পিরিয়ড চলাকালীন কাজে না গিয়েও বেতন পাবেন নারীরা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
'এক মাসে আপনি কয়দিন ঋতুচক্রজনিত পেটে ব্যথা বা ক্র্যাম্পের জন্য কাজ মিস করেছেন কিংবা ছুটির আবেদন জানিয়েছেন?'
এই প্রশ্নটিই নিজেদের মোট ৪,০০০ কর্মীর মধ্যে ৩৫ শতাংশ নারীকর্মীর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল ভারতের সর্ববৃহৎ ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি- জোম্যাটো। এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি তারা 'পেইড পিরিয়ড লিভ'- এর একটি নতুন নীতিমালা ঘোষণা করেছে। এখন থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ঋতুচক্রের কারণে প্রতি বছর সর্বোচ্চ দশদিনের 'পেইড লিভ' পাবেন। অর্থাৎ ওই দশদিন কাজে না এলেও বেতন ঠিকই ঢুকবে তাদের অ্যাকাউন্টে। এই নীতিমালা নারীকর্মীদের পাশাপাশি ট্রান্সজেন্ডার কর্মীদের জন্যও প্রযোজ্য হবে।
আন্তর্জাতিক বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও যেখানে এ ধরনের নীতিমালা বিরল, সেখানে ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সাহসী এবং দৃষ্টান্তমূলক। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে এখনো নারীদের ঋতুচক্র একটি ট্যাবু, যে কারণে প্রথমবার ঋতুচক্রের অভিজ্ঞতা হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশটির ৭১ শতাংশ কিশোরীই এ ব্যাপারে পুরোপুরি অজ্ঞ থাকে।
জোম্যাটোর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দীপিন্দার গয়াল একটি বিবৃতিতে তার কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, "পিরিয়ড লিভের ব্যাপারে কোনো ধরনের লজ্জা বা সংকোচ থাকা উচিত নয়। আপনারা নির্দ্বিধায় আপনাদের ইন্টার্নাল গ্রুপের সদস্যদের বলবেন বা মেইল করে দেবেন যে কোনো নির্দিষ্ট দিনে আপনারা পিরিয়ড লিভ নিতে চাইছেন।"
তিনি আরো বলেন, "এটি জীবনেরই অংশ।"
জোম্যাটো তাদের এই পিরিয়ড লিভের নীতিমালা ঘোষণা করার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমগুলোর শিরোনামে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও নারী অধিকারের স্বপক্ষের মানুষেরা তাদের এই পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করছে।
যেমন সাংবাদিক ও কলামিস্ট ঋতুপর্ণা চ্যাটার্জি, যিনি আনজেন্ডার লিগাল অ্যাডভাইজরি নামের একটি ভারতীয় সংগঠনের যোগাযোগ পরিচালকও বটে, লিখেছেন: "এটি আসলেই একটি প্রগতিশীল পদক্ষেপ। অনেকদিন ধরেই এটি হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। এখন অন্তত জোম্যাটোর কর্মীরা একটি অপশন পাবে যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় বিশ্রাম গ্রহণের, যা আগে তাদের ছিল না।"
যুগ যুগ ধরে ঋতুচক্র নারী সমতার পথে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে মেনোপজ হয়ে থাকে নারীদের। এর আগ পর্যন্ত প্রতি মাসেই ঋতুস্রাবের ফলে তাদের বিভিন্ন ধরনের ব্যথা বা অন্যান্য রোগের উপসর্গ দেখা যায়। এ সকল রোগের মধ্যে রয়েছে পেলভিক ও লোয়ার ব্যাক পেইন, মাথাব্যথা, অবসাদ ইত্যাদি। এছাড়া হরমোনাল লেভেলের ওঠানামার ফলে অনেকের মুড সুইংও দেখা যায়। ঋতুচক্রের সাথে সম্পর্কিত ব্যথাকে বলা হয়ে থাকে ডিসমেনোরিয়া, যা গোটা বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এর ফলে নারীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মক্ষেত্রের পারফরম্যান্স প্রভাবিত হয়, এবং বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে থাকে। ২০১২ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, যন্ত্রণাদায়ক ঋতুচক্রের ফলে ২০ শতাংশ নারীর দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হয়।
বিশ্বের অনেক দেশেই নারীদেরকে ঋতুচক্রের ফলে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। মাসের ওই কষ্টকর দিনগুলোতেও তাদেরকে যাবতীয় ব্যথা সহ্য করে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। আর যদি তারা কোনোভাবে কাজে উপস্থিত হতে না পারেন, তাহলে তাদের বেতন কেটে রাখা হয়। আবার নেপালের মতো দেশে ঋতুস্রাব চলাকালীন নারীদেরকে মূল বাড়ি থেকে দূরে এক ধরনের কুঁড়ে ঘরে গিয়ে থাকতে হয়। কেননা ওই সময়ে তাদেরকে দূষিত বা বিষাক্ত বলে মনে করা হয়। ২০১৭ সালে পশ্চিম নেপালে এক কিশোরী কুঁড়ে ঘরে গিয়ে থাকতে গিয়ে সাপের কামড়ে প্রাণ হারানোর পর এই প্রথা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
ভারতেও ঋতুচক্র ট্যাবু হিসেবে গণ্য হওয়ায়, অনেক নারীকেই নানা ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। রোজ জর্জ তার 'দ্য ট্যাবু অভ মেনস্ট্রুয়েশন' প্রবন্ধে তুলে ধরেছিলেন কীভাবে ঋতুচক্র নিয়ে ভারতবর্ষের নারীরা বৈষম্য ও কুসংস্কারের শিকার হয়। অথচ স্যানিটারি প্যাড কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া না যাওয়ায় কিংবা দাম অনেক বেশি হওয়ায়, এবং স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায়, অনেক নারীরই স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ে।
তবে কিছুটা হলেও সুখের বিষয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের কিছু কিছু দেশ তাদের সমাজে ঋতুচক্র বিষয়ক ইস্যুগুলোতে সংস্কার চালাচ্ছে। যেমন স্কটিশ পার্লামেন্টে এই বছর বিল পাশ হয়েছে প্রয়োজনে যে কাউকে বিনামূল্যে প্যাড ও ট্যাম্পন পৌঁছে দেওয়ার। আবার কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপর থাকা নানা বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ার ব্যাপারেও বিভিন্ন দেশে আন্দোলন চলছে। যেমন জাপানে ইউমি ইশিকাওয়া নামের একজন মডেল ও অভিনেত্রী ১৮,০০০ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন একটি পিটিশনে, যেটির দাবি হলো কর্মক্ষেত্রে নারীদের ড্রেসকোড তুলে নেওয়ার, যার ফলে নারীদেরকে হিল জুতো পরতে বাধ্য করা হয়।
জোম্যাটো প্রণীত নীতিমালাকে বলা যায় এই দুই আন্দোলনের ক্ষেত্রেই নবতম সংযোজন। আশা করা যায়, জোম্যাটোর দেখানো পথ অনুসরণ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কর্মক্ষেত্রে নারীদের ঋতুচক্র বা অন্য যেকোনো স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যাপারে বিদ্যমান নীতিমালা শিথিল করা হবে, এবং নারীবান্ধব নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এর মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যকার সমতা প্রতিষ্ঠা করার পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়ায় সম্ভব হবে।
তবে হ্যাঁ, জোম্যাটোই কিন্তু পিরিয়ড লিভের ব্যবস্থা করা প্রথম ভারতীয় প্রতিষ্ঠান নয়। সেই ১৯৯২ সাল থেকেই বিহার রাজ্যে ঋতুস্রাবের জন্য সরকারি চাকরিজীবীদের বাড়তি দুইদিন ঐচ্ছিক ছুটি গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ২০১৭ সালে ভারতে কালচার মেশিন নামের একটি ডিজিটাল মিডিয়া কোম্পানিও সাধারণ অসুস্থতা বা অন্যান্য ছুটিছাটার বাইরে ঋতুস্রাবের জন্য অতিরিক্ত ছুটির নীতিমালা প্রণয়ন করে। এছাড়া জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও জাম্বিয়ায় বিভিন্ন ধরনের 'মেনস্ট্রুয়াল লিভ' নীতিমালা রয়েছে।
এই ধরনের নীতিমালা নিয়ে বিতর্কও অবশ্য রয়েছে অনেক। নারী অধিকার আন্দোলনের পক্ষের একদল যেমন বলছে এ ধরনের নীতিমালার আরো বিস্তার ঘটানো দরকার, আরেকটি দল আবার বলছে এ ধরনের নীতিমালার ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি ব্যাহত হবে, এমনকি নারীদের কম বেতন কিংবা চাকরিলাভে তুলনামূলক কম সুযোগ প্রাপ্তিকেও প্রতিষ্ঠিত করা হতে পারে।
অবশ্যই সেটি হবে খুবই নিন্দনীয় যদি ঋতুচক্রের সময় নারীদের ঐচ্ছ্বিক ও সবেতন ছুটির বিপরীতে তাদের পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধির পথরোধ করা হয়, চাকরি চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে পুরুষদের প্রতি পক্ষপাত করা হয়। তারপরও আমরা আশাবাদী হতেই পারি যে সে ধরনের আশঙ্কা সত্যি হবে না, বরং জোম্যাটো কর্মক্ষেত্রে নারীদের সমতার জন্য যে বিরল সুযোগ সৃষ্টি করল, তা অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হবে আমাদের বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন