জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে যেভাবে ভারতকে পেছনে ফেলছে বাংলাদেশ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আইএমএফ বলছে, ২০২১ সালের মার্চ নাগাদ জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ভারতকে ছাপিয়ে যাবে বাংলাদেশ। করোনার এই মন্দার সময়ে ভারত যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখানে কিভাবে অর্থনীতির অগ্রযাত্রা ধরে রাখলো বাংলাদেশ?
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ গত মঙ্গলবার তাদের 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক' প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদনের দিক থেকে এবছর ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ ভারতকে ছাপিয়ে যাবে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মার্চ মাস নাগাদ ভারতের মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন দাঁড়াবে ১৮৭৭ ডলার, আর বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন হবে ১৮৮৮ ডলার। ভারতীয় মিডিয়াগুলো খুবই গুরুত্ব দিয়ে এই সংবাদ প্রকাশ করেছে, অর্থনীতির একটা সূচকে বাংলাদেশ তাদের টেক্কা দিচ্ছে- ১৩০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটির জন্য এটা মেনে নেয়া বেশ কষ্টকর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনায় মত্ত হয়েছে বিরোধিরা, তার ভ্রান্ত নীতির কারনেই ভারতের অর্থনীতির এই দুরবস্থা, মত দিয়েছেন অনেকে।
সোমবার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের যৌথ বার্ষিক সভা শুরু হয়েছে। সভার অংশ হিসেবে গতকাল আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশ করেছে। আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন। এখানে বলে রাখা ভালো, আইএমএফ পঞ্জিকাবর্ষ ধরে অর্থাৎ জানুয়ারি-ডিসেম্বর সময়ের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়। সাধারণ অর্থবছরের মতো জুলাই-জুন ধরে তারা হিসেব করে না।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩.৮ শতাংশ হতে পারে। সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বিশ্বের শীর্ষ তিন দেশের একটি হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকবে শুধু গায়ানা ও দক্ষিণ সুদান। এবছর মাত্র ২২টি দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হবে। ওই ২২টি দেশের একটি বাংলাদেশ। বাকি সব দেশের জিডিপি সংকুচিত হবে, প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, জাপানের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হবে।
আইএমএফের দেয়া তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি জিডিপি সংকোচন হবে লিবিয়ায়, প্রায় ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া ভেনেজুয়েলা, লেবানন, ফিজিতে ২০ শতাংশের বেশি জিডিপি সংকুচিত হতে পারে। কোভিড-১৯ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর টালমাটাল অবস্থা। আইএমএফ বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্যে ঋণাত্মক বা মাইনাস প্রবৃদ্ধি হতে পারে। কেবল চীনের প্রবৃদ্ধি ১.৯ শতাংশ হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের প্রবৃদ্ধি মাইনাস ১০.৩ শতাংশ হতে পারে। এই অঞ্চলে ভুটান ও বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে না বলে মনে করে আইএমএফ। এছাড়া সারা বিশ্বের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাইনাস ৪.৪ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে দাতা সংস্থাটি। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, জাপানের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধিও নেতিবাচক হবে বলে মনে করছে আইএমএফ।
গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী। মাথাপিছু আয় এবং জিডিপি বাড়ছে ক্রমশ, বাড়ছে ধনীর সংখ্যাও। সেটার সুফল সাধারন মানুষের গায়ে পুরোপুরি না লাগলেও, অর্থনীতি পরিমাপের সূচকগুলোতে বাংলাদেশ ওপরের দিকেই উঠছে ধীরে ধীরে। এই করোনাকালে গোটা বিশ্ব যখন থমকে আছে, তখনও বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ রেকর্ড করেছে প্রতি মাসেই।
গত ১০/১২ বছরে দেশের অর্থনীতি বেড়েছে কয়েকগুণ, নির্মাণ হয়েছে/হচ্ছে বড় বড় অবকাঠামো। রাজনৈতিক গোলযোগ বা হরতাল-অবরোধ না থাকায় ব্যবসা সম্প্রসারিত হচ্ছে, বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। চীন এবং ভারত বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন প্রকল্পে। এখনও দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, দুর্বল অবকাঠামো, বাজার নিয়ন্ত্রণের মতো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবুও বাংলাদেশ তার আপন গতিতে উন্নতি করে যাচ্ছে প্রত্যেকটি খাতে। গার্মেন্টস খাতে নানা সময়ে আঘাত এলেও এটির ওপর ভর করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নির্মাণ এবং ঔষধ শিল্প বিকশিত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সুনামও কুড়িয়েছে।
ভারতের সঙ্গে সরাসরি যদি তুলনা করতে যান, তাহলে দেখবেন, নারী শিক্ষার হার ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। নারীদের মধ্যে সন্তান গ্রহণের হারে আবার ভারতীয়রা এগিয়ে, যেটা নেগেটিভ পয়েন্ট। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে বেকারত্বের হার কম, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাও কম ঘটে। গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে ভারতের অবস্থান যেখানে প্রায় দুইশো দেশের মধ্যে ১৩৯ তম, সেখানে বাংলাদেশ আছে ৯৭ নম্বর অবস্থানে। সম্প্রতি চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় চীনা বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, ফলে বিপাকে পড়েছে ভারতীয় অনেক প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের অর্থনীতি ধুঁকছে। এসব ব্যাপার ভূমিকা রেখেছে ভারতের অবনমন আর বাংলাদেশের ঊর্ধ্বগমনে।
গত এপ্রিল মাসে প্রকাশিত আইএমএফের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক ২০২০, দি গ্রেট লকডাউন’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। ঠিক ছয় মাস পরে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বাড়িয়ে দিল সংস্থাটি। অবশ্য আগের রিপোর্টটি যখন করা হয়েছে তখন লকডাউনের কারনে দেশের সবকিছুই বন্ধ ছিল, অর্থনীতিও থমকে গিয়েছিল। গত জুন মাস থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য খুলতে শুরু করেছে। এপ্রিলের পূর্বাভাসে ২০২১ সালে ৯.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। এখন আইএমএফ বলছে, ২০২২ সালে তা কমে ৪.৪ শতাংশ হতে পারে। ২০২৫ সালে এটা ৭.৩ শতাংশে উন্নীত হবে।
আইএমএফসহ সব দাতা সংস্থা বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব পূর্বাভাস দিচ্ছে, তাতে একটা বার্তা পরিষ্কার, দেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় আছে। এটি আশাবাদী হওয়ার মতোই একটা ঘটনা, পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সঠিক পথেই আছে। তবে আনন্দে আত্মহারা হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি এখনও, করোনার সেকেন্ড ওয়েভ হানা দিলে ইউরোপ-আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, সেই ক্ষতির ধাক্কা এসে লাগবে বাংলাদেশেও। সেই ধাক্কা সামলানোটা খুব বেশি সহজ হবে না বলেই রায় দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন