অপারেশন গঙ্গাজল: ভারত কাঁপিয়ে দেওয়া এক অবর্ণনীয় অধ্যায়
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
অপরাধী ধরা পড়লেই তার চোখ ফুটো করে দেয়া হচ্ছে সাইকেলের স্পোক পাইপ দিয়ে, সেই ফুটো দিয়ে ঢেলে দেয়া হচ্ছে অ্যাসিড! ছিঁচকে চোর থেকে কয়েক খুনের আসামী- সবার এক শাস্তি! আসলেই কি অপরাধ দমন, নাকি অন্য কিছু?
ইন্দিরা গান্ধী বসে আছেন তার অফিসে, রাগে টকটকে লাল হয়ে আছে তার মুখ। টেবিলের ওপাশে বসা কেন্দ্রীয় পুলিশ প্রধান আর বিহারের রাজ্য পুলিশের দুজন হর্তাকর্তার দিকে তাকিয়ে অগ্নিদৃষ্টি হানলেন তিনি। তারপর বললেন, 'এরকম ঘটনা যাতে আর একটাও কানে না আসে আমার। বন্ধ করার ব্যবস্থা নিন এখনই, আর যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তারা সবাই যাতে সরকারী সাহায্য পায়, সেটা নিশ্চিত করুন।' বিহার পুলিশের তরফ থেকে আসা একজন কর্মকর্তা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে সৌম্যদর্শন প্রধানমন্ত্রী বললেন- 'ইটস অ্যান অফিসিয়াল অর্ডার!'
পুলিশের তিন উচ্চপদস্থ অফিসার যখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকছেন, তখন দিল্লি থেকে কয়েকশো মাইল দূরে বিহারের ভাগলপুর শহরের একটা পরিত্যাক্ত বাড়িতে তখন তুলে আনা হয়েছে তরুণ এক আইনজীবীকে। তার নাম রাজকুমার মিশ্র। তাকে তুলে এনেছে পুলিশের লোকেরাই, ভদ্রলোকের অপরাধ, বিহার পুলিশের 'অপারেশন গঙ্গাজল' এর বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগেছেন এই আইনজীবী, আদালতে রিট করেছেন, সুপ্রিম কোর্টে চিঠি লিখে প্রধান বিচারপতির নজরে এনেছেন অনাচারের এক অবর্ণনীয় অধ্যায়কে। তাই তার ওপরে ক্ষেপেছে রাজ্য পুলিশ।
১৯৮০, বিহার। এমনিতেই অরাজক রাজ্য হিসেবে বিহারের সুনাম আছে, জাতপাতের হাজারটা ভেদাভেদ থাকায় মানুষ নানারকম দল-উপদলে বিভক্ত, আছে শিক্ষার অভাব। এই রাজ্যে অনেক ছেলেমেয়ে হাতে কলম ধরার আগে ছুরি ধরে। অন্যান্য রাজ্য থেকে অপরাধীরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় এখানে, আর তাই অপরাধীদের স্বর্গ বললেও ভুল হবে না জায়গাটাকে। ছিঁচকে চুরি-ডাকাতি তো ডালভাত ব্যাপার ছিল। আস্ত মানুষ খুন করে ফেলেও রাস্তা দিয়ে বুক ফুলিতে হেঁটে বেড়াতো খুনি, ক্ষমতার প্রদর্শন করাটাকেও শিল্পে পরিণত করেছিল এখানকার অপরাধীরা।
সেই বিহারের ভাগলপুরে অপরাধী দমনের নামে ১৯৮০ সালে বিহার পুলিশ শুরু করলো অন্যরকম এক নৈরাজ্য। কোন জেলখানা থাকবে না, আসামী থাকবে না- এই ছিল নীতি। অপরাধীকে ধরে তার চোখে ঢেলে দেয়া হতো অ্যাসিড, সাইকেলের চাকার স্পোক ঢুকিয়ে ফুটো করে দেয়া হতো চোখ। একজন দুজন নয়, কমপক্ষে তেত্রিশ জন মানুষের চোখ এভাবে নষ্ট করা হয়েছে, থানায় এনে বা পুলিশের গোপন কাজের জন্যে ব্যবহৃত কোন আস্তানায় নিয়ে অন্ধ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে চুরি-ডাকাতিতে লিপ্ত হয়ে ধরা পড়া কোন অপরাধীকে।
পুলিশের এই কার্যক্রমের নাম দেয়া হয়েছিল 'অপারেশন গঙ্গাজল'। হিন্দুধর্মে গঙ্গাজল একটা পবিত্র বস্তু, মুসলমানদের জন্যে জমজম কূপের পানি যেমন, ঠিক সেরকম। গঙ্গাজল গায়ে ঢেলে দিলে সব পাপ দূর হয়ে যায় বলে বিশ্বাস করে অনেকে। বিহার পুলিশও অ্যাসিডকে সেই গঙ্গাজলের সাথে তুলনা করে নাম দিয়েছিল অপারেশন গঙ্গাজল- চোখে অ্যাসিড পড়ার পরে সেই লোক জীবনে আর চুরি-চামারিতে যুক্ত হতে পারবে না, এজন্যেই গঙ্গাজলের সঙ্গে তুলনা!
খুন-খারাপী আর চাঁদাবাজীতে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল বিহারের মানুষ। তাই পুলিশ যখন আইন-আদালতের ধার না ধরে নিজেরাই অপরাধীকে শাস্তি দেয়া শুরু করলো, তখন সাধারণ মানুষ খুশিই হয়েছিল। ব্যাপারটা আইনসম্মত কিনা, তাতে মানবাধিকার লুন্ঠিত হচ্ছে কিনা, এতসব ভাবার সময় ছিল না তাদের। চোখে অ্যাসিড ঢালার পরে পুলিশ হয়তো কাউকে ফেলে গেছে রাস্তায়, লোকটা গগনবিদারী চিৎকার করছে, তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে একশো মানুষ তখন মজা দেখছে, সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না কেউই। এই লোক তো চোর-বাটপার বা অপরাধী, তাকে সাহায্য করার কি আছে?
কিন্ত বিহার পুলিশের এই কার্যক্রম অপরাধ দমনের জন্যে ছিল না, তারা অপারেশন গঙ্গাজল শুরু করেছিল অপরাধ সাম্রাজ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্যে। বিহারে তখন বেশ কয়েকটা গ্যাংয়ের রাজত্ব, পুলিশও তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা পেতো। টাকাপয়সার লেনদেনে ঝামেলা হলেই শুধু অপরাধীদের ধরার ব্যাপারে মনযোগী হতো পুলিশ। কারণ গ্রেফতার করতে পারলে বড় অঙ্কের দাও মারা সম্ভব।
পুরো ব্যাপারটাতে বিহারের স্থানীয় রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেক হোমরা চোমরা ব্যক্তিরাই জড়িত ছিল।এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ার তখনও আবিস্কৃত হয়নি, আর তাই সন্ত্রাসী এবং মাফিয়াদের ভয় দেখানোর জন্যেই ছোটখাটো কিছু অপরাধীর চোখ নষ্ট করে দিয়ে পুলিশ তাদের বার্তা দিতে চেয়েছিল- 'হয় আমাদের খুশি রাখো, নইলে তোমাদের পরিণতিও এরকমই হবে। আমার গায়ে আইনের পোষাক, আর তাই আমাদের চেয়ে বড় গুন্ডা আর কেউ নেই!'
শুরুতে রাজকুমার মিশ্র নামের এক আইনজীবির কথা বলেছিলাম, সারাজীবনের জন্যে চোখ হারিয়ে ফেলা লোকগুলোর হয়ে মামলা করেছিলেন তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে। আর সেকারণে তাকে কম বিড়ম্বনা সইতে হয়নি। পুলিশ তাকে ক্রমাগত হুমকি-ধামকি দিয়েছে, এমনকি শহরের মানুষ তাকে দেখলেই গালাগাল দিতো, বলতো, 'পুলিশ অপরাধী সাফ করছে, আর তুমি উকিল হয়ে টাকার জন্যে তাদের বাঁচাতে চাইছো?' রাজকুমার তাদের কোনভাবেই বোঝাতে পারতেন না যে, একজন ছিঁচকে চোরের চোখ তুলে নেয়াটা কত বড় অন্যায়। পুলিশকে কেউ এই ক্ষমতা দেয়নি।
দিল্লিতেই ফিরে যাওয়া যাক আবার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেরিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গেলেন তিন কর্মকর্তা। সেখান থেকে ফোন গেল বিহারে, রাজ্য পুলিশ সদর দপ্তরে। রাজকুমার মিশ্রকে আটকে রেখে পিস্তল বাগিয়ে হুমকি দিচ্ছিল এক পুলিশ অফিসার, বাইরে থেকে একজন একটা চিরকুট এনে দিলো তার হাতে। সেটা পারতে পড়তে চেহারাটা তেতো হয়ে গেল সেই অফিসারের। মাটিতে একদলা থুথু ফেলে মুখ বিকৃত করে বললেন- 'বেঁচে গেলি তুই শুওরের বাচ্চা!' হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হলো রাজকুমারের, তাকে বলা হলো বাসায় চলে যেতে, এই ঘটনা যেন কাউকে না জানায়, সেই উপদেশও দেয়া হলো।
অপারেশন গঙ্গাজলের নামে এই নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ হবার পরে সাড়া পড়ে গিয়েছিল পুরো ভারতে, ছি ছি রব উঠেছিল চারপাশে। পুলিশের বিরুদ্ধে বেরিয়েছিল মিছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এই নির্যাতনের বিবরণ শুনে তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জরুরী আদেশ জারির মাধ্যমে অপারেশন গঙ্গাজলের সব কার্যক্রম স্থগিত করা হয়, বিচার শুরু হয় এর সঙ্গে জড়িত থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের। ৩০ জনেরও বেশি পুলিশ অফিসারকে নানা মেয়াদে চাকরি থেকে বহিস্কার এবং কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এই ঘটনা অবলম্বনে বলিউডে সিনেমাও নির্মিত হয়েছে। কিন্ত সিনেমার গল্প আর বাস্তবের গল্প এক ছিল না, বাস্তব বরাবরই কঠিণ, নিরীহরাই এখানে অত্যাচারিত। চোখ হারানো তেত্রিশজনের মধ্যে আঠারো জন মারা গেছে দারিদ্র্যতার কষাঘাতে, বাকীরাও লড়ছে এখনও জীবনের সঙ্গে। আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা অত্যাচার যে কখনও শেষ বিচার হতে পারে না, এটা অপারেশন গঙ্গাজলের ঘটনাটাই প্রমাণ করে দেয়...