বাবার কঠোর আচরণ যাকে বিশ্বের শীর্ষ ধনী বানিয়েছে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কোটিপতি বাবা থাকলেও, তার জীবন কেটেছে সংগ্রামে। অফিসে গিয়েছেন হেঁটে, ভার্সিটিতে ভর্তি হবার জন্য পাননি ডোনেশন, এমনকি বাবা নিজের কোম্পানীতে তাকে চাকরিও দেননি। সেই লোকটাই কিনা নিজের চেষ্টায় বিশ্বের সেরা ধনীদের একজন হয়েছেন!
সোনার চামচ মুখে দিয়ে তার জন্ম, বাবা ছিলেন কোটিপতি ব্যবসায়ী। তবে প্রাচুর্য ব্যাপারটাতে বাবার অ্যালার্জি ছিল, ছেলেকে মানুষ করেছেন একদম সাদামাটাভাবে, আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা যেভাবে বেড়ে ওঠে, সেভাবেই। ছেলের চাহিদা পূরণ করেছেন, তবে বিলাসিতা ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হতে দেননি। বাবার প্রতিপত্তি আর সম্পদের কথা তো ছেলে জানতো, আর জানতো, এগুলোর উত্তরাধিকারী সে-ই হবে। কিন্ত ধারণাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল একদিন।
গ্র্যাজুয়েশনের পর বাবার অফিসে চাকরি হবে, এমনটাই ভেবে রেখেছিলেন ফিলিপ হ্যামসন নাইট নামের সেই তরুণ। বাবা তাকে চাকরি তো দিলেনই না, উল্টো বললেন, 'নিজের যোগ্যতায় কাজ খুঁজে নাও। তোমাকে ভালো স্কুল-কলেজে পড়িয়েছি, বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত লালন-পালন করেছি, আমার দায়িত্ব এখানেই শেষ। এবার নিজের দায়িত্ব নিজে বুঝে নাও।' ফিল নাইটের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো এই কথা শুনে। সারাজীবন ভেবে রেখেছে, কলেজটা পার করলেই আরামের জীবন, পারিবারিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে- অথচ বাবা কিনা তাকে চাকরিই দিলেন না!
আরও বছর চারেক আগের কথা। হাইস্কুল পাশের পর ফিল বাবাকে বলেছিল, ভালো অঙ্কের ডোনেশন দিলে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে। ফিল জানতো, তাদের টাকার অভাব নেই। কিন্ত বাবা তাকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, "তুমি নিজের যোগ্যতায় যেটা অর্জন করতে পারবে, সেটাই তোমার। কারো দয়া দাক্ষিণ্যের আশায় বসে থেকো না, এমনকি আমার কাছেও আশা করো না।"
জেদ চেপে বসলো ফিল নাইটের মাথায়। একটা পত্রিকা অফিসে খুব সামান্য বেতনে চাকরি নিল সে। বাড়ি থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে ছিল অফিসটা। বাড়িতে কয়েকটা গাড়ি, অথচ তাকে অফিসে যেতে হতো পায়ে হেঁটে, কখনও আবার পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে। একটা সাইকেল কেনার টাকাও ছিল না, বাবার কাছেও চাইতে ইচ্ছে করছিল না। এমন নয় যে বাবার সঙ্গে ফিলের কোন মানসিক দূরত্ব ছিল। ফিলিপের বাবা উইলিয়াম নাইট নিজের চেষ্টায় শূন্য থেকে সাফল্যের শিখরে উঠেছিলেন, তিনি চাইতেন তার সন্তানও সেভাবেই পরিশ্রম করে সাফল্যকে আলিঙ্গন করবে। তার বানিয়ে দেয়া সৌধের ওপর চড়ে বসে থাকবে ছেলে- এটা উইলিয়াম পছন্দ করতেন না।
যাই হোক, ইউনিভার্সিটি অফ ওরিয়ন থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর কর্মক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না ফিল নাইট। যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে, রিজার্ভ ফোর্সে কাটালেন সাতটা বছর। জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন ভীষণ, যা করতে চেয়েছেন, সেটার ধারেকাছেও যেতে পারেননি, নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে পড়ছিলেন ক্রমশ। আত্মহত্যার কথাও ভেবেছেন কয়েকবার। তবে সেই চিন্তাকে দূর করে দিয়েছেন, টিকে থাকার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন নিজেকে।
রিজার্ভ ফোর্সে থাকার সময়টায় ভালোভাবে প্রস্তুতি নিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। সাত বছরের লম্বা একটা বিরতি দিয়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে চান্স পেয়ে গেলেন নিজের যোগ্যতায়। এখান থেকে মাস্টার্স করার পর আর চাকরির পেছনে ছুটে জুতোর তলা ক্ষয় করতে হয়নি, মাথার ভেতর তখন আইডিয়া গিজগিজ করছে তার।
ফিল নাইটের বন্ধু বিল বাওয়ারম্যান তখন একটা জুতোর ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। দুজনের গলায় গলায় ভাব। স্ট্যানফোর্ডে পড়া অবস্থায় হাতখরচের জন্য ফিল নিজেও সেই ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছেন। জুতার ব্যবসার নাড়ি-নক্ষত্র না জানলেও, ভালোই আইডিয়া ছিল এই জগতটা দিয়ে। ফিল শুনেছিলেন, জাপানের তৈরি জুতার কোয়ালিটি নাকি বেশ ভালো চলছে তখন। কিন্ত আমেরিকায় যেসব জুতা বিক্রি হয়, তার প্রায় সবই জার্মান মেড। ছবি তোলার শখ ছিল ফিলের, তিনি ভাবলেন, জাপের ফুজি ক্যামেরা এসে যদি বাকি সব ক্যামেরা কোম্পানির লাল বাত জ্বালিয়ে দিতে পারে, তাহলে জাপানের জুতাও তো অন্য সব জুতাকে টেক্কা দিতে পারে!
যেই ভাবা সেই কাজ। ফিল নাইট উড়াল দিলেন জাপানে, বিমান ভাড়ার টাকাটা অবশ্য বাবা দিয়েছিলেন। জাপানের কোব শহরে এসে দেখলেন, এখানে টাইগার ব্র্যান্ড নামের একটা কোম্পানী কম দামে দারুণ জুতা বানাচ্ছে। দামটা আমেরিকার তুলনায় এতই কম যে, এখান থেকে আমেরিকায় আমদানী করে নিয়ে বিক্রি করলেও ভালো অংকের একটা লাভ থাকবে ফিলের হাতে। ফিল সেই জুতা কোম্পানীর মালিক ওনিতসুকার সাথে দেখা করলেন। তাকে বললেন। তিনি টাইগার ব্র্যান্ডের জুতা আমেরিকায় আমদানী করতে চান। ওনিতসুকা শিপমেন্ট পাঠাতে রাজী হলেন। দুজনের চুক্তি হলো, আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে টাইগার ব্র্যান্ডের আমদানীকারক হবেন ফিল নাইট।
জুতার কিছু স্যাম্পল নিজের সঙ্গে আমেরিকায় নিয়ে এলেন ফিল, দেখালেন বন্ধু বিলকে। বিল সেই জুতার কোয়ালিটি দেখে এবং দাম শুনে এতই অভিভূত হলেন যে, ফিলের পার্টনার হতেই রাজী হয়ে গেলেন! আরেকদফা চুক্তি হলো বিলের সঙ্গে, জন্ম হলো ব্লু রিবন স্পোর্টস নামের একটা কোম্পানীর। এই ব্লু রিবন স্পোর্টসকেই এখন আমরা নাইকি নামে চিনি, বিশ্বের সর্ববৃহৎ জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, শীর্ষস্থানীয় স্পোর্টস ইকুইপমেন্ট নির্মাতা, হাজার হাজার কর্মচারী কাজ করে যেখানে, প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের টার্নওভার থাকে যে কোম্পানীর।
এই নাইকির জন্ম হয়েছিল ফিল নাইটের হাতে, যিনি কোটিপতি বাবার সন্তান হয়েও ছেঁড়ে জুতা পরে স্কুলে যেতেন, অফিসে যাওয়ার জন্য একটা সাইকেল যার ছিল না, সাত মাইল হাঁটা ছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিল না, ডোনেশনের অভাবে যিনি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করতে পারেননি সেই লোকটা আজ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের একজন, প্রায় পঁচিশ বিলিয়ন ডলারের বেশি তার সম্পত্তি। যে স্ট্যানফোর্ডে তিনি ডোনেশন না দিয়ে ভর্তি হতে পারেননি, সেখানেই এপর্যন্ত প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি দান করেছেন তিনি!
ব্যবসার দুনিয়াতে ব্যাডবয় হিসেবে সুখ্যাতি আছে তার। ফিল নাইটকে নিয়ে খুব জনপ্রিয় একটা প্রবাদ হচ্ছে- “You will remembered for the rules you broke!” অর্থাৎ ছাপোষা ভালোমানুষ হয়ে বসে থাকলে কেউ আপনাকে মনে রাখবে না, আইন ভাঙার কারণেই আসলে সবাই মনে রাখবে। ফিল নাইট আমেরিকান সরকারের অনেক আইনের কোনই তোয়াক্কা না করে বেশকিছু ব্যবসায়িক পদক্ষেপ নিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের হতভম্ভ করে দিয়েছিলেন। আমেরিকার বিজনেস কনসাল্টেন্টরা তাকে অভিহিত করেন 'পাগল' হিসেবে। হুটহাট এমন সব চমক নিয়ে হাজির হতেন তিনি, সেটা অন্যদের কল্পনার বাইরে ছিল। একটা সাধারণ জুতার ডিস্ট্রিবিউটর থেকে নাইকি তৈরি করেছেন যে লোক, তাকে তো সাধারণ পথে হাঁটলে চলে না।
এই গল্পটা নাইকির উত্থানের নয়, কোন জাদুবলে দুই বন্ধুর খামখেয়ালিপনা থেকে তৈরী হওয়া একটা কোম্পানী বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় স্পোর্টস ইকুইপমেন্ট নির্মাতায় পরিণত হলো, সেটাও এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। এই গল্পটা একজন সাধারণ মানুষ ফিলিপ হ্যামসন নাইটের, যিনি সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মানোর পরেও সংগ্রাম করে বেড়ে উঠেছেন, যাকে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ধাক্কা খেতে হয়েছে, ঠেকে শিখতে হয়েছে। সেই ধাক্কাগুলোই তাকে পরিপক্ক করেছে, আর পুরো গল্পটার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় অবদান ফিলের বাবা উইলিয়াম নাইটের।
বাবা চাইলেই স্বজনপ্রীতির মাধ্যেমে তাকে ব্যবসা বুঝিয়ে দিতে পারতেন, প্রাচুর্যের ভাগীদার করতে পারতেন। কিন্ত সেটা তিনি করেননি। পৃথিবীর শক্ত জমিনে ছেলেকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন লড়াই করার জন্য। বাবার অবদানের কথা ফিল নাইট বিনম্র চিত্তে স্মরণ করেন, কারণ বাবা কোন উদ্দেশ্য থেকে সেই কাজগুলো করেছিলেন, সেটা তিনি বুঝেছেন পরে। ফিল বলেন, বাবা তার সঙ্গে এমনটা না করলে কখনও নাইকির জন্ম হতো না, বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের একজন হয়ে ওঠা হতো না তার। বাবার ব্যবসা সামলেই জীবনটা পার করে দিতেন তিনি হয়তো...