শুনতে যত খারাপই লাগুক না কেন, বাবা-মায়ের মাধ্যমেই এদেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়ের সেক্সের সাথে প্রথম পরিচয় হয়। চার-পাঁচ বছর বয়সী শিশু মাঝরাতে ঘুম ভাঙতে যখন তার বাবা-মাকে এমন অবস্থায় দেখে ফেলে যা তাদের দেখার কথা ছিল না, সেটা কি তাদের মনোজগতে খুব বড় প্রভাব ফেলে না?

২০০৯ সালে আমরা যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, তখন ক্লাসের কোনো ছেলে যদি বাচ্চা হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে না জানত কিংবা এমন ধারণা পোষণ করত যে 'বিয়ে না করলে বাচ্চা হয় না', তাহলে সে সবার হাসির পাত্রে পরিণত হতো। আর হবে না-ই বা কেন! এত বয়স হয়ে গেছে, তবু জানে না বাচ্চা কীভাবে হয়!

অদ্ভুত লাগছে নাকি বিষয়টা? অদ্ভুত লাগার একদমই কোনো কারণ নেই। আসলেই বিষয়টা ঠিক এমনই ছিল। ওই ১১-১২ বছর বয়সেই আমরা ক্লাসের প্রায় ৯০ শতাংশ ছেলেই জানতাম এগুলো সম্পর্কে। তাই অবশিষ্ট যে ১০ শতাংশ, বা সংখ্যার হিসাবে দুই-তিনজন জানত না, তাদের নিয়ে তো হাসি-ঠাট্টা হবেই!

এবং এটি যে শুধু আমাদের একটা স্কুলের ওই একটা ক্লাস সিক্সের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা-ই কিন্তু না। আমার বিশ্বাস তখনকার দিনে মোটামুটি ক্লাস ফাইভ-সিক্সই ছিল প্রায় সব ছেলের সেক্স সম্পর্কে জেনে যাওয়ার গড় সময়কাল। আমি যেহেতু মেয়ে না, আর ক্লাস ফাইভের পর আর মেয়েদের সাথে পড়িনি, তাই মেয়েদের ব্যাপারে আমার ঠিক জানা নেই। তবু ধারণা করতে পারি, ওই কাছাকাছি বয়সেই মেয়েরাও প্রায় সকলেই এই ব্যাপারগুলো জেনে গিয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে ওই বিষয়গুলো জেনেছিলাম? সেটা কি স্কুলের পাঠ্যসূচিতে সেক্স এডুকেশন থাকার কারণে? একদমই না। ক্লাস সিক্স থেকে শারীরিক শিক্ষা বইতে মেয়েদের ঋতুস্রাব বিষয়ক কিছু অধ্যায় ছিল বটে, কিন্তু সেগুলো তো আমাদের কখনো ক্লাসে পড়ানোই হয়নি। আবার অনেকের তো অভিভাবকেরা বই দেওয়ার সাথে সাথে ওই অধ্যায়গুলো ছিঁড়ে ফেলতেন, কিংবা স্ট্যাপল করে রাখতেন। এবং বলাই বাহুল্য, ওই ২০০৯ সালের দিকে দেশে ইন্টারনেট বা স্মার্টফোনেরও এত রমরমা অবস্থা ছিল না যে কমবয়সী ছেলেমেয়েরা অনলাইনে পর্ন দেখে এসব জিনিস শিখে যাবে।

তাহলে কীভাবে তারা এগুলো জেনেছিল? কিছু কারণ বলা যাক। এগুলো হয়তো অনেকের সাথেই কমন পড়বে।

প্রথম কারণ হলো বাবা-মা। হ্যাঁ, শুনতে যত খারাপ বা অস্বস্তিকরই লাগুক না কেন, বাবা-মায়ের মাধ্যমেই এদেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়ের সেক্সের সাথে প্রথম পরিচয় হয়। আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা এতটাই কাণ্ডজ্ঞানহীন যে, উত্তেজিত হয়ে গিয়ে সন্তানদের সামনে শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হতেও তারা দ্বিধাবোধ করেন না। অথচ একটা বাচ্চার এইসব বিষয়ে অল্পস্বল্প বোঝার বয়স হয়ে যায় সেই চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই। অর্থাৎ যখনো তাদের আলাদা ঘর বা বিছানা হয় না, বাবা-মায়ের সাথে এক বিছানাতেই তারা রাতে ঘুমায়। তো, ওই বয়সেই যখন মাঝরাতে তাদের ঘুম ভেঙে যায় এবং তারা বাবা-মাকে এমন অবস্থায় দেখে ফেলে যা তাদের দেখার কথা ছিল না, সেটা কি তাদের মনোজগতে খুব বড় প্রভাব ফেলে না?

এ তো গেল সরাসরি বাবা-মাকে সেক্স করতে দেখে ফেলা। এর বাইরেও আরেকটা জিনিস হলো কনডম। আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা এক্ষেত্রেও আবার কাণ্ডজ্ঞানহীনের পরিচয় দেন। তারা যেহেতু খুব ভালো করেই জানেন কনডম এমন একটা জিনিস যেটার নাগাল বাচ্চাদের পাওয়া উচিত না, তাহলে তারা কনডম কেন সেরকম কোনো জায়গায় রাখেন, যেখান থেকে বাচ্চারা খুব সহজেই বের করে ফেলতে পারে? আর কনডম যেহেতু অনেকটা সাধারণ বেলুনের মতোই, তাই বাচ্চারা কি সেটা দেখে খুব সহজেই আকৃষ্ট হবে না? একে তো বাবা-মায়েরা কনডম বাচ্চাদের নাগালের মধ্যে রেখে প্রথম ভুল করেই ফেলেন, তারপর দ্বিতীয় ভুলটা তারা করেন বাচ্চাদেরকে কনডম হাতে দেখে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে, যেমন মারধোর করে বা ধমক দিয়ে। বাচ্চারা তো সাধারণ বেলুনই ভেবেছিল জিনিসটাকে। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারল কনডম আসলে সাধারণ কিছু না, তাদের কৌতূহলী মন তো জানতে চাইবেই কনডমের আসল কাজ তবে কী!

শুধু বাবা-মায়েরই বা দোষ দিয়ে কী লাভ! এই তালিকায় যোগ করতে হবে চাচা-ফুপু-মামা-খালা কিংবা বয়সে বড় ভাইবোন ও কাজিনদেরকেও। বাচ্চাদের সামনে নিষিদ্ধ কাজ করতে তারাও কি কম যান নাকি! বরং বাবা-মা যদিও বা অনেকক্ষেত্রে সাবধান থাকেন, শেষোক্ত শ্রেণীর মানুষগুলো সেগুলোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজনই বোধ করেন না। আরো সর্বনাশের বিষয় হলো, এদের মধ্যে অনেকেই আবার মজার ছলে বাচ্চাদের প্রাইভেট পার্টসে বারবার হাত দেন, নাড়াচাড়া করেন। এর চেয়ে বেশি যৌন নিপীড়ন যদি তারা বাচ্চাদের না-ও করেন, তবু এগুলো কি কম নাকি!

চাচা-মামা-খালা-ফুপু শ্রেণীর অবিবাহিত গুরুজনদের বা অপেক্ষাকৃত বড় ভাইবোন ও কাজিনদের মাঝে আরেকটি গুণও দেখা যায়। সেটা হলো লুকিয়ে লুকিয়ে রগরগে চটি বই পড়া, ম্যাগাজিনে নগ্ন নারীদেহ দেখা কিংবা পর্ন ছবি দেখা। অনেকে আবার সেক্স সিনের জন্য ইংলিশ সিনেমাও দেখেন। এক্ষেত্রেও তারা ছোট ছোট ভাইপো-ভাইঝি, ভাগনে-ভাগনি বা কাজিনদের মানুষ বলেই গণ্য করেন না। তাই তাদের সামনেই এগুলো পড়েন, দেখেন, এবং মাস্টারবেট করেন। সেগুলোর মাধ্যমেও কিন্তু অনেক বাচ্চাই সেক্স সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করে, নিজেরাও অনুরূপ কিছু করতে উৎসাহী হয়।

বিয়ের আসরে বা পরবর্তী দিনগুলোতেও বাচ্চাদের সামনে এমন অনেক কথাবার্তাই গুরুজনেরা বলেন, যেগুলো তাদের বলা উচিত নয়। যেমন ধরুন 'আজ রাতে তো খুব খেলা হবে!' কিংবা 'গত রাতে কী কী করলি?' বাচ্চারা যখন দেখে বড়দেরকে খুব রসিয়ে রসিয়ে এসব কথাবার্তা বলতে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনেও কিন্তু এসব ব্যাপারে আগ্রহ জন্মে। 

আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকাগুলোরও একটা বড় ভূমিকা থাকে বাচ্চাদের সামনে সেক্সের বিষয়টা তুলে ধরতে। এমন অনেক পত্রিকার মাঝের পাতাতে হারবাল কোম্পানির বিজ্ঞাপনের নামে সরাসরি চটি গল্পই ছাপিয়ে দেয়া হয়, যেগুলো পড়ে অল্প কথায়ই সেক্স সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে যায় বাচ্চারা। এছাড়া রাস্তায় রাস্তায় হারবাল কোম্পানির চটকদার বিজ্ঞাপন তো আছেই!

আর হ্যাঁ, সমবয়সীদের কাছ থেকে জানাটাও খুব বড় একটা বিষয়। একটা বাচ্চা সেক্স সম্পর্কে জানা মানে কিন্তু তার একার মধ্যেই বিষয়গুলো সীমাবদ্ধ থাকা না। সে নিজে তো জানবেই, পাশাপাশি নিজের আশেপাশের আর পাঁচটা বাচ্চাকেও শিখিয়ে দেবে এসব। এভাবে বিষয়গুলো আর প্রায় কোনো বাচ্চার কাছেই গোপন থাকবে না। যেমন আমাদেরও কিন্তু ক্লাস সিক্স শেষ হওয়ার আগেই সব ছেলে সেক্স সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল। যে দুই-তিনজন জানত না, তাদেরও আর জানার বাকি ছিল না!

এতক্ষণ যেগুলো বললাম, এগুলো সেই ২০০৯ সালের দিকে আমাদের ক্লাস সিক্সের ছেলেদের সেক্স সম্পর্কে জ্ঞান লাভের নেপথ্য কারণ। এরপর গত এক দশকেরও বেশি সময়ে দেশ তো অনেক এগিয়ে গেছে। সব কিছুর কত উন্নতি (!) হয়েছে। এখন সেক্স সম্পর্কে জানা আগের তুলনায় অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। 

তিন-চার বছর বয়সী বাচ্চাদের হাতে হাতে মোবাইল, ট্যাব। ইউটিউবে ভিডিও দেখছে, গেম খেলছে তারা। এগুলো করতে গিয়ে কতজনে যে ১৮+ কনটেন্টও দেখে ফেলছে, তার কি কোনো হিসাব আছে? তার উপর আবার বাচ্চাদের হাতে তুলে দেয়া মোবাইল, ট্যাব ইত্যাদিতে অনেকের লগইন করা থাকে নেটফ্লিক্স, প্রাইম ভিডিওর অ্যাকাউন্টে, যেগুলোর অনেক সিনেমা বা সিরিজই ছোটদের দেখার উপযোগী না। এছাড়া অনেকের ড্রাইভের সিংহভাগ জায়গা জুড়ে থাকে এইচডি পর্নের বিশাল সমাহার। সেগুলোর মাধ্যমেও বাচ্চাদের হামাগুড়ি দেয়ার বয়সে হয়ে যায় যৌন অভিজ্ঞতার হাতেখড়ি। 

মানে এক কথায় বলতে গেলে, এখন বাচ্চাদের আর ক্লাস ফাইভ-সিক্স পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয় না, তারও অনেক আগেই এসব ব্যাপারে তাদের পিএইচডি হয়ে যায়। সেক্স নিয়ে তাদের মনে নানা বিকৃত ধারণার জন্ম হয়, কিংবা তারা ফ্যান্টাসির জগতে বিচরণ করতে থাকে। এই বাচ্চারাই যদি বড় হয়ে নিজেদের বিকৃত কামনাবাসনা চরিতার্থ করতে গিয়ে ধর্ষক হয়ে যায়, সেটা কি খুব অবাক কোনো বিষয় হবে?

তাই বাচ্চাদের ভুলভাবে সেক্সের সাথে পরিচিত হবার যে কারণগুলো এতক্ষণ বললাম, সেগুলো বন্ধ করা অতি জরুরি। শুরুটা বাবা-মায়েদের সচেতনতার মাধ্যমেই হোক। কেননা বাবা-মা যতদিন এসব ব্যাপারে উদাসীন থাকবেন, ততদিন বাচ্চারা সেক্স বিষয়ে অবসেসড হতেই থাকবে, আর তাদের ভবিষ্যতও হতে থাকবে অন্ধকারাচ্ছন্ন।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা