"অনেকে ওনাকে গুরু মানেন, শিক্ষক বলেন, আমার কাছেও অবশ্যই তাই। কিন্তু সব ছাড়িয়ে উনি ছিলেন একজন পরম বন্ধু! একই সঙ্গে একজন শিক্ষক, পথ প্রদর্শক এবং বন্ধু হারালে কিরকম লাগে সেটা বলার চেষ্টা করে বৃথা। এ দুঃখ নিভৃতে, নির্জনে, একান্তেই মানায়..."

ভারতীয় সময় দুপুর বারোটা পনেরো নাগাদ যখন বেলভিউ হাসপাতালের ডাক্তারেরা জানিয়ে দিলেন যে, সৌমিত্র চট্টোপাধায়ের লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়েছেন তারা, জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে অসামান্য এই অভিনেতার- তার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই খবরটা পেয়েছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্রবাবু তার কাছে কেবল একজন সুপারস্টার, নায়ক বা বিখ্যাত অভিনেতাই ছিলেন না, ছিলেন মেন্টর, ছিলেন আইডল, তারপরে হয়েছেন বন্ধুও। কৈশরে পরম যখন সব্যসাচী চক্রবর্তীর সঙ্গে ফেলুদা সিরিজে তোপসের ভূমিকায় অভিনয় করছেন, তখনও তার মানসপটে ফেলুদা বলতে ওই সৌমিত্রই। 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী অবলম্বনে বায়পিক ঘরানার সিনেমা 'অভিযান' নির্মাণের কাজ চলছে, সেখানে সৌমিত্রেত ভূমিকায় অভিনয় করছেন পরম। সেই খাতিরে গত বছর দুয়েক ধরেই নিয়মিত তাকে সৌমিত্রের সঙ্গে ওঠাবসা করতে হচ্ছে। এর আগে বেশ কয়েকটা সিনেমায় দুজনে একসঙ্গে এসেছেন, শ্রাবণের ধারা সিনেমাতেও আলঝেইমারে আক্রান্ত সৌমিত্রের চিকিৎসক হিসেবে দেখা গেছে পরমব্রতকে। বাংলা চলচ্চিত্রের এই অসামান্য নক্ষত্রের পতনে পরমব্রত তাই শোকে বিহ্বল। পরমের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে ফুটে উঠেছে প্রিয়জন হারানোর শোক সইতে না পারার অসহায়ত্ব। পরম লিখেছেন-

"অনেকে ওনাকে গুরু মানেন, শিক্ষক বলেন, আমার কাছেও অবশ্যই তাই। আমার নিজের একান্ত নিজের উদয়ন মাস্টার। কিন্তু সব ছাড়িয়ে উনি ছিলেন একজন পরম বন্ধু! গত দেড় বছরে বিশেষ করে, যেমন তৈরি হয়েছিল শ্ৰদ্ধা, ভালোবাসা, তেমনই হতো ছোটখাটো মতান্তরও, যেমন হয় বন্ধুদের। আজ জীবনের একটা অংশ চলে গেলো, বাদ হয়ে গেলো। একই সঙ্গে একজন শিক্ষক, পথ প্রদর্শক এবং বন্ধু হারালে কিরকম লাগে সেটা বলার চেষ্টা করে বৃথা। সে পথে যাবো না।"

শ্রাবণের ধারা সিনেমায় সৌমিত্র ও পরমব্রত

শুটিংয়ের প্রয়োজনে পরমব্রত এখন হিমাচলে আছেন। তাই সৌমিত্রের শেষকৃত্যে যোগ দিতে পারছেন না তিনি। তারকারা মারা গেলে যেটা ঘটে, বাকিদের কাছে অনুভূতি জানতে চেয়ে, স্মৃতিচারণমূলক বাইট চেয়ে হামলে পড়ে মিডিয়া। প্রিয়জন, ভাই, বন্ধু বা সহকর্মী হারানোর শোকটাও পালন করার সুযোগ পান না তারা। পরম অনুরোধ করেছেন মিডিয়াকে, তার কাছে যেন প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে ফোন দেয়া না হয়। লিখেছেন-

"কাজের কারণ এ হিমাচল প্রদেশে আছি। শেষ যাত্রায় থাকতে পারছি না। এক দিকে ভালোই, এ দুঃখ নিভৃতে, নির্জনে, একান্তেই মানায়। হাত জোড় করে অনুরোধ করছি সংবাদমাধ্যমের বন্ধু দের কাছে, 'প্রতিক্রিয়া' জানতে চেয়ে ফোন করবেন না! এবারেরটায় ছেড়ে দিন! এ বিয়োগ বড় ব্যক্তিগত, এ কষ্ট শব্দের নয়, একার..."

আনন্দবাজার পত্রিকায় নিজের লেখা কলামে অবশ্য খানিকটা স্মৃতিচারী হয়েছেন পরম নিজেই। তার চোখে উত্তম কুমার যদি বাংলা সিনেমার চে গুয়েভারা হয়ে থাকেন, তাহলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অবশ্যই ফিদেল ক্যাস্ট্রো। কারনটাও লিখেছেন তিনি- 

উত্তমকুমার যখন তার খ্যাতি ও সাফল্যের চূড়ায়, তখন মারা গিয়েছিলেন। ফলে তার সেই নায়ক ইমেজটা থেকে গিয়েছে। তাকে আর অন্য কিছুর মুখোমুখি হতে হয়নি। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এই দশা, সিরিয়াল- দেখতে হয়নি কোনও কিছুই। ঠিক যেমন রাজনীতিতে চে গুয়েভারা। আর ফিদেল? তাকে কত কিছু দেখতে হয়েছে। রাজনীতির পঙ্কিল অধ্যায় তো তাকেই কাটাতে হয়েছে। ঠিক সৌমিত্রের মতো। আসলে দীর্ঘ জীবন সৌমিত্র আর ফিদেলকে এটা দেখিয়ে দিয়েছে। তাই উত্তমকুমার পরমব্রতের কাছে বাংলা সিনেমার চে, আর সৌমিত্র ফিদেল...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা