পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং কী? কীভাবে করবেন পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
টেনিদাকে আমরা দেখিনি। তবে, আমাদের এলাকায় হানিফ মামার চটপটির দোকানটার সামনে খাড়া নাকওয়ালা কারো ভাষায় চাল্লু, কারো ভাষায় স্ট্রিট-স্মার্ট-কর্পোরেট বড় ভাই আসিফ ব্রো আছেন। সহজ ভাষায় মনের কথা বলে দেয়া ভাইকে নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয় এলাকায়, তার গল্পগুলিও দারুণ মজার। কিন্তু তার স্যালারির কথা শুনলেই চোখ কপালে ওঠে সবার। আজ অবশ্য আসিফ ভাই চটপটির দোকানে নেই। এলাকার সবচাইতে অ্যাম্বিশাস ছেলে, ইমরানের মেন্টরিং করতে এসেছেন একটা কফি শপে। চলুন তাঁদের আড্ডায় আমরাও যোগ দেই!
- কিরে ইমরান, বল কাহিনী কী?
- ভাই, আমার একটু পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং বিষয়ে সাজেশন দরকার।
- কসকি মমিন? ব্র্যান্ডিং শব্দটা কোথা থেকে আসছে জানিস? আমেরিকার কাউবয়েরা তাদের গরুগুলাকে চেনার জন্যে পশ্চাতদেশে আগুন গরম শিক দিয়া ছ্যাঁক দিত। এখন বল তোর কেন শখ হলো পার্সোনালি নিজের পশ্চাতদেশে নিজের ছ্যাঁক দেয়ার?
- ভাই, প্রেম করি ছয় বচ্ছর। সেই ক্লাস এইট থেকে। ভার্সিটি শেষেই বিয়া করব ভাই। কিন্তু বিয়ের জন্যে তো একটা ভালো চাকরি দরকার। তারপর বাবার রিটায়ারমেন্ট হতে আর মাত্র ৫ বছর। হাতে আমার ২ বছর।
- ওরে খাইসে আমারে। এত আগেই বিয়ে? পশ্চাতদেশে ডাবল ছ্যাঁক চাচ্ছিস?
- উফ ভাই এইসব তামাশা রাখেন। আমার রাতে টিউশনি আছে, কালকে পার্ট টাইম ইন্টার্নশিপের ইন্টারভিউ। একটু জলদি জলদি ছাড়েন আপনার সাজেশনগুলা।
- তোদের জেনারেশনটা সব জায়গায় ডোপামিন চুষতে চুষতে ভ্যাম্পায়ার হয়া যায়! আচ্ছা শোন। আগে বল, কী খাবি।
এটাই আসিফ ব্রোর মেন্টরিং এর মজা। যা খুশি খাওয়া যাবে, সাথে একদম টু দা পয়েন্ট অ্যাডভাইস। তবে কফিশপে ট্রিট ইমরানের মতো টগবগে ছেলেগুলাই পায়। বাকিদের জন্যে এলাকার হানিফ মামার আনলিমিটেড চটপটি-ফুচকা। এক প্লেট নাচোস, এক প্লেট বাফেলো উইংস আর দুটো হ্যাজেলনাট লাটের অর্ডার দিয়ে আসিফ ভাই তার বয়ান শুরু করলেন।
- দেখ ইমরান, ব্র্যান্ড হইতে চাইলে প্রথমেই বুঝতে হবে তুই কী চাস, কেন চাস। হিরো আলমও ফেমাস, সেফুদাও ফেমাস, নায়িকা পটানো সিক্স প্যাক ওয়ালা সালমান খানও ফেমাস, টেকগুরু খান একাডেমির সালমান খানও ফেমাস। কিন্তু একেকজনের ইনকাম, স্ট্যাটাস, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা সবই আলাদা।
- আচ্ছা ভাই, এটা তো অবভিয়াস।
- কথাটা শেষ করতে দে। তুই তো পড়িস বিজনেস স্কুলে। এখান থেকে টপাররা কই যায়? বিদেশে মাস্টার্স পিএইচডি বাদ দিলে, বাকিরা এমএনসি আর ব্যাংকে যায়। এখন তুই আমাকে বল, বড় এমএনসিগুলোর কয়জনকে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং করতে দেখসিস? কয়টা বিএটি, জিপি, ইউনিলিভার, রবি, বাংলালিঙ্কের ম্যানেজারের ফেসবুকে ৫০০০ ফলোয়ার আছে?
আসলেও কি সবার ক্যারিয়ারে ফলোয়ার প্রয়োজন? কয়টা এমটিও পোস্টে ইউটিউব সিলভার বাটন দেখে চাকরি দেয়া হয়? বরং অনেক ফলোয়ার কামানো ইনফ্লুয়েন্সারকে চাকরি দেয়ার আগে কোম্পানি ২ টা বিষয় ভাবে-
ক) এরে নিলে আমার কোম্পানিরে টাইম দিবে, না নিজের ফলোয়ারদের সাথে গুটুর গুটুর করবে সারাদিন? উইকএন্ডে কামলা দিতে ডাকলে, “আমার অমুক ভার্সিটিতে স্পিচ আছে ব্রো, কোম্পানির ব্র্যান্ডিংও হবে” বলে দৌড় দিবে না তো?
খ) এরে ফায়ার করে দিলে বা কোন সময় মিসকম্যুনিকেশন হইলে আবার নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের নেগেটিভ ব্র্যান্ডিং করে দিবে না তো? এইসব ইনফ্লুয়েন্সারগুলি তো আবার অনেক ইমোশনাল হয়। রোস্ট করে, এদের রোস্ট হয়। মাঝখানে কোম্পানির কোন স্ক্যান্ডাল হবে না তো?
- তাইলে কি পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং একদমই খারাপ কিছু?
- আরে তা না। পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং যে লাখ লাখ মানুষদের সামনেই করতে হবে এমন না। এমন মানুষও আছে যাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স তাদের ফলোয়ারের চাইতে কম। আবার এমন অনেক মানুষ আছে যাদের আমরা চিনি না, কিন্তু ঢাকা শহরে মাসে ২ লাখ টাকার ওপর বেতন পান এমন প্রতিটি মানুষ সেই মানুষদের চিনে, শ্রদ্ধা করে। তাদের পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং সোশ্যাল মিডিয়ার বদলে, সামনা সামনি হয়।
- ভাই, কিন্তু,
-আহহারে, কথাটা শেষ করি? এমন না যে, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সই জীবনের সব কিছু। একেক মানুষ একেক রকম। যাদের মানুষের সংস্পর্শে আসতে ভালো লাগে, তারা পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং পছন্দ করে। কারো জন্যে, এক লাখ ফলোয়ারের পর টার্গেট হয় দশ লাখ। কারো জন্যে, ৫০০০ মানুষই যথেষ্ট এবং এই ৫০০০ জনকেই দিনের পর দিন তার পার্সোনাল ব্র্যান্ড দিয়ে তিনি সার্ভ কিংবা স্যাটিসফাই করতে চান। এটা যতটা পেটের খোরাক, তার চাইতে মনের খোরাক। ওই দেখ, পেটের খোরাকের কথা বলতে বলতেই খাবার আইসা পড়ছে।
কুড়মুড়ে নাচোস আর চিকেন উইংসের ধোঁয়া দেখে আর দেরি করতে পারে না ইমরান। ভার্সিটিতে আজ তাড়াহুড়ায় লাঞ্চ হয়নি। আসিফ ব্রো আড়চোখে দেখেন। একটা উইংস হাতে নিয়ে ফুঁ দিতে দিতে কথা শুরু করেন।
- তো মূল কথা হলো, Personal branding for quality audience? Or quantity audience? For which career? Which industry? এগুলি যত আগে ঠিক করবি, যত কনফিউশন কমবে, তত জলদি ক্যারিয়ারে তরক্কি। এখন বল, কোন কোন ক্যারিয়ারের জন্যে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং ভালো? কথা বেঁচতে হয় যেখানে।
অ্যাড এজেন্সি, কিংবা রিল্যাক্সড কালচারওয়ালা কোম্পানির মার্কেটিং বা সেলস ডিপার্টমেন্টের চাকরি, অথবা যদি ভবিষ্যতে পাবলিক স্পিকার বা পারফর্মার হইতে চাস, তাহলেও ভালো। তুই তো রাজিবের হলুদে অরিজিৎ সিংয়ের গানটা হেব্বি দরদ দিয়া গাইলি। ইচ্ছা আছে নাকি? না থাকলেই ভালো তোর মতো গাইলে ওর নাম অরিজিৎ না হয়ে অরিহার হয়ে যাইত হাহাহা!
- ভাই, আপনে আবার সইরা যাইতাসেন আসল কথা থেকে।
-হুমম, এবারে আসল কথায় আসি।
মুখ বড় করে উইংসে একটা কামড় দিলেন আসিফ ব্রো। পরের শব্দটা বলার সময় মুখ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে এল।
- ক্রেডিবিলিটি। এর জন্যে লাগবে অথেন্টিসিটি আর কন্সিস্টেন্সি। প্রোফেশনাল লাইফের জন্যে, অথেন্টিক হইতে হবে। মানে যা কবি মন দিয়া কবি। নিজের ক্যারেক্টারের সাথে মেলে না এমন কিছু করতে যাবি না। কন্সিস্টেন্সি মানে নিয়মিত ঐ বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে, স্টাডি করতে হবে, আলোচনা করতে হবে। এবং ভালো পারফর্মেন্স ধরে রাখতে হবে।
- বুঝলাম ভাই, কিন্তু কীভাবে করব এই কাজটা সেটা একটু বলেন?
- এই জন্যে কাজে লাগাতে হবে জোশ স্ট্র্যাটেজি।
- জ্বি ভাই স্ট্র্যাটেজি জোশ বুঝলাম, কিন্তু স্ট্র্যাটেজিটা কী?
-আরে স্ট্র্যাটেজির নামই জোশ। জ-অ-অ-শ। জোশ স্ট্র্যাটেজি তো বুঝাবো, তার আগে বল এতক্ষণ যা বললাম তা শুনে কী বুঝলি?
- ভাই, নিজের পাছায় ছ্যাঁকা দিতে গেলে আগে কিছু জিনিস বুঝে নিতে হবে। দাঁড়ান, আমি একটু লিখে নেই।
ঝটপট স্মার্টফোন বের করে কিছু বিষয় নোট করে নেয় ইমরান।
-হ্যাঁ ভাই, আমি যা যা বুঝলাম-
প্রথমেই, আমি কী চাই সেটা বোঝা দরকার। কোয়ালিটি অব অডিয়েন্স, নাকি কোয়ান্টিটি অব অডিয়েন্স? আরেকটা বিষয় হইলো, সব চাকরির জন্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ার বেইজ লাগবে না। অ্যাডভার্টাইজিং বা সেলস বা মার্কেটিংয়ের জন্যে ভালো। পাবলিক স্পিকার বা ট্রেইনার হতে চাইলে ভালো। কিছু চাকরিতে লো প্রোফাইল রাখা বেটার। যেটা করব, নিজের সাথে মিলতে হবে। অথেন্টিসিটি লাগবে। ক্রেডিবিলিটি তৈরি করতে হবে।
- বাহ! ভালোই বুঝছিস তো। নিজের জন্যে শুরুতেই টার্গেট সেট করবি, কোয়ান্টিটি হলে কয়দিনে কত কোয়ান্টিটি, কোয়ালিটি হলে কোন ধরনের কোয়ালিটি। লিখে রাখবি। এরপর ৩ মাস পর পর চেক করবি। কিপ দ্য গুড, লিভ দ্য ব্যাড।
- ভাই পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও করা যায় এমন কিছু বলছিলেন মনে হয়।
- হুম। ঐ ব্যাপারে আজকে থাক, তুই তো এখনো চাকরি শুরু করিস নাই। আপাতত ভার্সিটির বেস্ট ফ্রেন্ডরা বাদে বাকিদের সাথে প্রোফেশনাল অ্যাটিচুড ধরে রাখিস। একটু ওয়েট রাখবি। এটুকুই এনাফ। এখন আসল কথায় আসি।
কথায় কথায় নাচোসের প্লেট ফাঁকা হয়ে এসেছে। ওয়েটার এসে হ্যাজেলনাট লাটে সার্ভ করে দিয়ে গেল।
- জোশ স্ট্র্যাটেজি যে কোন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মের জন্যে খাটানো যায়। বাংলা সিনেমার গরিবের ছেলে বড়লোকের কচি মাইয়া টাইপ ফর্মুলার মতো, এর গ্রহণযোগ্যতা যুগে যুগেই ছিল, থাকবে। আদম হাওয়া থেকে শুরু করে অ্যারিস্টটল প্লেটো আর আজকের দিনের ইয়ুথ আইকন- সবারই এই স্ট্র্যাটেজি।
ক) জরুরি কন্টেন্ট
এটা প্রথম ধাপ। তুই এস্কিমোর কাছে ফ্রিজ বেঁইচা নিজেরে বিশাল মার্কেটার মনে করতে পারিস, কিন্তু যদি ফ্রিজ কোন কাজেই না আসে তাইলে দুইদিন পরে ঐ এস্কিমো তোরে দেখলে হার্পুন নিয়া তাড়া করবে। তাই প্রথম কাজ হল, তুই কাদের সার্ভ করবি, তোর পার্সোনাল ব্র্যান্ডের কঞ্জিউমার বা খদ্দের বা মক্কেল কে তাদের বের করা। তোর ফ্রেন্ড লিস্টে ১৫০০ মানুষের ১৫০০ জনই তোর কন্টেন্ট চাইবে না, ঠিক যেভাবে স্কুল কলেজ ভার্সিটি কোথাও তোর প্রতিটি ব্যাচমেটই তোর ফ্রেন্ড হয় না।
এই খদ্দেরদের বের কর। এরপর, তুই যে ব্র্যান্ড তৈরি করতে চাস সেই সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের কোন কন্টেন্টগুলি সবচাইতে দরকারি? কোন প্রব্লেমগুলা তারা ফেইস করে? কীভাবে সেগুলি সমাধান করা যায়, তাই নিয়ে তোকে কন্টেন্ট দিতে হবে। মনে রাখিস, ৮০-২০ রুল। ৮০% কন্টেন্ট দিতে হবে অডিয়েন্সের সমস্যা সমাধান নিয়া, আর ২০% হইলো- আজকে অমুক সার্টিফিকেট পাইলাম, তমুক হ্যাডম বা সেলিব্রিটির সাথে এই হলো আমার দাঁত ক্যালানো সেলফি, গতকাল অ্যাওয়ার্ড জিতসি এইসব সেলফ প্রমোশন।
- ভাই, ফিল গুড কন্টেন্টের ব্যাপারে কিছু বলবেন? যেমন কিউট বিড়ালের ভিডিও, কিংবা হোমলেস মানুষকে ফাইভ স্টার হোটেলে নিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে এইগুলা শেয়ার করা কি ঠিক?
- শোন, ব্র্যান্ডিং আর ইমোশন, না ভুল বললাম। মার্কেটিং আর ইমোশনের সম্পর্ক হচ্ছে রুটি আর ময়দার মতো। ইটস নট থিওরিটিকাল ফিজিক্স, হিয়ার ইমোশন ট্রাম্পস লজিক। আর মানুষের মন ভালো করার চেষ্টা করা খুবই পজিটিভ একটা কাজ। শুধু, ব্যালেন্সটা ঠিক রাখিস। তুই তো আর স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হতে চাচ্ছিস না।
তবে কেউ ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করলে তাঁর জন্যে সোশ্যাল ওয়ার্ক রিলেটেড ফিল গুড কন্টেন্ট ভালো সাহায্য করবে। মোট কথা হলো, তোর ঐ টার্গেট গ্রুপকে হাই কোয়ালিটি তথ্য দিয়ে সাহায্য করা। তাদের আস্থা অর্জন করা। ট্রাস্ট উইল ট্রায়াম্ফ। এবার পরের পয়েন্টে আসি।
ইশ! লাটেতে একটু চুমুক দিয়েই মুখটা বিকৃত হয়ে গেল আসিফ ব্রোর।
- চিনি দেয়া হয় নাই এটা বলবে না!
- ভাই, হ্যাজেলনাট লাটে তো এমনিই মিষ্টি হয়।
- আরে, আমি চিনি বেশি খাই জানস না?
বাড়তি চিনি ঢালতে ঢালতে হঠাৎ আবার আফসোস আসিফ ব্রোর।
- এহ হে!
- ভাই, এবার কি মিস হয়ে গেল? আরো কম হইসে লাটেতে?
- মিস হইসে তবে কফিতে না, কথাতে। ব্র্যান্ড মানে কী বল তো?
- প্রমিজ। ব্র্যান্ড মানে প্রমিজ ভাই।
- ইয়েস! প্রমিজ মানে প্রতিশ্রুতি। একটা অঙ্গীকার। একটা সুন্দর সম্ভাবনা। এটা ক্লিয়ার করা দরকার! তোর ব্র্যান্ড কোন জিনিসকে রিপ্রেজেন্ট করে?
- স্টিভ জবস বললে মাথায় কী আসে? প্রেজেন্টেশন, আইফোন, অ্যাপল, ইত্যাদি। কিন্তু এগুলি কি প্রমিজ? প্রমিজ হচ্ছে এক্সেলেন্স, কিছুটা স্নব, অ্যাস্থেটিক্স, সফিস্টিকেশন ইত্যাদি।
কোকাকোলা? হ্যাপিনেস।
পেপসি? ইয়ুথ।
আবার দেখ,
হারকিউলিস? শক্তি, পৌরুষ।
অ্যারিস্টটল? জ্ঞানচর্চা, বয়ান।
মেরি কুরি? গবেষণা, রেডিওএকটিভিটি।
আইনস্টাইন? জিনিয়াস, ক্রিয়েটিভিটি।
ট্যারান্টিনো? স্টোরিটেলিং, ভায়োলেন্স।
ইন্দিরা গান্ধী? রাজনীতি, আদর্শ।
এনাদের কারোটা নিজেরা চর্চা করে কনশাসলি তৈরি করা, কারোটা কাজ করতে করতে রেপুটেশন দিয়ে তৈরি। রেপুটেশন তৈরি করতে বছরও লাগতে পারে, দশকও লাগতে পারে। সবচাইতে তাড়াতাড়ি কীভাবে নিজের প্রমিজটা সেট করতে পারিস সেটাই তোর লক্ষ্য। সেই জন্যে, তোর নিজের ব্র্যান্ডের প্রমিজ কী সেটা বের করতে হবে হবে।
- ভাই, বুঝলাম। এইটা নিয়ে পরে আবার আলোচনা করব। এখন বাকি বিষয়গুলা একটু বলেন।
রাতের টিউশনির আগে বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নেয়ার প্ল্যান ছিল ইমরানের। তাই একটু তাগাদা দিতেই হচ্ছে। আসিফ ব্রো ঘড়ি দেখেন। তারও ওঠা দরকার।
- হুমম। এরপরের গুলা জলদি বলতেসি।
খ) অনলাইন/অফলাইন কোর্স
তুই যে প্রমিজ দিচ্ছিস, সেই প্রমিজ ফুলফিল করতে গেলে, তোকে নিশ্চয়ই আরো ইমপ্রুভ করতে হবে। এক্সপার্ট বা থট লিডার হবার জন্যে ট্রেইনিং বা কোর্স খুবই দরকারি। টাকা দিয়াই যে করতে হবে এমন তো কথা নাই। মেলা ফ্রি কোর্স আছে, ভার্সিটিতে কত ওয়ার্কশপ হয়। প্রতি এক বা দুই মাস পর পর একটা করে ফেলবি আর পাবলিশ করবি। শুধু সার্টিফিকেট আপলোড দিয়ে বসে থাকবি না, কমসে কম ৩০০ ওয়ার্ডের একটা লেখাও দিবি, কী শিখলি সেটা নিয়ে। ভিডিও বানিয়েও দিতে পারিস। আর কিছু না পারলে, কোন একটা ভালো ভিডিও, বা টেড টক, বা ব্লগ লিঙ্ক শেয়ার করতে পারিস উইথ সাম পার্সোনাল নোটস। ভাবটা এমন, দেখ জনগণ, আমি এই কন্টেন্ট দেখিয়া এই শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়াছি। তোমরা কন্টেন্ট না দেখিয়াই আমার বদৌলত শিখিয়া লও। আর ভালো লাগিলে এই হইল লিঙ্ক।
- কিন্তু ভাই, রাবা খানের তো এটা করা লাগে নাই। সে তো মজার মজার ভিডিও দিয়েই এখন বিশাল ব্র্যান্ড।
চেষ্টা করেও নিজেকে প্রশ্ন করা থেকে থামতে পারেনি ইমরান। কৌতূহলের কী আর শেষ থাকে?
- আরে ভাই! আমি তো ভালো চাকরি পাবার আর বিজনেস ওয়ার্ল্ডে শাইন করার পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং নিয়ে বলতেসি। সেলিব্রেটি বা ইনফ্লুয়েন্সারদের স্ট্র্যাটেজি তো আরেকরকম। তবুও যখন জানতে চাইলি, এখানেও ঐ রুটি আর ময়দা- মানে ইমোশনের অনেক প্রভাব। কাউকে নিয়মিত আনন্দ দিতে পারলে তুই তাকে একসময় নিজের কঠিন ফ্যান হিসেবে পাশে পাবি।
সালমান খানকে দেখ, ফুটপাতে গাড়ি উঠায়ে মানুষ মারলো, বিরল হরিণ শিকার করল, তারপরেও ‘তেরে নাম’ দিয়ে সবাইকে কাঁদিয়ে ঠিকই এখন বলিউডের ‘ভাই’। মেল গিবসন ক্যারিয়ারের শুরুতে এত কিছু করসে, যে পরে হলিউডের মতো জায়গায় এন্টি-সেমিটিক (ইহুদি বিদ্বেষী) স্টেটমেন্ট দিয়েও টিকে গেছেন। সেলিব্রেটি ইনফ্লুয়েন্সার খেলায় আসলে আরো অনেক অ্যাঙ্গেল আছে, ওটা থাকুক আজকে। একজন গাইনোকোলজিস্টের কার্ডিওলিজির সব জিনিস না জানলেও চলে, ট্রিপল ই ইঞ্জিনিয়ারকে তো সিএসইর সব কিছু জানতে হয় না। তাই আপাতত তুই নিজের চরকায় তেল ঢাল। পরের পয়েন্টে যাই।
- জ্বি ভাই।
কথা শেষ করার আগেই কেশে উঠল ইমরান। স্মোকিং অ্যালাউড এই কফি শপে। সবখানে অনেক ধোঁয়া। আর কোন টেবিলও ফাঁকা নাই। কফিটা সুরুৎ করে শেষ করে বিল পে করে বিল্ডিংয়ের ওপরের ফ্লোরে ছাদে উঠল দু’জন। বারো তলার ওপর এই ছাদে নামাজ পড়ার জায়গা আর বেশ খোলা একটা ছাদ। বিল্ডিং মালিক ধার্মিক হবার কারণে এখানে স্মোকিং নট অ্যালাউড। রোদের নামগন্ধ নেই, আকাশে কমলা রঙের সূর্য সন্ধ্যার কোলে ডুবি ডুবি করছে এবং চমৎকার হাওয়া বইছে। চোখ বন্ধ করে, আকাশের দিকে তাকিয়ে, বুকভরে একটা নিঃশ্বাস নিলেন আসিফ ব্রো। এরপর ছাদের এপাশ থেকে ওপাশ হাঁটতে হাঁটতে আবার বলা শুরু করলেন। শেষ বিকেলের মনোরম বাতাসে ভেসে আসছে যেন আসিফ ব্রোর কথাগুলো।
গ) অনুসারী/ফলোয়ার অ্যানালাইসিস এবং ফলোআপ
কন্টেন্ট যেহেতু দিবি, একটা ক্যালেন্ডার বানায়ে ফেল। প্রতি সপ্তাহে একটা, বা মাসে দুইটা, ইভেন প্রতিদিন একটা, তোর যেমন সুবিধা প্ল্যান করে নে। দরকার পড়লে একটা এক্সেল শিট মেন্টেইন কর। কন্টেন্ট শুধু আপলোডাইলেই হবে না, তুই যেই কাস্টমার ধরতে চাচ্ছিস, তেমন মানুষের এনগেইজমেন্ট আছে কিনা তোর কন্টেন্টে, সেটার খবর নিবি।
যখন ফলোয়ার অথবা এই ব্যাপারে আলোচনা করতে কমেন্ট করে বা আড্ডা দিতে চায় এমন মানুষদের পাবি, তাদের সাথে আলোচনা করবি। এইসব আলোচনা থেকে আইডিয়া নিয়ে পরের কন্টেন্ট প্ল্যান আপডেট করবি। এদের সাথে শেয়ার করবি। শুরুর দিকে এটাকে এক ধরনের সার্ভিসিং ধরে নিতে পারিস। এখন কথা উঠবে, এটা কি বিজনেস যে সার্ভিসিং লাগবে?
তোরে একটা কথা বলে নেই ইমরান, কোন কিছু সাস্টেইনেবল না হলে, সেটার ইম্প্যাক্টও বেশিদিন থাকে না। তুই প্রথম চাকরি পাওয়া পর্যন্ত পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং করে ছেড়ে দিলে, এত কষ্ট তো ঐদিনেই শেষ। আর যদি পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং তোকে টাকা এনে দিতে পারে, তাহলে একদিন এটাই তোর একটা সেকেন্ড ইনকাম সোর্স হয়ে যাবে। এমনকি ফার্স্ট সোর্সও হতে পারে! তাই, আগে থেকেই সাস্টেইনেবল পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের ব্যাপারে ভাবতে বলব।
ফাইনালি,
ঘ) স্ট্র্যাটেজিক কোল্যাবোরেশন
সক্রেটিস কিন্তু নিজে কিছু লিখে যান নাই। ২৪০০ বছর আগের একটা মানুষকে আমরা চিনি, কারণ তাঁর ছাত্র প্লেটো গুরুর কথাগুলিকে লিখে গেছেন। সোজা কথা হইল, বড় হইতে চাইলে একা একা পারবি না। তোর ফিল্ডটাতে আর কারা কাজ করেন, কারা এক্সপার্ট, তাদের সাথে যোগাযোগ করবি। ভালো কোল্যাবোরেশনে গেলে তোর ব্র্যান্ডের রিচ বাড়বে, তোর নলেজ আর স্কিলও বাড়বে। তবে অবশ্যই মানুষ বুঝে কোল্যাবোরেট করবি। তোর বেস্ট ফ্রেন্ড, ভার্সিটির ইনফ্লুয়েন্সার, কিংবা জব করেন এমন সিনিয়র, অথবা কোন উদ্যোক্তা, বা ফ্যাকাল্টি মেম্বার, অপশনের শেষ নাই।
- ভাই, কনফিউজড লাগতেসে।
- ভালো তো, ভালো না? তা কোন ব্যাপারে?
- এত এত নিয়ম, কেমনে কী করব?
- শোন, যা যা বললাম, প্রতিটার ওপর স্রেফ ১০টা মিনিট করে দে। আপাতত এটুকুই। আস্তে আস্তে আরো আইডিয়া পাবি। আরো ক্লিয়ার হবে আইডিয়াগুলি।
দেখ, এত কিছু লাগে না ভালো একটা জব পাইতে। সিজিপিএ ৩.৫ এর ওপর রাখ, একটা ক্লাবে জয়েন করে, পলিটিক্স নিয়া পাগল না হয়া ঠিকমত কাজ কর, কাজগুলা শিখ, একটা পার্ট টাইম কর ৬ মাস-একবছর, নেটওয়ার্কিং চালায়ে যা, আর কোন ফিল্ডে কাজ করবি সেইদিক ঠিক করে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং করতে থাক। ফোকাসটা ঠিক রাখ। এত ভয়ের কিছু নাই। আমাদের এইচআরের একটা ছোট গল্প বলি।
এইচআরের এক্সিকিউটিভ নেয়া হবে, তিনজন ক্যান্ডিডেটের সিভি শর্টলিস্ট করা হইসে। রিক্রুটার আজম ভাই, প্রায়ই আমাদের সাথে আড্ডা দেন। উনি নিজে টাইম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে অবসেসড। সারাদিন ডিপ ওয়ার্ক, স্মার্ট গোল, ৮০-২০ রুল, আইজেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্স এইসব নিয়ে মাথাটা ধরায়ে দেন। তো উনি ক্যান্ডিডেটদের লিঙ্কডিন চেক করতে ঢুকসেন। সেকেন্ড জন পাঁচটা আর্টিকেল লিখসে, সবই টাইম ম্যানেজমেন্ট আর টিমওয়ার্ক নিয়া। এখন তুই বল, ইন্টার্ভিউ বোর্ডে উনি কারে দরদ দেখাবেন?
- বুঝলাম ভাই।
- কী বুঝলি?
- যে ফিল্ডে কাজ করতে চাই সেদিকে ফোকাস করে নিয়মিত কন্টেন্ট দিব। ৮০% অডিয়েন্সের প্রবলেম সলভ করার জন্যে, ২০% সেলফ প্রমোশন। কোর্স করে স্কিল বাড়াবো, পোস্ট দিব। একা একা সব না করে নিয়মিত কোল্যাবোরেট করব।
- আর ফলোয়ার অ্যানালাইসিস এবং এনগেজমেন্ট? পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ে আসলে যতটা নিজের জন্যে, তার চাইতে বেশি অডিয়েন্সদের জন্যে ভাবতে হয়। অডিয়েন্স খুশি থাকলে, তোর ছোট খাট ভুল তারা গায়ে মাখবে না। এটা তো আগেও বললাম, বলিউডের ভাইয়ের এক্সাম্পল দিয়ে।
- ভাই, আরেকটা কোয়েশ্চেন।
- আরো কোয়েশ্চেন? তোর না রাতে টিউশনি? সন্ধ্যা হয়ে গেল তো।
- লাস্ট ওয়ান ভাই। ব্র্যান্ডিং করতে গিয়ে যদি কোন ভুল কিছু লিখে ফেলি বা করে ফেলি, তাহলে কী করব?
- ভুল হইলে ইমিডিয়েট রেস্পন্স করতে হবে। অজুহাত না দিয়া, দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়া বলতে হবে। সাজেশন চাইতে পারিস ভুল শুধরানোর জন্যে। অথবা শুধরানোর জন্যে কী করবি সেটাও জানায়ে দিতে পারিস। সব শেষে, ভুলটা শুধরাইয়া আবার একটা পোস্ট। এই যে দেখেন জনতা আমি সব ঠিক করছি এখন আবার আমাকে ধোয়া তুলসী পাতা মনে করেন। চামড়াটা মোটা রাখবি, এই তো।
সব শেষে, একটা ব্যাপার আছে। সেটা হল কপাল। ভাগ্য। নিয়তি। চে গুয়েভারাকে তো চিনস? বিশাল মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী। মেসি ম্যারাডোনার আগে চে-কে দিয়েই আর্জেন্টিনা চিনত সবাই। লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো ছবি সারা পৃথিবীতে ভাইরাল। এই লোক সারাজীবন ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছে। কিন্তু তাঁরই মরার মুহূর্তের ছবিটারে ক্যাপিটালাইজ করেই সারা পৃথিবীতে লাখ লাখ টিশার্ট পোস্টার বিক্রি হইল, এখনও হয়। এটাই কপাল। এই জায়গায় আসলে আমরা জানি না, কার কপালে কী আছে। আমাদের কাজ হইল ট্রাই করতে থাকা। শিখতে থাকা। নিজেকে আপগ্রেড করতে থাকা। বাকিটা উপরে যিনি আছেন তাঁর হাতে।
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে দার্শনিক ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকান আসিফ ব্রো। একটু আগের কমলা রঙের সূর্যটা হলুদ আকাশের চৌবাচ্চায় ডুবে গিয়ে, এখন হালকা নীল একটা পৃথিবীকে চাঁদের অপেক্ষায় রেখে গেছে। বাতাসের বেগ আসিফ ব্রোর জেল মাখা চুলও এলোমেলো করে দিচ্ছে।
সারাদিনের অভিযান শেষে পাখিরা আশেপাশের গাছগুলিতে ফেরত আসছে। তাদের আবছা ছায়াগুলি পাশের পুকুরটাতে ভেসে ভেসে হারিয়ে যাচ্ছে। ডানা ঝাপটানো আর ক্লান্ত কণ্ঠের কিচিরমিচির ঢেকে দিয়ে পুকুরের পাশের একশ বছর পুরনো মসজিদটাতে মাগরিবের আযান শুরু হয়ে গেল। এরপর শুরু হবে ছাদের মসজিদের আযান।
মাঠের ক্রিকেট খেলতে থাকা ছেলেগুলি হতাশ, এখন ঘরে ফিরতে হবে। ইমরানের চোখেমুখে বেশ আনন্দের ছাপ। আজকের টিউশনিটা ক্যান্সেল করবে ঠিক করে ফেলেছে। একটা আইডিয়া আসছে। কালকের ইন্টার্ভিউটার আগেই, একটা ছোট আর্টিকেল লিখে আজকে লিঙ্কডিন আর ফেসবুকে পোস্ট করে দিবে। আসুক রিক্রুটার চেক করতে সোশ্যাল মিডিয়া। মোস্ট ওয়েলকাম। আসিফ ব্রোকে থ্যাঙ্কস দিয়ে, একটা সেলফি তুলে ফেলে তাঁর সাথে।
- আপ্লোড দিলে, ট্যাগ দিস কিন্তু। আর ক্যাপশনে লিখবি, 'উইথ মাই পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং মেন্টর। ভাই, আপনি ক্যারিয়ার কোচ হবেন কবে?' সাথে এইটাও লিখতে পারিস। #প্রোক্যারিয়ারটিপস। ব্যাস। তোকে দিয়ে আমার ব্র্যান্ডিংটা হয়ে গেল। একটা সাইড ক্যারিয়ার রেডি রাখা তো ভালোই, কী বলিস? হাহাহা।
- ভাই, এইটাই তো স্ট্র্যাটেজিক কোল্যাবোরেশন!
- আরে, বাহ! তোর মাথায় তো দেখি ঘিলু আছে!
- উফ!
বিরাশি না হলেও অন্তত আশি সিক্কার একটা চাপড় পিঠে খেয়ে ইমরান একটু ঝুঁকে পড়ে। হাহাহা করে আবার হেসে ওঠেন আসিফ ব্রো। টেনিদাকে আমরা কেউ না দেখলেও, আসিফ ব্রোর দশাসই হাতের চাপড় আমরা খেয়েছি। এই চাপড়ে নাকি লাখ টাকার স্যালারির ভিটামিন আছে। তবে, এই ভিটামিনের কোনো গ্যারান্টি নাই।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন