"আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি নিখিল বন নন্দনে, ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা জীবন জাগে স্পন্দনে। লক্ষ আশা অন্তরে ঘুমিয়ে আছে মন্তরে ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি পাতার বন্ধনে।"

কবি গোলাম মুস্তফার লেখা 'কিশোর' কবিতার এই চরণগুলো আমাদের কাছে ভিন্নকিছু গুরুত্ব বহন করে। কারণ শিশু-কিশোরভিত্তিক প্রতিভা অন্বেষণের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান 'নতুন কুঁড়ি'র সূচনা সঙ্গীত ছিল এটি। 'নতুন কুঁড়ি' বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে এক অতি পরিচিতি নাম, সবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই অনুষ্ঠানে। শুক্রবার সকাল মানেই আগ্রহ সহকারে বিটিভির সামনে বসে পড়া, একে একে আসতো প্রতিযোগীদের প্রতিভা।

কখনো গল্প বলায়, কখনো গানের সুরে কিংবা নৃত্যের ঝংকারে, থাকতো ছবি আঁকা সহ আরও অনেক কিছু। নতুন কুঁড়ির যাত্রা ১৯৭৬ সালে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে এই শিশু-কিশোরভিত্তিক প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান তৈরি হয়, প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন মুস্তফা মনোয়ার।

সারা দেশ থেকে জেলা অনুযায়ী প্রতিযোগীরা এই অনুষ্ঠানে আসতেন। প্রথম রাউন্ড পার হবার পর দ্বিতীয় রাউন্ডে যারা আসতো, তাদের পারফর্মই টিভিতে দেখানো হতো। নতুন কুঁড়িতে বিষয় ছিল গল্প বলা, ছবি আঁকা, দেশাত্মবোধক গান, পল্লীগীতি, একক অভিনয়, সাধারণ নৃত্য, লোক নৃত্য, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও নৃত্য, ক্বেরাত, দলীয় নৃত্য ও অভিনয়সহ মোট ২০টি বিভাগে ৩৫টি শাখায়।

দলীয়গুলো বাদে প্রতিটি বিভাগে ছিল দুটি করে শাখা। 'ক' শাখায় বয়সের মাপকাঠি ছিল ৬-৯ বছর এবং 'খ' শাখায় ছিল ১০-১২ বছর। পুরো বছরজুড়ে অনুষ্ঠিত এই রাজ অনুষ্ঠানের কার্য হত রামপুরার বিটিভির ভবনে। বিভিন্ন বিভাগ থেকে আগত নিজ নিজ বিভাগে গুরুরা থাকতেন বিচারকের আসনে। বলা বাহুল্য- নতুন কুঁড়ির বিচারকার্য নিয়ে সবাই সন্তুষ্ট ছিলেন, সেভাবে কোনো কথা উঠেনি। বছর শেষে যেকোনো একদিন সরকার প্রধানেরা বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতেন।

জনপ্রিয় অভিনেত্রী তিশাও নতুন কুঁড়ির প্রতিযোগী ছিলেন

পাশাপাশি দুটি বিভাগে দুইজনকে চ্যাম্পিয়ন বানানো হত, শর্ত থাকতো অন্তত তিনটি বিভাগে প্রথম হতে হবে। প্রতিভা অন্বেষণমূলক অনুষ্ঠান বা রিয়েলিটি শো যাই বলা হোক না কেন, সেটাকে তখনই সাফল্যমন্ডিত বলা যায়, যখন প্রতিযোগীরা পরবর্তীতে নিজ নিজ প্রতিভায় নিজেকে অনন্য করে তোলেন, সফল হন নিজ কার্যে। এই ক্ষেত্রে নতুন কুঁড়ির জুড়ি নেই, এখনকার অনেক প্রতিযোগীই পরবর্তীতে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে জনপ্রিয় হয়েছেন।

তেমনি কিছু উদাহরণ আসলে বলা যায়- সঙ্গীত জগতের দুই জনপ্রিয় গায়িকা কনকচাঁপা ও সামিনা চৌধুরী সেই সত্তর দশকে নতুন কুঁড়ির প্রতিযোগী ছিলেন, উনারা আজ দেশের জনপ্রিয় গায়িকাদের মধ্যে অগ্রতম। বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও প্রাক্তন মন্ত্রী তারানা হালিমও ছিলেন সত্তর দশকের প্রতিযোগী।

আশির দশকে আগমন ঘটে এক ঝাঁক শিশু-কিশোরদের। এর মধ্যে অভিনেত্রী ঈশিতা সেই কিশোর বয়সে দেখিয়েছিলেন এক অভিনব প্রতিভা। ১৯৮৬ সালে 'ক' শাখায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আবার ১৯৯১ সালে 'খ' শাখায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে নজির স্থাপন করেন। পরবর্তীতে অভিনয় জগতে এসে দর্শকপ্রিয় হয়েছেন।

১৯৮৬ সালে 'খ' শাখায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন জনপ্রিয় টিভি অভিনেত্রী তারিন। এছাড়া তমালিকা কর্মকার, মেহের আফরোজ শাওন, চিত্রশিল্পী ফিরোজ মাহমুদ- এরাও ছিলেন প্রতিযোগী। ১৯৯৫ সালে 'খ' শাখায় চ্যাম্পিয়ন হন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয়তম অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা, এছাড়া ছোট্ট মীম খ্যাত সাবরিন সাকা মীমও ছিলেন সেই বছরের প্রতিযোগী।

টক-শোর সাহসী সঞ্চালক নবনীতা চৌধুরীও ছিলেন নতুন কুঁড়ির প্রতিযোগী, তিনি অংশগ্রহণ করেন ১৯৯১ সালে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী চাঁদনী ও জাকিয়া বারী মমরাও নতুন কুঁড়ির প্রতিযোগী। এছাড়া ডাক্তার ও গায়িকা ঝিনুক, ডাক্তার ফারিয়া তিলাত লোপা, সাবরিন নিসা, গায়িকা রন্টি দাশ, অপর্ণা ঘোষসহ অনেকেই আছেন।

নতুন কুঁড়িতে নবনীতা চৌধুরী

২০০২ সালে দুই বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন মালিহা বিনতে আতিক প্রমি ও মেহরাব হক তুষার। প্রমিকে শিশুশিল্পী অবস্থায় অভিনয় করতে দেখা গেছে, অন্যদিকে তুষার এই সময়ের একজন জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী, চ্যানেল আইয়ের সেরা নাচিয়েতেও প্রথম হয়েছিলেন। ২০০৩ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন খালিদা সুলতানা সুরভী, আরেকজন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন বিদ্রুপ পুর কায়স্থ টুটুল, যিনি বর্তমানে একজন সরকারী চিকিৎসক।

২০০৪ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়া শুভ তালুকদারও ডাক্তার, পড়াশুনা করছেন নোয়াখালী মেডিকেল কলেজে। আরেকজন মৌমিতা তাসরিন নদী, এই সময়ের একজন উদীয়মান গায়িকা, চ্যানেল আইয়ের সেরা কন্ঠতেও ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। ২০০৫ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন এস এম তাকিউর রহমান ও অনন্যা বনিক। তথ্যের অপ্রতুলতায় সব বছরের চ্যাম্পিয়নদের নাম জানা যায়নি, উইকিপিডিয়াতে এর থেকে আরও কম তথ্য দেয়া। 

হালের জনপ্রিয় গায়িকা পূজা ও পড়শী দুইজনই নতুন কুঁড়ির প্রতিযোগী ছিলেন। বাঁধন সরকার পূজা তো একাধিকবার অংশগ্রহণ করেন, শেষবার উপস্থাপনাও করেছিলেন। তার ছোট বোন নন্দিতা সরকার পিয়াও ২০০৫ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির স্মৃতিচারণ থেকেও জানা যায়, তিনিও নতুন কুঁড়িতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তবে প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে যান। শিশুশিল্পী হিসেবে পরিচিত উপমা ও ফাহাদ এরাও নতুন কুঁড়ির প্রতিযোগী। ২০০৫ সালে ফাহাদ দুইটি শাখায় পুরস্কার পেয়েছিল।

এছাড়া নৃত্যশিল্পী তাহমিনা আনোয়ার আনিকা একাধিকবার অংশগ্রহণ করেছিলেন,গায়িকা পল্লবী রায় তনু, নৃত্যশিল্পী স্মিতা দে, গায়ক সাবাব হোসেন কবিসহ অনেকেই মোটামুটি মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছেন। খোঁজ নিলে আরও বেরিয়ে আসবে নিশ্চিত, যারা এখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল।

১৯৭৬ সালে যাত্রা শুরু হয়ে বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। সরকার পরিবর্তন হলে রাজনৈতিক বিবেচনার জন্য এই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে আবার সরকারের রদবদল হলে ২০০২ সাল থেকে আবার শুরু হয় নতুন কুঁড়ি, যা চলে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। এরপর বন্ধ হয়ে যায়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনার জন্য আর চালু হয়নি এই মেধার আবিষ্কার করা এই অনুষ্ঠানটি।

এটির বন্ধ হওয়া নিয়ে সবাই আক্ষেপ করতেন, সবাই চাইতেন এটি চালু হোক। অবশেষে সম্প্রতি আশার আলো দেখিয়েছে বিটিভি, আবার শুরু হচ্ছে নতুন কুঁড়ি। বিটিভির সেই সুবর্ণ সময় নেই, অনেকেই বলছেন- আসবে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। তবুও নতুন কুঁড়ির আবার প্রত্যাবর্তনে সবাই খুশি, আবার শুক্রবার সকালে বিটিভির পর্দায় সবাই আগ্রহ সহকারে দেখবে প্রতিযোগীর প্রতিভা। বিচারকার্য হবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে, সেই প্রত্যাশাই রইলো।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা