তোমরা যাও, তোমাদের বাঁচতে হবে। এ দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। আর আমি যাব না, যাওয়া সম্ভবও না। সবাইকে যেতে হলে সবাইকে মরতে হবে। দেশের জন্যই তোমাদের বাঁচতে হবে। এখন যাও। এটা আমার অর্ডার।

সেপ্টেম্বর ১৯৭১। হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে বাঙালি আপামর জনতার মুক্তিবাহিনী। এখন আর যুদ্ধটা শুধুই প্রতিরোধের না। এখন প্রতিরোধের পাশাপাশি শত্রুমুক্ত করা। আট নম্বার সেক্টরের একটা কোম্পানি সে সময় যুদ্ধ করছে যশোরে। এ কোম্পানির একটা স্থির সেনা টহল রাখা হয়েছে গোয়ালহাটি গ্রামে। অধিনায়ক করা হয়েছে বহু বছর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কাজ করা ৩৬ বছর বয়সী এক যুবককে, যে নিজেই যেন একটা দূর্গ! মাত্র চারজন সৈন্য নিয়ে নজর রাখছেন পাকিস্তানি ঘুঁটিপুর ঘাটির দিকে। যেখানে বাঙালি মারার ছক করে জড়ো হয়েছে বহু নরদানব। 

৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে এই স্থির সেনা টহলের অধিনায়ক ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ নজর রাখছিলেন পাকিস্তানিদের গতিবিধির উপর। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম খেল, পাকিস্তানিরা টের পেয়ে গেল তাদের অবস্থান। পাকিস্তানিরা তিনদিক থেকে পরিকল্পিত আক্রমন শুরু করলো। নূর মোহাম্মদ ভাবছেন কী করবেন। তার হাতে মাত্র চার জন সৈন্য আর অস্ত্র বলতে সিপাহি নান্নু মিয়ার হাতে একটা হালকা মেশিনগান আর সবার হাতে রাইফেল। এই অল্প কয়টা সাধারন অস্ত্র দিয়ে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে আটকানো অসম্ভব।

তাকে বাঁচতে হলে পিছু হটতে হবে। তাতে হয়তো ক্যাম্প পর্যন্ত যাওয়া যাবে এবং আক্রমন করা যাবে শত্রুর উপর। কিন্তু তাতে শত্রু জেনে যাবে তাদের অবস্থান, এতে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা মারা যাবেন। নিজের জীবন থাকতে এ কাজ কি কখনো হতে দেয়া যায়? এত সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তিন দিক থেকে সমানতালে বৃষ্টির মতো বুলেট আসা শুরু হলো। শুরুতেই সিপাহি নান্নু মিয়ার শরীর বুলেটে ঝাঁজরা হলো। আহত হলো নান্নু মিয়া। আহত নান্নু মিয়ার শরীরটা যেন নূর মোহাম্মদের শরীরে এক দেবতার শক্তি দিলো। এক হাত দিয়ে নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে অন্য হাতে নান্নু মিয়ার মেশিনগানটা দিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে লাগলেন। কিছুক্ষনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল হতবাক পাকিস্তানিদের বন্দুক। এ সুযোগে নূর মোহাম্মদও নান্নু মিয়াকে নিয়ে আশ্রয় নিলেন গাছের আড়ালে।

এবার নূর মোহাম্মদ ভাবলেন কিছুটা পরিকল্পনা করে আক্রমণ করা দরকার। তাতে হয়তো শত্রুপক্ষকে কিছুটা বেশি সময় আটকে রাখা যাবে। এবার নূর মোহাম্মদ নান্নু মিয়ার মেশিনগানটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ এক গাছের আড়াল থেকে ফায়ার করেন, পরে আবার দ্রুত অন্য গাছের আড়ালে চলে যান। সেখান থেকে আবার ফায়ার করেন। এই দেখে পাকিস্তানি মেশিনগানগুলোর ঝাঁজ কমে আসে। তারা ভাবে, বাঙালি সৈন্য এখানে নেহায়েত কম নয়। এবং তাদের হাতের অস্ত্রও প্রচুর শক্তিশালী, আর এ সুযোগেই নূর মোহাম্মদ আহত নান্নু মিয়া আর বাকিদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছিলেন।

কিছু দূর যেতেই একটা বিশ্বাসঘাতক মর্টার শেল এসে পড়ে নূর মোহাম্মদের সামনে। স্প্লিন্টারের আঘাতে হাটু ভেঙে গেল নূর মোহাম্মদের। কাঁধে হলো একটা বিরাট ক্ষত। মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি। রক্তে ভিজে গেল মাটি।নূর মোহাম্মদ বুঝলেন মৃত্যু আসন্ন। সিপাহি মোস্তফা কামালকে ডেকে বললেন, 'আমার কিছু হলে তুমি এই সেনা টহলের অধিনায়ক নির্বাচিত হবে। আহত নান্নু মিয়াকে নিয়ে পিছু হটে যাও'। এই বলেই নিজের এল.এম.জি টা মোস্তফা কামালকে দিয়ে নিজে নিলেন মোস্তফা কামালের এস.এল.আরটা। তারপর আবারো বলতে লাগলেন, 'আমি এখান থেকে রাইফেল চালাব, তোমরা অন্যদিক দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকবা। যতক্ষণ বেঁচে আছি শত্রুর নজর আমার দিকে রাখবো। তোমরা যাও, ক্যাম্পে খবরটা দিও'। 

এবার মোস্তফা কামাল বলে উঠলো- 

- কিন্তু আপনাকে এ অবস্থায় ফেলে যাই কেমনে? 
- না না, তোমরা যাও। তোমাদের বাঁচতে হবে। এ দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। আর আমি যাব না, যাওয়া সম্ভবও না। সবাইকে যেতে গেলে সবাইকে মরতে হবে। দেশের জন্যই তোমাদের বাঁচতে হবে। এখন যাও। এটা আমার অর্ডার। 

তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে পারল না বাকিরা। সবাই আস্তে আস্তে চলে গেল নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। একা পড়ে রইলেন নূর মোহাম্মদ। হাতে একটা সামান্য এস.এল.আর। ঠোটের কোনে একটা নির্লিপ্ত হাসি লেপ্টে নির্ভীক গুলি করে যাচ্ছেন। হতবিহবল পাকিস্তানিরা। এ এক অসম যুদ্ধ। অসংখ্য আধুনিক অস্ত্রের সাথে সামান্য এস.এল.আরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ শুধু মনের জোরেই করা যায়। তাই নূর মোহাম্মদের বাকি সৈন্যরা চোখের আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ঠেকিয়ে রাখলেন পাকিস্তানিদের, ভূলুণ্ঠিত হওয়া অবস্থাতেই। আস্তে আস্তে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসলো। এস.এল.আর টার ভার আর নিতে পারছেন না। হাতগুলোতেও আর শক্তি পাচ্ছে না। চিরনিদ্রায় চলে গেলেন তিনি। 

এক ঘন্টা পরে মুক্তিবাহিনী সুসজ্জিত হয়ে উপর্যুক্ত পরিকল্পনা নিয়ে শত্রুদের উপর হামলা করল। বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের প্রবল তোপের পাকিস্তানীদের সব প্রতিরোধ যেন খড়কুটোর মত উড়ে যেতে লাগল। ভয়ে পালিয়ে গেল নিজেদের ওয়ার্ল্ডের দ্বিতীয় বেস্ট সোলজার বলা পাকিস্তানিরা। এলাকা শত্রুমুক্ত হবার পর প্রিয় সহযোদ্ধারা তাদের প্রিয় নূর মোহাম্মদকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথায় তিনি? কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সহযোদ্ধারা ভাবলো হয়তো আহত নূর মোহাম্মদকে পাকিস্তানিরা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। অনেকটা সময় পর এক ঝোপের ভেতর পাওয়া গেল ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদের লাশ।

পাকিস্তানি হায়েনারা কাউকে না পেয়ে এবং তার কারণে তাদের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় সমস্ত ক্ষোভ দেখিয়েছে নূর মোহাম্মদের নিথর দেহটার উপর। বেয়নেট দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করেছে পুরো শরীর। তাতেও যখন হায়েনাগুলোর মন ভরেনি, তখন তারা প্রবল আক্রোশে উপড়ে ফেলেছে জ্বলজ্বল করা এই বাংলার বাঘের দুটি চোখ। 

মাস কয়েকের মধ্যে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশের সরকার ১৯৭৩ সালের গেজেটে নূর মোহাম্মদকে স্বাধীনতার যুদ্ধে বীরত্বের সর্বোচ্চ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। বলছিলাম আমার নিজের খুব পছন্দের সুপারহিরো বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখের কথা। বছর ঘুরে ৫ই সেপ্টেম্বর আসে। এই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান নূর মোহাম্মদ শেখের মৃত্যুবার্ষিকী। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ আমাকে বারবার শুধু মনে করিয়ে দেয় বুকে অসীম সাহস আর ভালবাসা থাকলে জয় করা যায় মৃত্যুকে, হাসতে হাসতেই জয় করা যায়।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা