রাষ্ট্র, আমরা কি কি বলতে পারব, কতটুকু বলতে পারব, ফেসবুকে কি শেয়ার দিতে পারব আর কি পারব না। কাকে নিয়ে সমালোচনা করা যাবে, আর কাকে নিয়ে যাবে না, এরকম একটা গাইডলাইন তৈরী করে দিন...

গতকাল সকালে উঠেই খবর পেলাম, গত ৫৪ দিন ধরে নিখোঁজ থাকা সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের সন্ধান মিলেছে। আগের রাতে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে বেনাপোল থেকে। তিনি নাকি ভারত থেকে অবৈধভাবে দেশে প্রবেশের সময় গ্রেফতার হয়েছেন বিজিবির হাতে, সেখান থেকে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মামলাও রুজু করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। যদিও ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়া তিনি কীভাবে এই লকডাউনের মধ্যে ভারতে গেলেন, বা সেখান থেকে ফিরলেন- এটা পরিস্কার নয়। থানা থেকে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেছেন, কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাদের বলেছেন, 'আমি বেঁচে আছি, আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে!' 

গণমাধ্যমে কাজলের ছবি দেখলাম। নিখোঁজ হবার সময় দাঁড়ি ছিল না তার মুখে, এখন বেশ বড়সড় দাঁড়ি। কাজলের ছেলে বাবার ফোন পেয়েই ঢাকা থেকে বেনাপোলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন, ৫৪ দিন পরে বাবার দেখা পেলেও বাবাকে জড়িয়ে ধরা হয়নি তার। কারণ এই রাষ্ট্রের পুলিশ কাজলের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে তাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রেখেছিল। কাজল কোন হেভিওয়েট বন্দী নন, হলে হয়ত খানিকটা সম্মান তিনি পেতেন। তাই তার সঙ্গে পুলিশের ব্যবহারটা ছিঁচকে চোরের মতোই। কিন্ত কাজল যদি হেভিওয়েট না-ই হন, ৫৪ দিন নিখোঁজ থাকবেন কেন তিনি? এই প্রশ্নের জবাব আছে?

বেঁচে থাকাটা খুব চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই নাকি আশ! প্রবাদ প্রবচনের ভীড়ে না গিয়ে আমরা বরং এই রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে জড়িত যারা কাজল সাহেবকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাদের প্রতি একটা শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। এই দেশ থেকে মাঝেমধ্যেই কিছু মানুষ নিখোঁজ হয়ে যান। তাদের কেউ কেউ ফিরে আসেন, কেউবা আসেন না আর কখনও। যারা আসেন, তাদের কখনও পার্শ্ববর্তী দেশে পাওয়া যায়, কিংবা উদভ্রান্ত হয়ে তারা ঘুরে বেড়াতে থাকেন দেশের এমন কোন জায়গায়- যেখানে তার যাওয়ার কথাই নয়! 

ফিরে আসার পর এই লোকগুলো আর কখনও মুখ খোলেন না। তাদের সঙ্গে কি হয়েছিল, কে তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কি ছিল অপহরণকারীদের উদ্দেশ্য, বন্দী সময়টায় কেমন আচরণের শিকার হয়েছেন তারা, কীভাবে ফিরে এলেন- কিছুই তারা বলেন না। নিজেদের চারপাশে দেয়াল তুলে দেন, অজানা এক আতঙ্ক গ্রাস করে তাদের। তাও ভালো, জীবিত ফিরে তো এসেছেন, চিরদিনের জন্যে হারিয়ে তো যাননি! এর বিনিময়ে মুখ বন্ধ রাখাই যায়। 

শফিকুল ইসলাম কাজল

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ১০ মার্চ সন্ধ্যায় ‘পক্ষকাল’-এর অফিস থেকে বের হয়েছিলেন। এরপর থেকে তার কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, তাকে অনুসরণ করছিল কয়েকজন লোক, তার মোটরসাইকেলে ট্র‍্যাকিং ডিভাইস টাইপের কিছু লাগিয়ে দিতেও দেখা গেছে তাদের। গত ৫৪ দিন ধরে কাজলের পরিবার থানা পুলিশের কাছে দৌড়েছে, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে- লাভ হয়নি। আজ হুট করে কোত্থেকে যেন রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অমনি কাজল ফিরে এলেন! 

কাজল গুম হওয়ার আগে যুবলীগ নেত্রী পাপিয়ার খদ্দেরদের বিষয়ে খোঁজ খবর করছিলেন বলে দাবী করেছেন তার কয়েকজন বন্ধু এবং কলিগ৷ তাছাড়া পাপিয়ার সঙ্গে সরকার দলীয় এক এমপির নাম জড়িয়ে করা একটা খবর তিনি শেয়ার দিয়েছিলেন নিজের ফেসবুক একাউন্ট থেকে, একারণে সেই এমপি তার নামে মামলাও করেছেন (মূলত মামলাটা হয়েছিল পত্রিকার বিরুদ্ধে, সেখানে আসামীদের তালিকায় কাজলের নামও ছিল)। 

কাজলের নিখোঁজের সঙ্গে কি সেই নেতা, সেই মামলা বা খবর শেয়ার দেয়ার কোন সম্পর্ক আছে? আমরা জানিনা। জানতে চাইও না। আমরা সুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকতে চাই, নিরাপদে থাকতে চাই। গুম হয়ে যেতে চাই না, হারাতেও চাই না। ভারতে ভ্রমণের ইচ্ছা আছে, কাশ্মীর-হিমাচল, রাজস্থান-দক্ষিণ ভারত সবটাই ঘুরতে চাই, কিন্ত কাজল সাহেবের মতো ৫৪ দিন নিখোঁজ থেকে, পরিবারকে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখে কারো পরিকল্পনার অংশ হয়ে এভাবে ভারত থেকে ফেরার ইচ্ছে নেই। 

রাষ্ট্র, দয়া করে আমাদের জন্য একটা গাইডলাইন তৈরী করে দিন! আমরা কি কি বলতে পারব, কতটুকু বলতে পারব, ফেসবুকে কি শেয়ার দিতে পারব আর কি পারব না। কাকে নিয়ে সমালোচনা করা যাবে, আর কাকে নিয়ে যাবে না, এরকম একটা তালিকা তৈরী করে দিন। আমরা কেউ অকালে হারাতে চাই না, ক্ষণিকের ভুলে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ মাথার ওপরে টেনে আনার কোন ইচ্ছে নেই আমাদের। অনিয়মের নামেই নাহয় একটা নিয়ম থাকুক, সেটার বাইরে আমরা যাব না, কথা দিচ্ছি। দিন শেষে বেঁচে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ, ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। 

সবাইকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের শুভেচ্ছা...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা