ভুটানের সংবিধান পড়লে আপনি বিস্মিত হবেন। সেখানে রাষ্ট্রধর্মের কথা নেই। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- দেশের আয়তনের মোট ৬০% বনজঙ্গল রাখতেই হবে!

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না, যদি তাদের রাজা নিজে স্বপ্রনোদিত হয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা না করতেন। তাদের রাজাদের বলা হয় ড্রাগন কিং। যিনি প্রথম নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই ড্রাগন কিংয়ের নাম জিগমে সিংগায়া ওয়াংচুক (Jigme Singya Wangchuk)। ড্রাগন ব্যাপারটা আরো গভীরের। ভুটানকে বলা হয় ‘ল্যান্ড অফ থান্ডার ড্রাগন (Land of Thunder Dragon)’। কারণ ভুমি থেকে অনেক উঁচুতে পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে হওয়ায় সেখানে প্রচুর মাত্রায় বজ্রপাত হয়। মজার ব্যাপার হলো- তাদের পতাকায় থান্ডার ড্রাগনের ছবিটা দেওয়া আছে। 

ভুটানের সংবিধান পড়লে আপনি বিস্মিত হবেন। সেখানে রাষ্ট্রধর্মের কথা নাই। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- দেশের আয়তনের মোট ৬০% বনজঙ্গল রাখতেই হবে। যদিও তাদের বনের পরিমাণ ৭২%। তবুও তারা সন্তুষ্ট নয়। দেশে জাতীয় উৎসব হিসেবে গাছ লাগানো কর্মসূচি পালন করে প্রতি বছর। আমাদের ঈদ-পূজার মতো তাদের ‘বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি’ মহানন্দে পালন করা হয়।

তাদের বন-জঙ্গল নিয়ে সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপারটি হলো- ভুটানকে কার্বন-সিংক বলা হয়। দেশের সমস্ত জনগণ এবং কারখানা একত্রে যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে, তার চাইতেও অধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে তাদের বনজঙ্গল। সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণের দেশ চীন আর ভারতের মতো বিশাল জনপদের মাঝখানে তারা অল্প একটু ভূমি নিয়ে আছে। কারো সাতপাঁচে না থাকলেও ভারত-চীনের বিশাল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে পরোক্ষভাবে দুই দেশের উপকার করছে।

এমনই বন-জঙ্গলে ঘেরা সমগ্র ভুটান!

পরিবেশের জন্য তারা যা যা করছে, পৃথিবীর কোন দেশে তেমন কিছু ঘটে নাই। একবার এক রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে ভুটানের এককোনায় দেখা গেল। একই টাইগারকে দুই বছরের মাথায় ভুটানের আরেক কোণে দেখা গেছে। সুন্দরবনের বাঘ কীভাবে পঞ্চগড়ে দেখা যাবে? যদি পঞ্চগড় এবং সুন্দরবনের মাঝবরাবর একটা সবুজ করিডোর বানানো যায়, তাহলে বাঘ তো নির্বিঘ্নেই যাবে, তাই না? তাদের জঙ্গলগুলো একটার সাথে আরেকটা সবুজ করিডোর দিয়ে সংযুক্ত। 

এদেশে রেপ করে পার পেলেও ভুটানে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত একটা বন্যপ্রাণি মেরে ফেলে তাকে লাইফ-লং কারাগারে কাটিয়ে দিতে হয়। ভুটানে কোন রাস্তায় স্ট্রিট সিগন্যাল লাইট নাই। কারণ অতিরিক্ত স্ট্রিট সিগন্যাল লাইট মানেই বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ মানেই অতিরিক্ত শক্তিব্যয়। ফলে পরিবেশ দূষণ হবে। তাই তারা সিগন্যালের চাইতে ট্রাফিক পুলিশ ব্যবহার করে। যদিও থিম্পু ছাড়া অন্য কোথাও ট্রাফিক পুলিশ নাই। 

ভুটান বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পরিবেশ রক্ষার্থে তারা কোন আর্টিফিশিয়াল প্লান্ট ব্যবহার করেনি। ব্যবহার করেছে রিনিউয়েবল এনার্জি। ভ্যালিগুলোয় যে নদী বা হ্রদ আছে সেগুলোতে জলবিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপণ করেছে। নিজেদের চাহিদা পুরোটা মেটানোর পর অতিরিক্ত অংশ ভারতের কাছে বিক্রি করে। বাংলাদেশের কাছে ভুটানের বিদ্যুৎ বিক্রির পরিকল্পনা চলছে। পরিবেশ দূষন রোধে ভুটান ইলেকট্রিক কার ব্যবহার বাড়িয়েছে।

তাদের মুদ্রার নাম-ভুটানি ঙুলট্রুম। ভারতের রুপির সমমান। বাংলাদেশী মুদ্রায় এক ঙুলট্রুম ১.২১ টাকার সমান। ভুটান হলো দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ যেখানে তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ। দেশের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ভুটানে টেলিভিশন ও ইন্টারনেট নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৯৯ সালে সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। টেলিভিশনে কয়েকটি ভারতীয় চ্যানেল দেখানো হয়। এর উপরেও কড়া নজরদারি। 

ভুটানে স্কুল পর্যায়ে পড়ালেখা সম্পূর্ণ ফ্রি। কলেজেও কেউ না পারলে ফ্রিতেই পড়াশোনা করে। ভুটানের প্রত্যেকটি নাগরিকের জাতীয় পোশাক পরা বাধ্যতামূলক। পুরুষরা যে পোশাক পরে তার নাম- ঘো (Gho)। শরীরে একটা প্যাঁচানো বিশাল কাপড়। হাঁটু উন্মুক্ত। মজার ব্যাপার হলো তাদের ব্যাগপ্যাক ব্যবহার না করলেও চলে। ঘো-এর ভেতর তারা মোবাইল, কলম, ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখতে পারে। এমনকি স্কুল-কলেজের বইও তাদের ঘো-এর ভেতর রাখা যায়।

ভাবুনতো বাংলাদেশে কেউ শার্টের বোতাম খুলে বুকের ভেতর বই রেখে বোতাম লাগিয়ে ঘুরছে, কেমন লাগবে? এজন্যই বলা হয়- ঘো হল পৃথিবীর একমাত্র পোশাক, যার পুরোটাই একটা বিশাল ‘পকেট’। তারা তাদের বাচ্চাকাচ্চাদের ছোটবেলায় এই পকেটে রাখতে পারে, যেভাবে ক্যাঙ্গারু তাদের বাচ্চাকে রাখে বুকের থলির ভেতর। মেয়েরা পরে কিরা। দুই পোশাকের রঙচঙ আলাদা। মানুষের পোশাকে রঙ দেখেই ধারণা করা যায় কারা সামাজিকভাবে কেমন পদমর্যাদার।

ঐতিহ্যবাহী পোশাক ঘো ও কিরা

ভুটানের মাটির নিচে বিশেষ কিছু খনিজ পদার্থ আছে। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলো বের করবে না। কারণ পরিবেশের ক্ষতি হবে, এমন কিছুর বিপক্ষে রাজা-প্রধানমন্ত্রী-জনগণ সবাই এক। ভুটানে রেলপথ নাই। ভারতের সাথে চুক্তি চলছে বানানোর। তাদের এয়ারপোর্ট একটা। নাম- পারো (Paro)। একটা ডমেস্টিক এয়ারপোর্ট ছিল, সংস্কারের জন্য এখন বন্ধ। 

ভুটানে গেলে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র সহজে খুঁজে পাবেন না। ফুটবল-ক্রিকেট খুব কম দেখবেন। আর্চারি বা তীর-ধনুক তাদের জাতীয় খেলা। ভুটানে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু আনক্লাইম্বড পিকগুলো। যেখানে এখনো মানুষ চড়েনি। ভুটানিরা মনে করে এগুলো স্যাকরেড বা পবিত্র। তাই তারা সেগুলোর পবিত্রটা রক্ষা করে চলেছে। 

ভুটানে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় আপনি গাড়ি নিয়ে চলবেন অথচ কোন বাঁকেই গাড়ির হর্ণ শুনবেন না। তারা রাস্তায় নিজের দিকটায় গাড়ি চালায়। আর বনের পশুপাখিদের বিরক্ত করতে চায় না। ভুটানে দেখার মতো কী আছে? অনেক কিছুই আছে। রয়েল মানোস ন্যাশনাল পার্ক দর্শনীয়। ভুটানের ‘পারো’তে 'পারো ট্যাক্টস্যাং' নামে পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা বৌদ্ধমন্দির পবিত্র ও দর্শনীয় স্থান। এখানে বৌদ্ধগুরু, ভুটানের প্রধান বৌদ্ধধর্ম প্রচারক ‘পদ্মাসম্ভাবা’ তিন বছর, তিন মাস, তিন সপ্তাহ, তিন দিন, তিন ঘণ্টা ধ্যান করেছিলেন।

পাহাড়ের গায়ে সেঁটে থাকা দর্শনীয় ট্যাক্টস্যাং মন্দির

একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলি। পৃথিবীর সব দেশ তাদের উন্নয়ন মাপে জিডিপি দিয়ে। অর্থ দিয়ে। কিন্তু ভুটানে উন্নয়ন মাপার জন্য সরকারিভাবে ব্যবহার করা হয় জিএনএইচ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস)। দিনশেষে তারা সুখি কিনা, সেটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। 

একটা সময় আমেরিকার ইন্ডিয়ানা স্টেটের চাইতেও আয়তনে ছোট দেশ ভুটান নিজেদের পৃথিবীর কাছ থেকে স্বেচ্ছায় আড়াল করে রাখত। নিজেদের সংস্কৃতি-জীবন নিয়ে তারা নিভৃতে থাকতে চাইত। নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর দিকে সবাই ভালোবেসেই তাকাত। এজন্যই ইতিহাসে কখনোই তারা কারো দ্বারা নির্যাতিত বা শাসিত হয়নি। অথচ তাদের দুইপাশের দুই বৃহত্তম দেশ শাসন-শোষণের আখড়া। 

তাই বলে তারা পিছিয়ে? না। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পার ক্যাপিটা আর সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ ভুটান। এমন অসাধারণ একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বাংলাদেশে কেটেছে, এখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন (এমবিবিএস- ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ), পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন (এফসিপিএস- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়/তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) করেছে ভাবলে ভুটানকে আরো বেশি আপন আপন লাগে।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা