বেশিরভাগ পাকিস্তানীর কোনো ধারণাই নেই একাত্তরে কি ভয়ংকর মাত্রার অপরাধ পাক আর্মি দ্বারা সংগঠিত হয়েছে। তার কারণ পাকিস্তানের পাঠ্যবইয়ে আপনি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক কারণ এবং ইতিহাস পাবেন না। তার পরিবর্তে পাবেন কিছু আজগুবি, বিভ্রান্তিকর বক্তব্য।
তানযীর হাসান: ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর প্রায় ৫ দশক পার হতে চলেছে। কিন্তু পাকিস্তান এখনো একাত্তরের বর্বরতম গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। উল্টো পাকিস্তান নিজের এই কলঙ্কিত ইতিহাস অস্বীকার করে আসছে। সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ইন্টারনেট ফোরাম ঘাঁটলে সহজেই বোঝা যায় পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মও বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বিরুপ ধারণা পোষণ করে। তার কারণ পাকিস্তানের পাঠ্যবইয়ে আপনি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক কারণ এবং ইতিহাস পাবেন না। তার পরিবর্তে পাবেন কিছু আজগুবি, বিভ্রান্তিকর বক্তব্য।
পাকিস্তানের ৯ম এবং ১০ম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু শিক্ষকদের প্রভাবকে। বর্ণনানুযায়ী, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপুল সংখ্যক হিন্দু শিক্ষক কর্মরত ছিলেন যারা বাঙালিদের মাঝে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেন। একবার ভেবে দেখুন নবম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী যদি এই শিক্ষা লাভ করে যে, হিন্দু শিক্ষকগণের উস্কানিতে পাকিস্তান ভেঙে গেছে তখন কি সে ধর্মান্ধ মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠবে না?
এখানেই শেষ নয়। পাকিস্তানের ৯ম এবং ১০ম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে। বর্ণনানুযায়ী, ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা করে ফেলতে চেয়েছিলো যাতে হিন্দুরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে। রাশিয়া ভারতকে এতে সহায়তা করে কারণ পাকিস্তান আমেরিকাকে নিজের মাটিতে মিলিটারি বেস বানাতে দিয়েছিলো, যাতে রাশিয়া ক্ষুব্ধ ছিলো। আবার আমেরিকাও চাইছিলো পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাক। যেন সারা দুনিয়া বসেই আছে শুধু পাকিস্তানের ক্ষতিসাধন করার জন্য। নিজেদের পাপ আড়াল করতে কতটা হাস্যকর থিউরি দাঁড় করানো হয়েছে, ভাবতে পারেন?
একাদশ শ্রেণীর বইয়েও চিত্র ভিন্ন কিছু নয়। একাদশ শ্রেণীর বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের যে বর্ণনা আছে তার সারমর্ম অনুযায়ী মিলিটারি অপারেশনে পাক আর্মির তুলনায় জামাত-এ-ইসলামির ভলান্টিয়াররা বেশি তৎপর ছিলো। ভারত পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ কর্মীদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে এবং পাক আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ফেরত পাঠায়। ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এক পর্যায়ে লোকাল সাপোর্ট, লোকবল এবং রসদের অভাবে পাক আর্মি ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। এখানে লোকাল সাপোর্টের অভাব পয়েন্টটা লক্ষ্য করুন। ঠিক যেনো কমপ্লেইন করা হচ্ছে বাঙালিরা স্বজাতি নিধনে পাক আর্মিকে কেন আরো বেশি একটিভ সাপোর্ট করেনি। নির্লজ্জতার সকল সীমা এখানে ছাড়ানো হয়েছে।
দুটি বইয়ের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বর্ণনায় কোথাও আপনি বাঙালিদের নির্যাতনে পাক আর্মির ভূমিকার উল্লেখ পাবেন না। সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের গণহত্যা, ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধকে। ক্ষেত্রবিশেষে পাক আর্মিকে বরং ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি যুদ্ধে কতজন মানুষ প্রাণ দিয়েছে তারও উল্লেখ নেই। ১৯৭০ এর নির্বাচন পরবর্তী জুলফিকার আলী ভুট্টোর গোঁয়ার্তুমির যে একটা বড় ভুমিকা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পেছনে, তারও কোনো উল্লেখ নেই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্যসহ সব ক্ষেত্রে বঞ্চিত করার ইতিহাস নিপুণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আর নিজেদের কুকর্ম ঢাকতে পাঠ্যবইগুলো বানোয়াট, উদ্ভট বক্তব্যে পূর্ণ করা হয়েছে।
একারণেই বেশিরভাগ পাকিস্তানীর কোনো ধারণাই নেই একাত্তরে কি ভয়ংকর মাত্রার অপরাধ পাক আর্মি দ্বারা সংগঠিত হয়েছে। কোনো নিরপেক্ষ পয়েন্ট অফ ভিউ থেকেও যখন সত্য তাদের সামনে উপস্থাপিত হয় তখন তারা সেটা স্বীকার করতে পারে না। তাদের কাছে বরং তা অতিরঞ্জিত কিংবা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা মনে হয়। বাঙালিদের তারা উল্টো বিশ্বাসঘাতক মনে করে।
আর তাই যেখানে অপরাধই অস্বীকার করা হচ্ছে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই অনুশোচনার কোনো বালাই নেই। তবে তথ্যপ্রবাহের এই যুগে এখন চাইলেই কিন্তু পাকিস্তানীরা দায় এড়াতে পারে না ইতিহাস না জানার। শুধুমাত্র নিজেদের আজগুবি ইতিহাস বাদ দিয়ে যেকোনো ইতিহাসের রেফারেন্স ঘাঁটলেই দেখা মিলবে নিজেদের পূর্বপুরুষদের সত্যিকারের চেহারা।