শীতের রাতে গাছিরা রাতে খেজুর গাছে হাড়ি ঝুলিয়ে যায়। এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে খেজুরের রস হাড়িতে গিয়ে জমা হয়। একেক ফোঁটা পরিমাণে অল্প, কিন্তু তারাই অনেক হয়ে যখন জমা হয় তখন হাড়ি ভর্তি হয়ে পূর্ণতা পায়। জীবনটাও এমন, সবাই অল্প অল্প ভাল কাজ করলেই একসময় তা বিশাল কিছু হবে।
গিয়েছিলাম টিএসসিতে। একটা ভিডিও কন্টেন্ট বানানোর কাজে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। রাজপথে গাড়ির মিছিল। পাঠাও কারে রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে পাওয়া গেল একজনকে। তিনি ছিলেন টিএসসিতেই। চটজলদি গাড়ি পেয়ে আমরাও খুশি। গাড়িতে উঠে বসতেই পাঠাও ক্যাপ্টেনের দিকে খেয়াল করলাম। মধ্যবয়স্ক সৌম্য দর্শনের এক মানুষ। শাহবাগে গাড়ি আসতেই জ্যামে আটকে গেল। ম্যাপে দেখাচ্ছে, কাওরানবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ জ্যাম। সময় কাটাতে আলাপ শুরু হলো পাঠাও ক্যাপ্টেনের সাথে।
মানুষটা কথা বলা শুরু করতেই বুঝলাম, তিনি বেশ স্মার্ট। কথা বলেন বেশ গুছিয়ে। প্রযুক্তি সম্পর্কে তার ধারণা আছে, আইডিয়া আছে সাম্প্রতিক দুনিয়ার ব্যাপারেও। জিজ্ঞেস করলাম, কতদিন ধরে গাড়ি চালান? বললেন বেশি দিন না। ১৯৮৫ সাল থেকে শুরু করেছি। মানে এখন প্রায় চৌত্রিশ বছর হয়ে গেছে, এই পেশায় তার বয়স। গাড়ি চালাতে আর ভাল লাগে না তার। আমরা একটু অবাকই হলাম। এটা কি এক পেশায় দীর্ঘদিন থাকার কারণে বিরক্তি চলে এসেছে এমন কিছু? না। তিনি যা বললেন, তা সচরাচর আপনি কোনো ড্রাইভারের মুখে শুনবেন না। তিনি বললেন, কেউ ট্রাফিক আইন মানতে চায় না, যে যার মতো গাড়ি চালাচ্ছে৷ অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা করে বেড়াচ্ছে একজন আরেকজনের সাথে। ইন্ডিকেটর ছাড়া হুটহাট এদিক সেদিক মোড় নিচ্ছে। পত্রপত্রিকায় তিনি দেখতে পান, প্রায়ই দূর্ঘটনায় লোক মারা যাচ্ছে। এসব দেখে তার খারাপ লাগে। এখন আর এই পেশায় থাকতে ইচ্ছে করে না। মানুষ বুঝতে চায় না ট্রাফিক আইন, রাস্তায় চলাফেরার শৃঙ্খলা নেই। ট্রাফিক পুলিশদের কেউ কেউ আবার কাজে শিথিলতা দেয়, আইনের প্রয়োগটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। লোকজন শুধু অভিযোগ করে বেড়ায় সিস্টেম নিয়ে আবার নিজে বিপদে পড়লে ঠিকই অমুক তমুকের পরিচয় দিয়ে ছাড় পেতে চায় আইনের হাত থেকে।
তিনি তারপর আরো একটি অদ্ভুত সুন্দর পয়েন্ট ধরলেন, যেটা আমিও ভেবেছি আগে। এক দেশে মানুষ দুই রকম ব্যবহার করে। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ায় ঢুকলে সবাই সভ্য হয়ে যায়, নিজ থেকে আইন মানে। কেউ সেখানে গিয়ে অমুক তমুকের পরিচয় দিয়ে বেড়ায় না। সেখানেও তো সিগনাল পড়ে, বাতি জ্বললে থেমে যায় সবাই নিজ থেকে, বাতি জ্বললেই আবার যাত্রা। কারো কোনো বিরক্তি নেই, তাড়াহুড়া নেই সেখানে। কিন্তু, এই মানুষগুলোকেই কেন বাইরে আইন মানানো যাচ্ছে না?
আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম তার কথা। তিনি দেশ সম্পর্কে বেশ খোঁজ রাখেন। এই অভ্যাস হয়েছে স্কুল জীবন থেকে। সেসময় তিনি পত্রিকা পড়ার অভ্যাস রপ্ত করেছেন, যা এখনো ধরে রেখেছেন। পড়ার অভ্যাস মানুষকে যে কতটা সভ্য করে, তা এই মানুষটার কথা শুনেই উপলব্ধি করতে পারলাম। তিনি নিজে অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে হাইস্কুলের বেশি পড়তে পারেননি। কিন্তু, এখন তার ছেলেমেয়েরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাদের পড়ালেখা করাতে চান আরো অনেক দূর। তাদেরও পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করিয়েছেন। কোনো কিছু শুনেই জাজমেন্টে চলে যান না, তিনি বিষয়গুলো গভীরে ভাবতে চেষ্টা করেন। পড়ার অভ্যাস তাকে এই চিন্তাভাবনাগুলো করতে সুবিধা দিয়েছে।
তিনি যখন এই পেশায় আসেন তখন নাকি দেশে সরকারি ছুটি মাত্র একদিন, শহর সেদিন ভীষণ ফাঁকা থাকত। অথচ, এখন ছুটির দিনেও রাস্তাঘাট জ্যাম লেগে থাকে৷ আমাদের শহরে উন্নয়ন হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে, রোডঘাট উন্নত হচ্ছে কিন্তু জ্যাম কমছে না। কারণ, সবাই এখন শহরমুখী। শুক্রবার কত বেকার চাকরির ইন্টারভিউ দিতে শহরে আসে। প্রতিদিন কত মানুষ ডাক্তার দেখাতে শহরে আসে। সব কিছুই শহরকেন্দ্রিক৷ তিনি মনে করেন, ঢাকা থেকে চাপ কমাতে না পারলে, বিকেন্দ্রীভূত না করতে পারলে কখনোই জ্যাম কমবে না।
প্রত্যেকদিন তার গাড়িতে কতশত যাত্রী উঠে। তারা কতরকমের আলাপ করে। তিনি নিশ্চয়ই বুঝেন, মানুষের ভাবধারা। জিজ্ঞেস করলাম, মানুষের চিন্তাভাবনা কেমন? তিনি আসলে বেশ আশাবাদী মানুষ। তার মতে বেশিরভাগ মানুষই ভাল। কিন্তু, অল্প কিছু খারাপ মানুষের কারণে মানুষ সবসময় তটস্থ হয়ে থাকে। তিনি উদাহরণ দিলেন, বায়তুল মোকাররমে শুক্রবারে হাজার হাজার মানুষ নামাজ পড়তে যায়। সেখানে জুতাচোর থাকে সর্বোচ্চ বিশজন। এই বিশজনের কারণে হাজার হাজার মানুষ জুতা চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকে। এতেই প্রমাণিত হয়, ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি, শুধু তারা একটু গুটিয়ে রাখে, আশঙ্কায় থাকে। এটা কেটে গেলেই পৃথিবী আরো সুন্দর হবে। মানুষের মধ্যে মানুষের বিশ্বাস জন্ম নিলেই পৃথিবী আরো বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। এই বিশ্বাসটা তৈরির ক্ষেত্রে রাজনীতি এবং শিক্ষা ভাল ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি মনে করেন। একসময় এদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন, সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, ভাসানীর মতো নেতারা রাজনীতি করে গেছেন। কিন্তু, আজকাল রাজনীতির সেই গুণগত মানটা নেই। রাজনীতিবিদরা এখন এটাকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের একটা প্লাটফর্ম বানিয়ে ফেলছেন। তারা যদি দেশটাকে আরো বেশি অন্তর দিয়ে অনুভব করেন, তাহলে অনেক কিছুই বদলে যাবে। এখন মিছিলে লোক ভাড়া করতে হয়, বঙ্গবন্ধুর সময় এমন ছিল না। সবাই নেতা হিসেবে মানতো তাকে। আজকাল জোর করে নেতাকে মান্য করা শেখানো হয়। শিক্ষার ব্যাপারে তার মতামত, মানুষ আগের চেয়ে শিক্ষিত হচ্ছে একই সাথে মানবিক জায়গাগুলো ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে। আজকাল পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, ছেলে মাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। এই খবরগুলো তো আসার কথা না। মা বাবার সম্মান যে রাখতে পারে না, সে কোথাও সম্মানজনক কিছু অর্জন করতে পারবে না। তাই শিক্ষা শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য না, মানবিকতা শেখারও জায়গা হওয়া উচিত। তিনি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষকদের সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয় কিন্তু বাংলাদেশে কৃষক কষ্ট করে ফসল ফলিয়ে ন্যায্য দাম পায় না। সবাই বড় চাকরি করে, বড় বড় পদ দখল করে কিন্তু মাটির প্রতি শিকড়ের প্রতি ভালবাসা দেখায় কয়জন! অথচ, এই মাটি, কৃষক এদের বাদ দিলে আমরা কিন্তু কিছুই না।
তার কথায় মুগ্ধ হয়েছি। সে রেশ এখনো কাটেনি। এত পরিষ্কার চিন্তাভাবনা খুব কম মানুষই করতে পারে। একজন মানুষ জীবন থেকে নেয়া শিক্ষাটাও যদি ধারণ করতে পারে তাহলে কি অসাধারণ হতে পারেন, সেটাই শিখতে পারলাম উনার থেকে। গাড়িতে বাকিরা সবাই ঘুমিয়ে গেছে। ক্লান্ত দেহ। যাত্রাপথও শেষের দিকে। তার একটা কথা ভীষণ ভাল লেগেছে। খেজুর গাছের উদাহরণ দিলেন। শীতের রাতে গাছিরা রাতে খেজুর গাছে হাড়ি ঝুলিয়ে যায়। এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে খেজুরের রস হাড়িতে গিয়ে জমা হয়। একেক ফোঁটা পরিমাণে অল্প, কিন্তু তারাই অনেক হয়ে যখন জমা হয় তখন হাড়ি ভর্তি হয়ে পূর্ণতা পায়। জীবনটাও এমন, সবাই অল্প অল্প ভাল কাজ করলেই একসময় তা বিশাল কিছু হবে। সকল ড্রাইভাররা নিজের জায়গায় একটু একটু করে আইন মেনে চললে, সকল মানুষ একটু একটু ধৈর্য্য ধরে আইনের ধারায় চললে, সকল দায়িত্বশীল মানুষ একটুখানি যদি নিজের জায়গায় আরো বেশি দায়িত্বশীল হয়, তাহলে এই এক ফোঁটা করে ভাল কাজ একটা দেশকে পুরোপুরি বদলে দিবে! তিনি বিশ্বাস করেন, ভাল দিন আসবেই, এর চেয়েও ভাল দিন। গাড়ি থেকে নেমে তার সাথে ছবি তুলতে চাইলাম। তিনি রাজি হলেন না, বললেন ছবি তুলে কী হবে! আমরাও আর জোরাজুরি করলাম না। থাকুক না কিছু মানুষ তাদের মতো, ছবি তুলতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই! তার চিন্তাটুকু ছড়িয়ে দেয়াটাই তো মূল ব্যাপার...