বিলিয়ন মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেওয়া এক মহামানবের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
৯৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই ভদ্রলোক মানবজাতির জন্য যে অবদান রেখে গেছেন, তা কজন জানি আমরা? যুদ্ধবিগ্রহে পূর্ণ অভিশাপময় দুনিয়ায় তাঁর মতো মহামতিরাই বিজ্ঞানের আশীর্বাদের গল্প লিখে যান...
ষাটের দশকেই মানুষ বুঝতে শুরু করে- যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে পৃথিবীতে প্রতি মূহুর্তে, প্রথাগত কৃষি পদ্ধতিতে সেই হারে ফসল জন্মানো বাড়ানো যাচ্ছে না। অচিরেই ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা যাবে। বিলিয়ন মানুষ মারা যাবে খাদ্যের অভাবে। ১৯৬০ সালে FAO নামক একটি সংস্থা “World Food Congress” নামে একটি সম্মেলনও আয়োজন করে, যার প্রতিপাদ্য ছিলো- “Freedom from hunger”। সেই সম্মেলন থেকে সারা পৃথিবীর কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রতি আকুল আবেদন করা হয়, যেন যত দ্রুত সম্ভব উচ্চ ফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধী নতুন জাত আবিষ্কার করা হয়।
মানবজাতির ভাগ্য ভালো, নরম্যান বরলাগ নামক এক মহামতি সেই সময়ই তার কলিগদের নিয়ে কাজ করছিলেন ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই! বরলাগের জন্ম ১৯১৪ সালে, আমেরিকার আইওয়াতে এক নরওয়েজিয়ান আমেরিকান নেইবারহুডে। তার পূর্বপুরুষেরা নরওয়ে থেকে এসেছিলো আমেরিকায়। ছোটবেলায় তিনি পারিবারিক ফার্মে কাজ করেছিলেন অনেক বছর। ফসল ফলানো ব্যাপারটা তাই ছিলো তার রক্তেই! কিন্তু তিনি বাপ দাদার মতো কৃষক হতে চাননি। তার নানার একটা কথা তার মাথায় গেঁথে গিয়েছিলো, “জ্ঞানীরা আগে মাথা ভরে যাতে পরে পেট ভরতে কোন সমস্যা না হয়”।
মজার ব্যাপার হলো, সর্বকালের অন্যতম সেরা এই কৃষিবিদ ইউনিভার্সিটি অফ মিনোসোটারে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণই হতে পারেননি! অবশ্য তখন তিনি সদ্যই খোলা দুই বছরের কলেজ প্রোগ্রামে টিকে যান, এবং যেখান থেকে কিছুদিন পর ট্রান্সফার হয়ে যান ইউনিভার্সিটির আন্ডারে “কলেজ অফ আগ্রিকালচারাল ফরেস্ট্রি”- তে। সেখান থেকে ১৯৩৭ সালে ব্যাচেলর্স, ১৯৪০- এ মাস্টার্স এবং ১৯৪২ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। এর মধ্যে উনি ১৯৩৫ সালে কিছুদিনের জন্য পড়াশুনার খরচ জোগানোর জন্য “সিভিলিয়ান কনজারভেশন কর্পস” এর লিডার হিসেবে ক্ষুধার্ত মানুষের সাথে কাজ করেন। খাদ্যের অভাব মানুষের উপর কী প্রভাব ফেলে সেটা তিনি খুব কাজ থেকে দেখেন এবং তার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তবে তার জীবন বদলে দিয়েছিলো এলিভিন চার্লস স্টাকম্যান নামক মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির প্ল্যান্ট প্যাথোলজির এক প্রফেসরের একটা লেকচার।
গমের শত্রু ফাংগাস ঘটিত এক রোগের প্রতিকার নিয়ে ছিলো সেই লেকচার। বরলাগ তখন বিএসসি শেষ করে বন বিভাগে চাকরি করছেন। বাজেট ঘাটতির কারণে চাকরি থেকে ছাটাই হলে তিনি এসে এই প্রফেসর স্টাকিম্যানের আন্ডারেই মাস্টার্স ও পিএইচডি করেন। নিজের সাবজেক্ট ফরেস্ট্রি থেকে চলে আসেন “প্ল্যান্ট প্যাথলজিতে”।
বড় বিচিত্র ছিলো এই বরলাগ লোকটার জীবন। ভার্সিটি দলের হয়ে ফুটবল, কুস্তি খেলতেন। বিয়ে করেছিলেন ভার্সিটি জীবনে হোটেলে ওয়েটারি করতে গিয়ে পরিচয় হওয়া এক মেয়েকে, পরে যার সাথে আমৃত্যু সংসার করেছেন ৬৯ বছর ধরে! পিএইচডি লাভ করার পর ডেলওয়ারের ডুপন্ট কম্পানিতে মাইক্রোবায়োলজিস্ট হিসেবে যোগ দেন ছত্রাকনাশক, ব্যাকটেরিয়ানাশক তৈরী করতে। কিন্তু ১৯৪১ সালে জাপান পার্ল হারবারে আক্রমণ করলে তিনি যুদ্ধে যোগ দিতে যান। অবশ্য কিছু জটিলতায় তাকে তখন সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়নি। এরপর তিনি সেনাবাহিনীর জন্য বিভিন্ন নতুন জিনিস আবিষ্কারে গবেষণা শুরু করেন। এদিকে মেক্সিকান সরকার ও আমেরিকার বিখ্যাত রকেফেলার ফাউন্ডেশন শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য একটা গবেষণা প্রজেক্ট চালু করে যেখানে বরলাগকে আমন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু যুদ্ধে কাজ করার জন্য সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন বরলাগ।
আবার ১৯৪৪ সালে ডুপন্ট কম্পানির দ্বিগুন বেতনের প্রলোভন অস্বীকার করে গর্ভবতী স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে রেখে হঠাৎই মেক্সিকো চলে যান সেই রিসার্চ টিমে কাজ করতে! মেক্সিকোর শুরু সময়টা খুবই কঠিন ছিলো। স্থানীয় কৃষকরা বন্ধুভাবাপন্ন ছিলো না। গতানুগতিক বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে গিয়ে তার প্রস্তাবিত নতুন চাষ পদ্ধতি প্রজেক্ট নেতা ড. হারার নাকচ করে দিলে তিনি ইস্তফাও দেন। পরে অবশ্য স্টাকম্যান এসে পরিস্থিতি সামলান। দেখা গেলো বরলাগের উদ্ভাবিত পদ্ধতি কাজ করছে। তিনি ফাংগাস প্রতিরোধী জাত জিনেটিক ক্রসিং করে তৈরী করেন। কিন্তু তার বৈপ্লবিক আবিষ্কার ছিলো, ছোট কান্ডের গমের জাত তৈরী করা।
পিটিক ৬২ এবং পেনজামো ৬২ নামক খাটো কান্ড বিশিষ্ট তার আবিষ্কৃত দুইটি জাত ১৯৬৩ সালে মেক্সিকোর ৯৫% জমিতে চাষ হয় এবং ফসল উৎপাদন ৬ গুন বেশি হয় ১৯৪৪ সালের তুলনায়! খাটো কান্ডের সুবিধা হলো- অধিক পরিমাণ শস্য বহন করতে পারে, ভেংগে পরে না ভারে। বরলাগ মেক্সিকো থাকতে থাকতেই সেই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেলো!
এখানেই শেষ নয়! ১৯৬৩ সালে রকেফেলার ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বরলাগকে ভারতে পাঠানো হয়। তার আবিষ্কৃত এই উচ্চফলনশীল জাত উপমহাদেশেও কাজ করে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখতে। এখানেও পোহাতে হোলো বহু ঝামেলা। ১৯৬৫ সালে ৪৫০ টন বীজ আনার চেষ্টা করা হলো মেক্সিকো থেকে। সেই বীজ বিভিন্ন সীমান্তে, কাস্টমসে আটকে পড়ে রইলো। ভারতের জন্য ২০০ টন আর পাকিস্তানের জন্য ২৫০ টন। পাকিস্তানের পাঠানো ১ লাখ ডলারের চেক আটকে গেলো। এদিকে সেই সময় কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ লেগে গেছে! বরলাগ পাকিস্তানের কৃষিমন্ত্রীর কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেলেন, “চেক আটকে গেছে বলে আমি দুঃখিত কিন্তু আমার নিজের উঠানে বোমা পড়ছে, টাকা ব্যাংকে আছে”।
তবে এত ঝামেলার পরও বরলাগ বীজ আনিয়েই ছাড়লেন এবং হাতে পাওয়া মাত্র বপন করা শুরু করলেন। এমনকি বোমা বিস্ফাোরিত আলোর মধ্যেই! সপ্তাহখানেক পর বরলাগ আবিষ্কার করলেন বীজের অংকুরোদগম স্বাভাবিকের তুলনায় অর্ধেক হচ্ছে! কারণ, আমিদানির সময় দেরি হচ্ছিলো, স্টোরেজে কীটনাশকের সংস্পর্শে বীজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো কোন গুদামে। উনি সাথে সাথে নির্দেশ পাঠান যেন বীজ দ্বিগুন করে বোনা হয়। বরলাগের প্রাথমিক ফলাফলই অভাবনীয় হলো। এই উপমহাদেশের ইতিহাসে তখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ফসল জন্মালো সে বছর।
পরের বছরই পাকিস্তান ৪২০০০ টন এবং ইন্ডিয়া ১৮০০০ টন বীজ আমদানি করলো বরলাগের উদ্ভাবিত জাতের। আর যেন ম্যাজিকের মত, ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮- এই তিন বছরের মধ্যে পাকিস্তান খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে গেলো, তবে ভারতের লাগলো ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত! এই বাড়তি শস্য উপমাহাদেশের চেহারাই বদলে দিলো। এমনও অবস্থা হলো, স্কুল বন্ধ করে সেই বিল্ডিং গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতে হয়েছিলো। United States Agency for International Development বরলাগের এই অবদানকে “সবুজ বিল্পব” হিসেবে ঘোষণা করলো।
১৯৭০ সালের এক ভোরে নরমান বরলাগের বাসায় একটা ফোন আসলো। ঘড়িতে তখন ৪টা বাজে। কাজ পাগল মানুষটা অত সকালেই ৪০ কিলোমিটার দূরে মাঠে চলে গেছেন। তখন নরওয়ে থেকে ফোন এসেছে মেক্সিকোতে! বলা হচ্ছে, তিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন সেই বছর। বরলাগের স্ত্রী সোফারকে নিয়ে গাড়ি ছুটালেন বরলাগের মাঠের দিকে, প্রথমে শুনে বিশ্বাসই করতে পারলেন না। ভাবলেন মজা করছে সবাই। নোবেল নেওয়ার সময় দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বার বার মনে করিয়ে দিলেন, তার এই কাজ হয়তো কয়েক যুগের জন্য মানুষকে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস দিবে, কিন্তু “জনসংখ্যার বিস্ফোরণ” নামক যে ভয়াবহ দানব বড় হচ্ছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে একসময় সভ্যতার উপর ভয়াবহ বিপদ নেমে আসবে।
নোবেল পাওয়ার পর বরলাগ তার গবেষণার ব্যাপ্তি আরো বাড়িয়ে দেন। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, পুরো কর্মজীবনে উনি কম সমালোচনা, বাধা সহ্য করেন নি। আফ্রিকায় কাজ করতে গিয়েও পরিবেশবাদীদের প্রবল বাধার মুখে পড়েন তিনি, তার পদ্ধতি নাকি প্রকৃতির বিরুদ্ধতা। পরে অবশ্য ইথিওপিয়ায় দুর্ভিক্ষ শুরু হলে ঠিকই তার কাছে সরাপন্ন হয়, তার পদ্ধতি ব্যবহার করেই আফ্রিকায় খাদ্য সংকট নিরসন হয়। কিন্তু আফ্রিকায় এশিয়া উপমহাদেশের মত কোন সুবিধাই পাননি তিনি। তারপরও লড়াই থামেনি। একসময় ঠিকই ইথিওপিয়ার উৎপাদন ৩২% বাড়িয়ে ছেড়েছেন।
বরলাগ তার সমালোচনাকারীদের একদম ছক্কা পিটিয়ে ডিসমিস করে দিয়েছেন এই বলে, “ওয়াশিংটনে আর ব্রাসেলসের এসি অফিসে বসে বড় বড় কথাই বলা যায়, ঐসব নাক উঁচু পরিবেশবাদীরা কোন দিন ক্ষুধা আসলে কি অনুভব করেনি। আমার মত ৫০ বছর না, এদের ধরে একমাস কোন অনুন্নত দেশে থাকতে দিলেই তারা ট্রাক্টর, সার, সেচ ব্যবস্থা- এসবের জন্য কান্না কাটি শুরু করতো। আর ক্ষোভে ফেটে পড়তো তাদের মতই আরাম আয়েশে থেকে বড় বড় বুলি ছাড়া সমাজের উঁচু তলার লোকদের বিরুদ্ধে!'
এই মহান বিজ্ঞানী ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কর্ম চঞ্চল ছিলেন। অতিথি শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করাতেন। “World food prize” নামক একটি পুরষ্কার চালু করেন তিনি, ক্ষুধার বিরুদ্ধে আরো যারা লড়াই করছে তাদের পুরষ্কৃত করার জন্য। আর উনি সারা জীবন নোবেল পুরষ্কারের বাইরেও আরো কত অসংখ্য পুরষ্কার সম্মাননা পেয়েছেন তা নিয়ে লিখতে গেলে আলাদা আরেকটা লিখা লিখতে হবে। মানব জাতিকে ভয়াবহ বিপর্যয়- ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচানোর লড়াইয়ের এই অগ্র সৈনিকের পুরো জীবনটাই অসংখ্য অনুপ্রেরণার গল্প। যুদ্ধবিগ্রহে পূর্ণ অভিশাপময় দুনিয়ায় বরলাগের মতো মহামতিরাই বিজ্ঞানের আশীর্বাদের গল্প লিখে যান।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন