আমেরিকার আছে সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান। আর ভারতের আছে 'প্যাডম্যান'! অক্ষয় কুমার অভিনীত 'প্যাডম্যান' সিনেমাটি এক সুপারহিরোর অবিশ্বাস্য সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত! তো কে এই সত্যিকারের সুপারহিরো? কী করেছেন তিনি? চলুন জেনে আসা যাক!

পিয়াস ইসলাম: ঘটনাটা ১৯৯৮ সালের দক্ষিণ ভারতের তামিলনাডুতে। ২৬ বছর বয়সী এক তরুণ, নাম অরুনাচালাম। বিয়ে করলেন শান্তি নামের এক মেয়েকে। পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেছেন দুজন। খুব মায়াভরা মুখখানা দেখে বিয়ের দিনেই অরুনাচালাম ভালোবেসে ফেলেন শান্তিকে। এক কথায় শান্তিকে দেখলেই নিজের মনের ভেতর এক অন্যরকম শান্তি পেতেন অরুনাচালাম।

বিয়ের কিছুদিন পরেই অরুনাচালাম লক্ষ্য করলেন, তার স্ত্রী মাসিকের সময় কোন নিরাপদ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করে পুরনো কাপড় ব্যবহার করে, যা একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত না। তিনি তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন কেন সে ভালো স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করে এসব পুরনো কাপড় ব্যবহার করে? শান্তি প্রথমে তাকে কিছু বলতে চাননি। কিন্তু অরুনাচালাম নাছোড়বান্দা, না শুনে যাবেন না! পরে তার জোরাজুরিতে বলতে বাধ্য হলেন শান্তি- এই প্যাডগুলো অনেক দামী, যা শান্তির পরিবারের তাকে কিনে দেবার সামর্থ্য ছিল না। তাছাড়া অরুনাচালামকে সে এই দামী ব্র্যান্ডের প্যাড কিনে দিতে বলতে পারে না, কারণ তাদের আর্থিক অবস্থাও খুব বেশি ভালো না। 

শান্তির কাছ থেকে কথাগুলো শোনার পর অরুনাচালামের আর রাতে ঘুম হলো না। তিনি ভাবতে থাকেন কী করে শান্তিকে ভালো প্যাড কিনে দেয়া যায়। অনেক হিসেব-নিকেশ করেও মাসে কিছু টাকা তিনি সঞ্চয় করতে পারছিলেন না নিজের স্ত্রীর প্যাড কেনার জন্য। তাই অরুনাচালাম এবার সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজেই প্যাড তৈরি করবেন। তিনি বাজারের প্যাডগুলো দেখে কিছু তুলা আর কাপড় নিয়ে প্যাড বানানোর কাজে নেমে পড়লেন। 

অরুনাচালাম ও তার স্ত্রী

প্রথমে তুলাগুলোকে একটা কাপড়ে রেখে তার চারপাশে আঠা জাতীয় কিছু দিয়ে একটা প্যাড তৈরি করলেন। প্যাড তো তৈরি হয়ে গেল, এবার বউকে উপহার দেবার পালা। অরুনাচালাম নায়কের বেশে তার ভালবাসার বৌয়ের কাছে গিয়ে বলল তার জন্য একটা উপহার আছে। শান্তিও শুনে খুব খুশি, কী সেই উপহার! তারপর অরুনাচালাম তার তৈরিকৃত সেই প্যাড দিলেন শান্তিকে। শান্তি একটু অবাক মিশ্রিত খুশিই হলেন বটে। 

কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল যখন ভালবাসার স্ত্রী শান্তি প্যাডটি পড়ে খুব বাজে রিভিউ দিলেন। কারণ প্যাডটি পড়ে শান্তি একটুও শান্তি পাচ্ছিলেন না। খুব বেশি স্যাঁতস্যাঁতে লাগছিল তারচেয়েও বড় কথা, তার হাঁটতে খুব সমস্যা হচ্ছিল। ব্যাস, কী আর করা! শান্তি সেই পুরনো প্যাডেই শান্তি খুঁজতে গেলেন। কিন্তু অরুনাচালাম বাবু সেই রকমের অ্যারে মানে একরোখা, তার কথা হলো কেন পারব না বানাতে! এর মধ্যে তার এক বন্ধু তাকে জানালো সারা ভারতে মাত্র ২০% মেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করছে, কারণ এই প্যাডের মূল্য খুব চড়া। এই তথ্যটি অরুনাচালামকে আরও বেশি অনুপ্রানিত করলো তার কাজের জন্য। 

প্রথমে প্যাড বানানোর ব্যাপারটি শুধু মাত্র নিজের স্ত্রীকে ভালবাসার তাগিদে হলেও পরে ব্যাপারটি তার কাছে একটি দৈনন্দিন কাজের তালিকায় জায়গায় চলে গেল। এবার তিনি নতুন নতুন অনেক ম্যাটেরিয়াল দিয়ে প্যাড বানানো শুরু করলেন পরীক্ষা চালানোর জন্যে। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল মাসিক তো প্রতিদিন হয় না, সেটার জন্য তাকে ১ মাস অপেক্ষা করতে হয়। শান্তি অনুরাচালামের এই ব্যাপারটাকে প্রথম দিকে হাসি তামাশার মতো নিলেও দিনকে দিন খুব বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ, তার পরীক্ষামুলক কাজগুলোর গিনিপিগ হচ্ছিলেন শান্তি নিজেই! অনুরাচালাম এবার সিদ্ধান্ত নিলেন এভাবে এক মাস অপেক্ষা করে কাজ করতে গেলে তার অনেক দেরি হয়ে যাবে, তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আরও মেয়েদের খুঁজবেন পরীক্ষা চালানোর জন্য। কিন্তু এই গ্রামে কেউ তাকে পজিটিভভাবে নেবে না, উল্টো পাগল কিংবা চরিত্রহীন পুরুষও ভাবতে পারে! তাহলে? 

তার গ্রামের কাছেই একটি মেডিকেল কলেজ আছে, তিনি চলে গেলেন সেই মেডিকেল কলেজের কিছু মেয়ের কাছে। তাদের কাছে গিয়ে তিনি প্যাডগুলো দিলেন, বললেন ব্যবহার করে একটা রিভিউ দিতে। তাদের মধ্যে থেকে সবাই রাজি না হলেও কিছু মেয়ে রাজি হলো। তারা প্যাডগুলো নিয়ে ব্যবহার করতে লাগলো। সবাই ব্যবহার করলো ঠিকই, কিন্তু রিভিউ দেয়ার সময় কাউকেই পাওয়া গেল না! কারণ মেডিকেলের মেয়েগুলো তাদের মাসিকের ব্যাপারে রিভিউ কোন পুরুষ মানুষকে দিতে রাজি না! অরুনাচালাম অনেকবার তাদের বুঝানোর চেষ্টা করলেও তারা কেউ রাজি হলো না।

অরুনাচালাম বুঝতে পারলেন, এভাবে থেমে গেলে তার কাজ শেষ হবে না। আর তিনি এই গ্রামে এমন মেয়ে মানুষ পাবেনও না, যারা তাকে এই কাজে সহায়তা করবে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই এই প্যাড পরে টেস্ট করবেন! 

যে-ই ভাবা, কাজ শুরু! নিজে টেস্ট করার জন্য নিজের জন্য মেয়েদের ইউটেরাসের মতো একটা সিস্টেম তৈরি করলেন, আর সেখানে বিভিন্ন প্রাণীর রক্ত দিয়ে বা বিভিন্ন সময় রং ব্যবহার করে প্যাডটা ভেজানোর প্ল্যান করলেন! এভাবেই তিনি রাস্তায় চলাচল করা শুরু করলেন, কিন্তু কিছুদিনের ভেতর তার আশেপাশের মানুষ ব্যাপারটা বুঝে ফেলল! যা হবার তাই হলো, সবাই তাকে নিয়ে মজা করা শুরু করলো। কিন্তু মজা পর্যন্ত থাকলে ব্যাপারটা হজম করা যেত হয়তো। কিন্তু ব্যাপারটা মজা থেকে সিরিয়াস হয়ে গেল, যখন তার ভালবাসার স্ত্রী শান্তি তাকে ছেড়ে তার বাবার বাড়ি চলে গেল! কারণ শান্তি এসব কথা সহ্য করতে পারছিলেন না।

শান্তি চলে যাবার পর অরুনাচালাম বুঝতে পারলেন তাকে আরও অনেকটা পথ একা হাঁটতে হবে। এবার সমাজকে দেখানোর পালা তার উদ্দেশ্য কী ছিল, কেন তার এই উদ্যোগ। দিনরাত পরীক্ষা করে অরুনাচালাম তৈরি করলেন সেই প্যাড বা স্যানিটারি ন্যাপকিন যা বাজারের অন্যান্য দামি ব্র্যান্ডগুলোর চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী, কিন্তু কাজে একই রকম! সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা হলো অরুনাচালাম প্যাড বানিয়ে দেননি, তিনি তৈরি করেছিলেন প্যাড বানানোর মেশিন যা দিয়ে একজন ইন্ডিয়ান মেয়ে নিজের প্যাড নিজেই তৈরি করতে পারে। 

এই প্যাড তৈরির মেশিন দেশের বাইরের থেকে আনলে খরচ পড়তো ৫০০,০০০$ যা অরুনাচল দিতে পারতেন মাত্র ৯৫০$-এ! এখন অরুনাচালামের মেশিন কিনে যে কোনো মেয়েই নিজের প্যাড নিজে তৈরি করতে পারবে আবার চাইলে বিক্রি করে নিজের একটা ব্যবসাও দাঁড় করাতে পারবে। এভাবেই অরুনাচালাম একটা সোশ্যাল বিজনেস মডেল দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তার দেশে।

অভিনব আবিষ্কারের জন্য তিনি বিভিন্ন পুরষ্কারে পুরষ্কৃত হয়েছেন

আজ পুরো ইন্ডিয়াতে যতজন সোশ্যাল বিজনেস নিয়ে কাজ করেন, তার মধ্যে অরুনাচালাম অনেক বেশি সমাদৃত। টাইম ম্যাগাজিন ২০১৪ সালের টপ ১০০ ব্যক্তির যে তালিকা তৈরি করে, তার মধ্যেও ছিল অরুনাচালামের নাম। দক্ষিণ ভারতের ছোট্ট গ্রামের অরুনাচালাম আজ একজন সফল উদ্যোক্তা, যিনি লেকচার দিয়েছেন আইআইএম মুম্বাই ( IIM-Mumbai), আইআইএম দিল্লী ( IIM-Delhi), আইআইএম বেঙ্গালুর ( IIM- Bengaluru) এবং হার্ভার্ডে! এছাড়া কথা বলার বিখ্যাত মঞ্চ TED-এও তিনি কথা বলেছেন তার বিজনেস নিয়ে, কথা বলেছেন নতুন উদ্যোক্তাদের নিয়ে। 

এই অরুনাচালামকে নিয়েই মুভি করছেন অক্ষয় কুমার আর সোনাম কাপুর। মুভির নাম “প্যাডম্যান”, আর সেই মুভির প্রযোজকদের তালিকায় আছেন টুইঙ্কেল খান্নাও। 

আমাদের দেশের উদীয়মান উদ্যোক্তাদের অরুনাচালামের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। যে পয়েন্টগুলো খুব বেশি দরকারী- 

>> নিজের আইডিয়ার উপর বিশ্বাস রাখা। 

>> সমাজ কী বলল সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে আপনার নিজের আইডিয়াকে বাঁচিয়ে রাখার কাজ করা। 

>> মার্কেট রিসার্চ করে প্রোডাক্ট তৈরি করা। 

>> ডাটা ব্যবহার করা। 

অরুনাচালাম আইডিয়াকে ভালোবেসে কাজ করেছিলেন বলে আজ তিনি সফল। পরিবার থেকে প্রতিবেশী- সবাই ছিল তার বিপক্ষে। কিন্তু তিনি জানতেন তার এই আইডিয়া ক্লিক করবে। পৃথিবীর সব অরুনাচালামদের জন্য শুভকামনা।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা