়ে গেলে আমরা শেষ হয়ে যাব। আজকে পেঁয়াজে মেরেছে, কাল যদি ভাতে মারে, তাহলে ম্যাসাকার হয়ে যাবে। আমরা এমন এক জাতি, যারা ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও ভাত চালিয়ে যাই। ডায়েবেটিস হবার পরে চিনি ছাড়ি, তবু ভাত ছাড়তে পারি না। বিদেশে এসে খুব ফুর্তিতে বার্গার, স্যান্ডুইচ, পিৎজা খাই, এক সপ্তাহ ভাত না খেলে অসুস্থ হয়ে যাই। ব্যাপারটা কিন্তু আসলেই ভয়ংকর হবে।
এখন দেখা যাক পেঁয়াজের এই আকাল কেন হলো?
দেশের চাষিরা "ন্যায্য দাম" না পাওয়ায় এককালের "কৃষিপ্রধান" বাংলাদেশ আমদানিকৃত পেঁয়াজের উপর নির্ভরশীল হয়ে গেল। এখন যখন দেশে পেঁয়াজের সংকট দেখা দিল, তখন "বুদ্ধিমান ও চতুর" ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেল বাজারে আরও সংকট তৈরী করে আরও বেশি মুনাফা লুটার। গুদাম ভর্তি পেঁয়াজ রেখে ওরা পেঁয়াজের মূল্য আড়াইশো টাকা কেজি ছাড়িয়ে নিল। বস্তা বস্তা পঁচা পেঁয়াজ আস্তাকুড়ে, নদীতে ফেলার ঘটনাতো পত্রিকায় এসেছেই।
হ্যাঁ, এই খবরও পড়েছি যে মিয়ানমার থেকে নৌপথে পিঁয়াজ আনতে আনতে গরমে, এবং পানিতে পেঁয়াজ পঁচে যায়। মানলাম, এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তাই বলে গুদাম ভর্তি পেঁয়াজের ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
এই সংকট অতি সহজেই মেটানো যেত যদি সরকার "বাজার সিন্ডিকেটের" হাতে জিম্মি না হতো। কোথাও কোথাও শুনেছি সরকারি পর্যায়ের হস্তক্ষেপের কারণেই ব্যবসায়ীরা ন্যায্য মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। আফসোস। ঘটনাটি পুরো দেশে ঘটা উচিৎ ছিল।
এখন সমস্যা হচ্ছে, কিছুদিন আগেই আমরা ছাত্রলীগের তেলবাজ স্টান্টবাজ নেতা রাব্বানী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ধানের শীষ আর কাস্তে হাতে স্টান্টবাজি করতে দেখেছি। কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছিল তারা। কারণ কৃষক ন্যায্য দাম পায়না, ধান কাটার শ্রমিকের পাওনা পরিশোধে অক্ষম তাঁরা। এটি কিন্তু একটি অশনি সংকেত। ন্যায্য মূল্য না পেলে কৃষকের কোন দায় নেই বছর জুড়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ধান চাষ করবে। হয় সে অন্য লাভজনক ফসল ফলাবে, নাহয় শহরে এসে রিকশা, ট্যাক্সি চালাবে। এবং তখনই ভারতের উপর চালের জন্য আমরা পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে যাব। সেটি ঘটলে কেবল একটি বছর যদি ভারত চাল রপ্তানি করতে অস্বীকৃতি জানায়, আমরা শেষ!
সময় এসেছে প্রশাসনের একটু নড়েচড়ে বসার। ক্যাসিনো বাণিজ্য গুড়িয়ে দিতে পারলে এইসব সিন্ডিকেট গডফাদারদের চক্রকে জেলে ঢোকানো ওয়ানটু হবার কথা। ইচ্ছাশক্তিটাই আসল।
কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কৃষককে ন্যায্য মূল্য পরিশোধ করতেই হবে। কীভাবে কম পরিশ্রমে উন্নত বীজ ও সার ব্যবহারে বেশি ফসল ফলানো যায়, এই বিষয়ে চৌদ্দপুরুষের লাঙ্গল টানা কৃষকদের জ্ঞানী করতে হবে। আধুনিক সরঞ্জাম কৃষকের হাতের নাগালে মজুত রাখতে হবে। কোটি কোটি টাকা বাজেট আমাদের এখানে ওখানে খরচ হচ্ছে, কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লবের পেছনে কিছুটা খরচ করতেই হবে।
"সবকিছু জিয়ার আমলে শুরু হয়েছিল" থিওরি বাদ দিয়ে আপনাদের আমলে আপনারা কী অশ্ব ডিম্ব প্রসব করছেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করুন।
গুজবের উপর ভিত্তি করে বাঙালি নাকি এখন লবনের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে। কাউকে দোষ দেয়া যায় না। গুজব কেন বিশ্বাস করবে না? তিরিশ-চল্লিশ টাকার পেঁয়াজের দাম দুই মাসে আড়াইশো ছাড়িয়েছে, মধ্যবিত্ত কেন রিস্ক নিবে? কার ভরসায়?
একটি সুখবর পেলাম আজকে।
শুনলাম পাবনার সাঁথিয়ায় হাতে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ নিয়ে এসেছিল বিক্রি করতে। কেউ কিনতে আসেনি। দাম পড়তে পড়তে একশোর নিচে নেমে এসেছিল, তবু লোকে মুখ ফিরিয়ে তাকায়নি। ব্যাপারটা খুবই ভাল লাগলো! এইভাবে সিন্ডিকেটের মেরুদন্ড ভাঙতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে সরকারি সাহায্য আসতে আসতে আমাদের জীবন কেটে যেতে পারে। বরং ধৈর্য্য ধরে নীরব প্রতিবাদ করা ভাল। এইসব পচনশীল বস্তু নিয়ে ওরা কতদিন ফাজলামি করতে পারবে? বুদ্ধি থাকলে বস্তায় বস্তায় নদীতে ফেলার আগেই চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দিবে।