এই বাংলাদেশ আমার আপনার নয়, এই বাংলাদেশ পাপিয়ার মতো হায়েনাদের দখলে চলে গেছে অনেক আগেই, শকুনের মতো ছিঁড়ে খাচ্ছে দেশটাকে এখন তারা...
গণিতে আমি বরাবরই কাঁচা। হাইস্কুলে পাটিগণিতটা যা পারতাম, বীজগণিত আর জ্যামিতি দেখলেই জ্বর আসতো। পিথাগোরাসের ২৩ নম্বর উপপাদ্যটা কত রাতে যে দুঃস্বপ্ন হয়ে হানা দিয়েছিল, সেটা গুণে শেষ করা যাবে না। কাজেই পত্রিকা এবং ফেসবুকে যখন যুবলীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার সম্পদের ফিরিস্তি দেখলাম, সেটা আমার মাথায় না ঢোকাই স্বাভাবিক। বাৎসরিক আয় যার উনিশ লাখ টাকা, তিনি কি করে প্রতিদিন আড়াই লাখ টাকা শুধু মদের বিল দেন, তিন মাস ওয়েস্টিনের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটে থেকে ১ কোটি ত্রিশ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করেন- এই ম্যাথমেটিক্স কারো মাথায় ঢুকবে বলে মনে হয় না!
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত ব্যাক্তি শামীমা নূর পাপিয়া, গতকাল স্বামী ও ব্যক্তিগত সহকারী শ যাকে আটক করা হয়েছে। মাত্র ৩০ বছরেরও কম বয়সের মধ্যেই বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক বনে গেছেন তিনি। আলোচিত এই নারী নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক। তিনি নিজেকে কেন্দ্রীয় নেত্রী হিসেবেও পরিচয় দিতেন। আর এই পরিচয়ের আড়ালে ছিল তার অপরাধমূলক কাজকর্ম। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গিয়ে নেতাদের ফুল দিয়ে ছবি তুলে সেই ছবিও অপব্যবহার করতেন।
পাপিয়ার গ্রেফতারের পর যেন প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেছে, বেরিয়ে আসছে একের পর এক অপকর্মের ফিরিস্তি। সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই, তবুও স্বল্প সময়ে বিপুল সম্পত্তি ও অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন পাপিয়া। রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে পাপিয়া ও তার স্বামীর নামে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও ব্যক্তিগত গাড়ি, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট এবং বাগদী এলাকায় দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্লটও রয়েছে তার।
এর বাইরে তেজগাঁও এফডিসি গেটসংলগ্ন এলাকায় অংশীদারিত্বে তাদের ‘কার একচেঞ্জ’ নামক গাড়ির শোরুমে প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। নরসিংদী জেলায় ‘কেএমসি কার ওয়াস অ্যান্ড অটো সলিউশন’ নামক প্রতিষ্ঠানে ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগও আছে তাদের। র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের নামে-বেনামে অনেক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে র্যাব।
লোকে বলে পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়। কিন্ত পাপিয়ার কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি শোনার পরে পাপিয়ার চেয়ে পাপকেই বেশি নিষ্পাপ বলে মনে হচ্ছে! পাঁচ তারকা হোটেলে নারী ও মাদক ব্যবসাই পাপিয়া ও তার স্বামীর আয়ের মূল উৎস। দেশের অভিজাত কিছু মানুষ ও বিদেশিরা তাদের গ্রাহক। ইন্টারনেটে এস্কর্ট সার্ভিস খুলে বসে খদ্দেরদের কাছে তাদের চাহিদামতো সুন্দরী তরুণী পাঠাতেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষিত সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করতেন। তারপর তাদেরকে ধণাঢ্য ব্যক্তিদের শয্যাসঙ্গী করতেন পাপিয়া। এ জন্য একাধিক অভিজাত হোটেলের রুম ভাড়া নিত নামে-বেনামে। তারপর ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেলও করা হতো সেই ব্যক্তিদের।
এই দম্পতির আয়ের আরেকটি উৎস হচ্ছে নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। তারা ঢাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করে কম বয়সী মেয়েদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করায়। যাদের অধিকাংশকেই নরসিংদী এলাকা থেকে চাকরি দেয়ার কথা বলে এবং বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়। এসব অনৈতিক কাজে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাদের বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো।
সন্ত্রাস আর অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও সংযোগ আছে পাপিয়া এবং তার স্বামীর। চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন তদবির বাণিজ্যের সঙ্গেও তারা জড়িত। চাকরি দেয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকেই তারা হাতিয়ে নিয়েছে টাকা। প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করেনি কেউ। টাকা গেছে যাক, জীবনটা না গেলেই হলো! ডেইলি আড়াই লাখ টাকা মদের বিল আর এক কোটি ত্রিশ লাখ টাকা হোটেল স্যুটের বিল তো আকাশ থেকে আসে না!
পাপিয়ার বয়স এখনও ত্রিশ হয়নি, অথচ সম্পদ আর অপকর্মের ফিরিস্তি লিখে শেষ করা যাচ্ছে না! মজার ব্যাপার হচ্ছে, এত বছর ধরে পাপিয়া এবং তার স্বামী অপকর্ম করে এসেছে, সম্পদের পাহাড় বানিয়েছে, তাদের কারণে ভুক্তভোগী হয়েছে হাজার হাজার মানুষ- অথচ তাদের টিকিটাও কেউ ছুঁতে পারেনি। যেই না তারা ধরা পড়েছে, অমনি যুব মহিলা লীগও তাদের বহিস্কার করে ঝাড়া হাত-পা হয়ে গেছে। পাপিয়া হয়তো জেলে থাকবেন, কিন্ত তাকে যারা পাপিয়া হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, এসব অন্যায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স দিয়েছে এতদিন ধরে, যাদের ছত্রছায়ায় পাপিয়ারা এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তারা কখনও ধরা পড়ে না, থেকে যায় পর্দার আড়ালেই। ক্যাসিনো কাণ্ডের সময়ও আমরা এমনই গল্প দেখেছি।
ফেসবুক আর টিকটকে অ্যাক্টিভ ছিলেন পাপিয়া, এখন তার টিকটকের ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে, ধর্মের বাণী সংবলিত পোস্টগুলো নজরে আসছে সবার। এমনই একটা পোস্ট চোখে পড়লো, নিজের ছবি আপলোড দিয়ে সেটার ক্যাপশনে পাপিয়া লিখেছিলেন- 'আমিই বাংলাদেশ!' কথাটা সত্যি। এই বাংলাদেশ সৎ লোকেদের নয়, চাকরি করে দিন আনি দিন খাই টাইপের মধ্যবিত্তের নয়, এই বাংলাদেশ খেটে খাওয়া মানুষের নয়। এই বাংলাদেশ পাপিয়ার মতো লুটেরাদের, যারা রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ পথে সম্পদের পাহাড় গড়ে, ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে পাড়ি জমায়, নইলে নানাভাবে দেশটাকে লুটেপুটে খায়। এই বাংলাদেশ আমার আপনার নয়, এই বাংলাদেশ পাপিয়ার মতো হায়েনাদের দখলে চলে গেছে অনেক আগেই, শকুনের মতো ছিঁড়ে খাচ্ছে দেশটাকে এখন তারা...