ক্যারিয়ারে দুটি মৌলিক গানের মালিক হয়ে তিনি আঙুল তুলছেন সিনিয়র শিল্পীদের দিকে, টিটকারি মারছেন! একদিন পরে আবার নির্লজ্জের মতো বলছেন তামাশা করলাম, এটা আসলে মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজি! নোবেল, আপনি শিল্পী নাকি ক্যানভাসার?

গানটা তিনি ভালো করেন, তাতে সন্দেহ নেই। ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা তার মধ্যে আছে, অল্প বয়সে সারেগামাপা'র মতো একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়েছেন, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের গান গেয়ে নিজেকে প্রমাণও করেছেন, খ্যাতি পেয়েছেন, অজস্র ভক্ত হয়েছে তার, অনুপম রায়ে কথা আর সুরে সৃজিত মুখার্জীর সিনেমায় প্লেব্যাকের সুযোগ মিলেছে। আর এতসব প্রাপ্তিতেই সম্ভবত মঈনুল আহসান নোবেলের মাথা বিগড়েছে, খবরের শিরোনাম হবার অথবা আলোচনায় থাকার অন্ধ নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে বারবার তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গালমন্দ করছেন সিনিয়র শিল্পী-গীতিকার-সুরকারদের। পরে আবার এটাকে 'মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজি' বলে পারও পেতে চাইছেন! 

গতকাল ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন নোবেল, লিখেছিলেন- “বাংলাদেশে গত ১০ বছরে ভালো করে কেউ মিউজিকই করেনি। দাঁড়াও তোমার লেজেন্ডদের না হয় আমিই শিখাবো, কিভাবে ২০২০ সালে মিউজিক করতে হয়। তোমাদের লেজেন্ড গত দশ বছর ধরে কয়টা ফ্লপ অথবা হিট রিলিজ করেছে কমেন্টস্ সেকশানে জানাও।” 

এমন আক্রমণাত্মক স্ট্যাটাস একজন শিল্পী দেবেন, এটা অনেকে কল্পনাই করতে পারছিলেন না। নোবেল এর আগেও বিতর্কে জড়িয়েছেন কয়েক দফায়, কিন্ত তবুও সবার মানতে কষ্ট হচ্ছিল। অনেকে ভেবেছেন, নোবেলের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হয়তো হ্যাক হয়েছে। কিন্ত রাতে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ফেসবুক লাইভে এসে তিনি নিজেই পরিস্কার করেছেন, পেজ হ্যাক হয়নি, তার পেজ থেকে যে পোস্ট গেছে, সেটা তারই দেয়া। 

নোবেলের ফেসবুক স্ট্যাটাস

ফেসবুকে গতকাল থেকেই সমালোচনার ঝড় চলছে, ইন্ডাস্ট্রিতে আগমনের দুই বছর হয়নি যে শিল্পীর, অন্যের গাওয়া গান আবার গেয়ে, কভার করে যিনি আজকের অবস্থানে এসেছেন, তিনি কিভাবে কিংবদন্তীদের অবদান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাদের নিয়ে টিটকারি মারেন? অনেকে নোবেলের সেই পোস্টে তাকে গালমন্দ করেছেন, কেউ কেউ সীমা লংঘন করে বাজে ভাষাও ব্যবহার করেছেন, সেটা মোটেও উচিত হয়নি। 

এতসবের পর আজ প্রথম আলোতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নোবেল নির্লজ্জের মতো বললেন, "এটি আমার তামাশা। মানে ‘তামাশা’ নামে আমার একটি মৌলিক গান আগামী মাসে আমার ইউটিউব চ্যানেল ‘নোবেলম্যান’ থেকে প্রকাশিত হবে। গানটির প্রকাশের আগে আগে একধরনের তামাশা করেই মার্কেটিং কৌশল নিয়েছি। এর বাইরে কিছুই নয়।" 

কথায় আছে, নেগেটিভ পাবলিসিটি ইজ দ্য বেস্ট পাবলিসিটি। একারণেই হয়তো ভারতীয় র‍্যাপার বাদশা'র চুরি করা গান 'বড় লোকের বেটি' কোটি কোটি ভিউ পেয়ে যায়, অনেক অসাধারণ গান এক লাখ মানুষও শোনে না। নোবেলের বয়স খুব বেশি না হলেও, প্রচারণার এই নোংরা ট্রিকসটা তিনি ভালোই আয়ত্ব করেছেন, এবং গর্বিতভাবে সেই পথে হেঁটেছেন, বেহায়ার মতো সেটা স্বীকার করতেও তার বিবেকে বাঁধছে না। 

এর আগে নোবেল প্রিন্স মাহমুদের লেখা জেমসের 'বাংলাদেশ' গানটাকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারতো বলে সমালোচনার মুখে পড়েছেন। জাতীয় সঙ্গীতের মতো স্পর্শকাতর ব্যাপারে যে যা খুশি তা বলা সাজে না- সেটা ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। জেমসের অসংখ্য গান তিনি সারেগামাপা'র মঞ্চে গেয়েছেন, কভার বানিয়ে ইউটিউবে লাখ লাখ ভিউ পেয়েছেন। সেই জেমস নাকি সারেগামাপা-তে তার কণ্ঠে গাওয়া 'পাগলা হাওয়ার তোড়ে' গানের প্রচারে বাধা দিয়েছেন! কোন প্রমাণ ছাড়াই এই অভিযোগ করেছেন নোবেল, পরেও এই সম্পর্কিত কোন প্রমাণ হাজির করেননি তিনি, অভিযোগও তুলে নেননি। 

মাঈনুল আহসান নোবেল

পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি অভিযোগের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে বসেছেন, মিথ্যে অহমিকার পসরা সাজিয়েছেন। বাংলাদেশের কারো সঙ্গে কখনও ডুয়েট গান করবেন না, শ্রেয়া ঘোষাল আর লেডি গাগা ছাড়া আর কারো সঙ্গে ডুয়েটে গাইতে চান না, তার গানের সঙ্গীতায়োজন করার মতো প্রতিভা বাংলাদেশে নেই- নোবেলের এসব কথাবার্তাগুলো অযথা বিতর্ক উস্কে দেয়া ছাড়া আর কোন কাজেই আসেনি। নোবেল নিজেও তা জানেন জেনেশুনেই তিনি এসব বলেছেন, যাতে বিতর্ক হয়, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি থাকতে পারেন। 

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে নোবেল নিশ্চয়ই চিনবেন। সর্বকালের সেরাদের একজন তিনি, লিওনেল মেসির সাথে তার দ্বৈরথের কারণে গত একযুগ ধরে ফুটবলটা অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে দর্শকদের কাছে। মানুষ হিসেবে মেসি ভীষণ বিনয়ী, রোনালদো আবার উদ্ধ্বত। তিনি বরাবরই নিজেকে সেরা হিসেবে দাবী করেন, সঙ্গে এটাও বলে দেন, এই যে সেরা হবার চ্যালেঞ্জটা, নিজেকে সেরা হিসেবে দাবী করা- এগুলো তাকে বাড়তি অনুপ্রেরণা দেয় বাকীদের ছাপিয়ে যাওয়ার। 

নোবেল যদি নিজেকে সেরা হিসেবে দাবী করতেন, বিশাল এই লেখাটা লেখার কোন দরকারই হতো না। নিজেকে সেরা ভাবার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্ত বাকীদের টিটকারি মারাটা অন্যায়। রোনালদো নিজেকে সেরা বলার সময় কখনও বলেন না যে মেসি ফুটবল খেলতেই পারে না, নেইমার তো শুধু মাঠে গড়াগড়ি খায়! যিনি সেরা, তিনি নিজেকে নিয়ে কথা বলবেন, নিজেকে নিয়েই মগ্ন থাকবেন- এটাই স্বাভাবিক। 

আর নোবেল সেখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সিনিয়র শিল্পীদের দিকে মিথ্যে অভিযোগের আঙুল তুলে অহমিকার সাগরে ভাসছেন। গত দুই বছরে যার অর্জন কেবল দুটো মৌলিক গান, তিনি যখন যুগ যুগ ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা শিল্পী-সুরকারদের অবদান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন অবাক হতে হয়। আরও অবাক হওয়া লাগে, যখন নোবেল নিজেই স্বীকার করেন যে, নিজের গানের মার্কেটিং করার জন্যেই এই নোংরা খেলায় মেতেছেন তিনি! এই জঘন্য মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজিটা নোবেলকে কে শিখিয়েছে আমার জানতে ইচ্ছে করে। নোবেল, আপনি শিল্পী হতে এসেছিলেন জানতাম, ক্যানভাসার হওয়াটা যে আপনার লক্ষ্য ছিল, সেটাও জানিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা