কেন পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে 'বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক' গড়াকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে? সবটাই কি পাকিস্তানের স্বার্থ? নাকি পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে কেউ? এটা কি শুধুই বন্ধুত্ব, নাকি ভারতকে ঠেকানোর আঞ্চলিক রাজনীতির কঠিন মারপ্যাঁচ?

ইমরান খান ও শেখ হাসিনার কথোপকথন নিয়ে আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে। চায়ের দোকানের আড্ডার বিষয়বস্তু না হলেও, দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর মিনিট পনেরোর ফোনালাপ নিয়ে সরগরম ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মিডিয়া। পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক দ্য নেশন তো ফোনালাপের পরদিন এই ঘটনাকে বিশাল কাভারেজ দিয়েছে, তারা খবরের শিরোনামে লিখেছে- 'ডন অফ অ্যা নিউ এরা' বা নতুন সুগের সূচনা! আসলেই কি তাই? কেন পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে 'বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক' গড়াকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে? সবটাই কি পাকিস্তানের ইচ্ছে? নাকি পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে কেউ? এটা কি শুধুই বন্ধুত্ব, নাকি আঞ্চলিক রাজনীতির কঠিন মারপ্যাঁচ? 

যে পাকিস্তান বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে ২০১৬ সালে তাদের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব পর্যন্ত পাস করেছে, তারা কেন বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার জন্য এখন এত বেশি আগ্রহী? আর যে আওয়ামী লীগ সরকার গত প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকায় পাকিস্তানের একজন হাইকমিশনারের নিয়োগ ঝুলিয়ে রেখেছিল, যাদেরকে ধরা হয় ভারতের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তারা ভারত মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারে জেনেও বুধবারের ওই ফোনালাপে কেনইবা সায় দিল? চলুন, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা যাক।

উপমহাদেশের ভারতের সবচেয়ে কাছের দুই বন্ধু রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ এবং নেপাল। ছোটখাটো মনমালিন্য মাঝেমধ্যে ঘটলেও, সম্পর্ক নষ্ট হবার মতো বড় কোন ঘটনা এই তিন দেশের মধ্যে ঘটেনি এর আগে। কিন্ত সম্প্রতি নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গিয়ে ঠেকেছে আদায়-কাঁচকলায়। কালাপানি সীমান্তে ভারতের বিরুদ্ধে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ এনে সেই কাজ বন্ধ রাখার আহবান জানিয়েছিল নেপাল। ভারত সেটা না শোনায় নেপাল কঠোর রাস্তায় হেঁটেছে, ভারতকে ছেড়ে চীনের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। 

শেখ হাসিনা-ইমরান খানের ফোনালাপ এখন টক অব দ্য সাব কন্টিনেন্ট

সীমান্তে নেপালি পুলিশের হাতে গুলি খেয়ে মরেছে ভারতীয় নাগরিক, ভারত অবাক চোখে দেখেছে, এতদিনকার বন্ধু কিভাবে বদলে যায়! পুরো ঘটনাটার পেছনে যে ভারতের বাজে পররাষ্ট্রনীতি এবং মোড়লগিরর দায় আছে প্রত্যক্ষভাবে, তাতে কোন সন্দেহই নেই। বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ ভারত অভিযোগ এনেছে, চীনের প্ররোচনাতেই নাকি নেপাল এমন কাজ করেছে। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যেও নয়। 

উপমহাদেশের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করে দিতে চাইছে চীন। এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে ভারতের, লাদাখে চীনা সেনাদের হাতে নিহত হয়েছে ২০ ভারতীয় সেনা, কিছু চীনা অ্যাপ বন্ধ করা ছাড়া জোরালো কোন প্রতিবাদও জানাতে পারেনি ভারত। চীন এখন ভারতকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। 

ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের মিত্রতা নতুন কিছু নয়। মায়ানমার চীনের পুরনো বন্ধু, শ্রীলঙ্কাতেও বিশাল অংকের বিনিয়োগ করে দেশটাকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে। নেপালকেও হাত করা হয়েছে, বাকী রইলো বাংলাদেশ। এখানে চীনের বিশাল।অংকের বিনিয়োগ আছে, কিন্ত যতো যাই হোক, বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক ভারতের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ নয়। ইমরান খানের ফোনের পেছনে যদি পরোক্ষভাবে এই কারণটা থেকে থাকে, তাহলে মোটেও অবাক হবার কিছু নেই। 

চীনা ইস্যু বাদ দিলে, পাকিস্তান নিজেদের স্বার্থেও বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বে আগ্রহী হতে পারে। উপমহাদেশেএ রাজনীতিতে পাকিস্তান অনেকদিন ধরেই ব্রাত্য। সবেধন নীলমণি সার্ক অকার্যকর, ভারত তার পরিবর্তে বিমসটেক গড়তে আগ্রহী, যেখানে পাকিস্তানকে রাখাই হবে না। উপমহাদেশে পাকিস্তান কোণঠাসা হয়ে পড়ছে ক্রমশ, বৈশ্বিক অবস্থানও নেই বলতে গেলে, তাই ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চেষ্টা করছেন বাংলাদেশকে পাশে পাবার, বেশ কয়েক দফায় তার মুখে বাংলাদেশের প্রশংসা শোনা গেছে, এমনকি একাত্তরের আগে পশ্চিম পাকিস্তান যে এই অঞ্চলের মানুষের ওপর শোষণ চালিয়েছে, সেটাও স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশকে ছাড়া যে পাকিস্তানের চলছে না, সেটা তাদের মিডিয়া থেকে প্রধানমন্ত্রী- সবার আগ্রহ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে এসেছে শীতলতা

পাকিস্তানের এগিয়ে আসার আরেকটা কারণ হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে সাম্প্রতিক শীতলতা। সীমান্ত হত্যা, নদীর পানি বণ্টন, আর সবশেষ বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বাংলাদেশকে তুলোধোনা- এই ব্যাপারগুলো বাংলাদেশ ভালোভাবে নেয়নি। আসামে যে কয়েক লাখ মানুষ নাগরিকত্ব হারিয়েছে, ভারত বলছে তারা বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশের জন্য এটা অপমানজনক।

তাছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সফরের সময় যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি বলে খবর প্রকাশ করেছে আনন্দবাজার পত্রিকা। সিএএ-এনআরসি মুভমেন্ট চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার পূর্ব নির্ধারিত ভারত সফর বাতিল করেছেন। ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু বলেছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত গত চার মাস ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েও পাচ্ছেন না।ভারত-বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতির কারণেই খুব সম্ভবত ইমরান খান সরকারের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ হয়তো এখন কথা বলতে রাজি হতে পারে। এবং সেই চেষ্টায় তারা খানিকটা হলেও সফল। 

পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান আজকারী রিজভির মতে, এই ফোনালাপ হয়তো ঐতিহাসিক নয়, নতুন দিগন্তের সূচনাও বলা যাবে না একে, তবে দুই দেশ এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কের শীতলতা যে খানিকটা হলেও কমেছে, তাতে সন্দেহ নেই। ইতিহাসের বাস্তবতায় বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সম্পর্কে জটিলতা দূর করা সহজ নয়। হাসান আজকারীর এই কথাটা মেনে নিয়েই বলতে হয়, একাত্তরের নৃশংস ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের 'বন্ধুত্ব'টা আসলেই অসম্ভব একটা ব্যাপার। যতদিন না তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে এই কুকীর্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছে, ততদিন ফোনালাপ বা কূটনৈতিক সফর- কোনকিছুতেই এই শীতলতার চিড়ে ভিজবে না...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা