সবচেয়ে যে শেষে এসেছিলো, সে গিয়েছে সবার আগে সরে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ফিলিপ হিউজ রিটায়ার্ড হার্ট ৬৩- এই লাইনটা লেখা থাকবে পরিত্যক্ত একটা ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচের স্কোরকার্ডে। জাতীয় দলে সবার ছোট, সবার আদরের ছেলেটাই যে হারিয়ে গেছে সবার আগে!
২৫শে নভেম্বর ২০১৪। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড, অস্ট্রেলিয়া। দর্শক সারিতে বসে আছেন ভার্জিনিয়া হিউজ। পাশে একমাত্র মেয়ে। পরিবারের আরো একজন মাঠে আছেন, সাদা পোষাক পরে বাইশ গজে, উইলো হাতে। তার খেলা দেখতেই সকাল সকাল কাজকর্ম ফেলে মাঠে আসা।
ছেলেটা ব্যাটিং করছে, উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। জাতীয় দলের হয়ে খেলে ফেলেছে ছাব্বিশটি টেস্ট, পঁচিশ ওয়ানডে আর একটি টি-২০। তবে গতবছর লর্ডস টেস্টের পর আর অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে চড়ানো হয়নি। সেটার জন্যে খুব বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হচ্ছে না। গত মৌসুমে শেফিল্ড শিল্ডে রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছে তাঁর ছেলে। আজও ব্যাট হাতে দারুণ ছন্দে আছে। ভারতের বিপক্ষে সিরিজ শুরু হচ্ছে কয়েকদিন পর। ইনজুরির জন্যে প্রথম টেস্ট খেলবেন না মাইকেল ক্লার্ক। নির্বাচকদের ভাবনায় পঁচিশ বছরের টগবগে তরুণ খুব ভালোভাবেই আছেন, মিডিয়া অন্তত তাই দাবী করছে। আর দিন পাঁচেক পরই ছেলের জন্মদিন, ঘরোয়া একটা পার্টি রেখেছেন তিনি। এসবই ভাবছিলেন তখন সম্ভবত।
রোদ ঝিকমিক করছে চারদিকে, নভেম্বরের এই সময়টা অস্ট্রেলিয়ায় গ্রীষ্মের শুরু। ভার্জিনিয়া স্কোরকার্ডের দিকে তাকালেন, তেষট্টি রানে ব্যাট করছে তাঁর ছেলে। চোখ মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে, রোদ থেকে বাঁচতে হ্যাটটা লম্বা করে টেনে নিলেন মাথার ওপর। দীর্ঘদেহী এক পেসার বল করছে এখন। ওভারের তিনটে বল হয়ে গেলো। আজ সেঞ্চুরী হবে তো? দেখা যাক।
শন অ্যাবোটের চতুর্থ ডেলিভারিটা শর্ট বল ছিলো। ব্যাটসম্যানের হেলমেটের পেছনে লাগলো লাল রঙের বলটা। ভার্জিনিয়ার চোখের সামনে বছর পঁচিশের তাগড়া ছেলেটা একটু ঝাঁকি খেলো যেন। হেলমেটটা খুলে ফেললো মাথা থেকে। তারপর হুট করেই পড়ে গেলো বাইশ গজে। মায়ের মন; ভার্জিনিয়া আঁতকে ওঠেন। তিনি বুঝে উঠতে পারেন না কি হলো। সাইটস্ক্রীনের দিকে তাকান, পড়ে যাওয়া ব্যাটসম্যানকে ঘিরে ততোক্ষণে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। সবার আগে বন্ধু ডেভিড ওয়ার্নার, ব্র্যাড হ্যাডিন, আর যার বাউন্সারে এই কাণ্ড, সেই শন অ্যাবোট।
ভার্জিনিয়ার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। এম্বুলেন্সের সাইরেন কানে বাজতে থাকে তাঁর। সেখান থেকে সিডনীর সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালের আইসিইউ'র সামনে নিজেকে আবিষ্কার করেন তিনি হঠাৎ। মাঝের সময়টা কেমন এক ঘোরে ছিলেন তিনি। কি হয়েছে, কি ঘটছে এখনও ঠিক তাঁর কাছে পরিষ্কার নয়।
২৭শে নভেম্বর ২০১৪, সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতাল, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের অনেক উত্থান পতন দেখেছেন মাইকেল ক্লার্ক, সয়েছেন বহু ঝড় ঝাপটা। কিন্ত এতোটা ভঙ্গুর কখনও মনে হয়নি তাঁকে। ফ্লানেলের একটা শার্ট আর ট্রাউজার পরে তিনি এসে বসেছেন ভিনসেন্ট হাসপাতালে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের সামনে, চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, পুরোপুরি বিধ্বস্ত একটা অবস্থা।
এখানে আসলে আসার কথা ছিলো ফিলিপ হিউজের পরিবারের কোন সদস্যের। কিন্ত হিউজের বাবা গ্রেগ, মা ভার্জিনিয়া বা দুই ভাইবোন জেসন ও মেগানের কারোই কথা বলার মতো অবস্থা নেই। সেই শক্তি ক্লার্কের নিজেরও নেই। কিন্ত হিউজের বন্ধু, সর্বোপরি অস্ট্রেলিয়ার দলপতি হিসেবেই এই অপ্রিয় কঠিণ কাজটা করতে হচ্ছে তাঁকে। পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিটাই শুধু পড়ে গেলেন তিনি। বার কয়েক গলা কেঁপে উঠল ক্লার্কের, বুকের ভেতর থেকে উত্তাল ঢেউয়ের মতো কান্নার দমক উঠে আসছিল, সেটাকে দমিয়ে রাখতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো। তাঁর চোখে ভেসে ওঠে ফিলিপ হিউজের অমায়িক হাসিটা, যে হাসির অধিকারী মানুষটা মাত্র ঘন্টাখানেক আগেই পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।
‘আমরা আমাদের প্রিয় পুত্র, ভাই ফিলিপের মৃত্যুতে শোকাহত। এ আমাদের খুব কঠিন সময়। ফিলিপের বন্ধু, সতীর্থ, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, সাধারণ মানুষ যাঁরা সহমর্মিতা জানিয়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ। ক্রিকেটই ছিল ফিলিপের জীবন’
এটুকু পড়ার পরই বাস্পরূদ্ধ হলো ক্লার্কের কণ্ঠ। উপস্থিত সাংবাদিকদের চোখগুলোও তখন ভেজা। হিউজের ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই অনেকে চেনেন তাঁকে, তাদের অনেকের সঙ্গেই ভালো বন্ধুত্ব ছিল এই ব্যাটসম্যানের। খুব আহামরি কোন ব্যাটসম্যান ছিলেন না ফিলিপ হিউজ। ছাব্বিশ টেস্টে তেত্রিশ গড়ে ১৫৩৫ রান, তিনটে সেঞ্চুরীর সাথে সাতটা অর্ধশতক। আর পঁচিশ ওয়ানডেতে ছত্রিশ ছুঁইছুঁই গড়ে ৮২৬ রান, অভিষেকেই করেছিলেন সেঞ্চুরি।
উচ্চতা ছিলো পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি, শর্ট বলে দুর্বলতা ছিলো খানিকটা, আর একারনেই থিতু হতে পারেননি জাতীয় দলে। আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। কিন্ত বুকভরা বারুদের ভাণ্ডার ছিলো। সময়ের ডানায় চড়ে ২০০৯ এ ফিরে যাই, দক্ষিণ আফ্রিকায়। অভিষেক টেস্টের ভেন্যু জোহানেসবার্গ। আউটফিল্ড আর পীচের রঙে খুব বেশী পার্থক্য নেই, দুটোই গাঢ় সবুজ। পেসারদের স্বর্গ, ফণা তোলা বাউন্সার আর সাপের মতো ছোবল মারতে উদ্যত ইনসুইং আউটসুইঙের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন ডেল স্টেইন, মাখায়া এনটিনি আর মরনে মরকেল। নামগুলো শুনলেও ব্যাটসম্যানদের পিলে চমকে ওঠার কথা। অথচ বিশ বছর বয়েসী হিউজ নাকী ওপেনিং পার্টনার সাইমন ক্যাটিচকে বলেছিলেন, আমি স্ট্রাইক নেবো! শূণ্য দিয়ে শুরু করলেও, দ্বিতীয় ইনিংসেই খেলেছিলেন ৭৫ রানের লড়াকু এক ইনিংস; তারপর সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেছিলেন-
"আমি জানি আমি একজন ছোটখাটো গড়নের ব্যাটসম্যান, ওরা(বোলার) তো আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতেই চাইবে। আমি এই জিনিসটাই উপভোগ করি"
পরের টেস্টেই দক্ষিন আফ্রিকার পেস আক্রমনকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে দুই ইনিংসেই করেছিলেন জোড়া সেঞ্চুরী। যেটা কিনা সবচাইতে কম বয়সে জোড়-সেঞ্চুরীর রেকর্ডও! ক্রিকেটার হিসেবে কত ভালো ছিলেন ফিলিপ হিউজ? সেটা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু তাঁকে যারা চেনেন, যারা তাঁর সতীর্থ কিংবা প্রতিপক্ষ হিসেবে খেলেছেন, সবাই একটা ব্যাপারে একমত-ক্রিকেট খেলাটার মধ্যেই হিউজের প্রাণ লুকিয়ে ছিল। আর কিনা সেই ক্রিকেটেরই এক চোরাগলিতে শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনটা বিসর্জন দিলেন হিউজ! ক্রিকেটকে তিনি কতটা ভালোবাসতেন সেটা বোঝাতে গিয়ে প্রয়াত ক্রিকেট লেখক পিটার রোবাক একবার লিখেছিলেন-
"ও কখনোই হতাশ হয়ে পড়ে না। জাতীয় দলে জায়গা পেল কি পেল না, নির্বাচকেরা তাকে কেন ডাকছেন না, এসব নিয়ে সে দুশ্চিন্তায় থাকে না। এই ছেলেটাকে দেখে মনে হয় শুধু ব্যাটিং করে যাওয়াতেই যেন তাঁর সব আনন্দ। এটাকে সে শ্বাস নেওয়ার মতো স্বাভাবিক ব্যাপার বানিয়ে ফেলেছে।"
দুটো দিন আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছেন হিউজ। বাইরে লক্ষ ক্রিকেটপ্রেমী পঁচিশ বছরের এই ছেলেটার জন্যে যার যার ধর্মমতে প্রার্থনা করেছে, একটা সুসংবাদ শোনার আশায় তীর্থের কাকের মতো আশায় ছিলেন সবাই। মাইকেল ক্লার্ক সস্ত্রীক টানা দুটো দিন হাসপাতালেই কাটিয়েছেন, হিউজের পরিবারের পাশে। ছিলেন ফিলিপের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডেভিড ওয়ার্নার। মিশেল স্টার্ক, ব্র্যাড হাডিনরাও এই ক'দিনের জন্যে সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালকেই ঘরবাড়ী বানিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্ত নিয়তির লিখন বদলায়নি, জ্ঞান ফিরে আসেনি ফিলিপ হিউজের। লাল বলের ছোবলে পাওয়া আঘাতেই বরণ করে নিয়েছেন যন্ত্রণাহীন মৃত্যুকে। জাতীয় দলে সবার ছোট, সবার আদরের ছেলেটাই হারিয়ে গেছে সবার আগে! ঠিক যেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'ছিন্নমুকুল' কবিতার মতো- সব-চেয়ে যে শেষে এসেছিলো, সে গিয়েছে সবার আগে সরে!
তেষট্টি আর চৌষট্টি সংখ্যাদুটো হয়তো কখনোই ভুলবেন না মাইকেল ক্লার্করা। চৌষট্টি নম্বর জার্সি পরেই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ওয়ানডেতে মাঠে নামতেন হিউজ, আর সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ঢলে পড়ে যাওয়ার আগে তাঁর রান ছিলো অপরাজিত তেষট্টি। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৪০৮ তম টেস্ট ক্রিকেটার ছিলেন হিউজ, তাই ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরীর পর মাঠের একপাশে ৪০৮ লেখা জায়গাটায় গিয়ে চুমু খান ডেভিড ওয়ার্নার, অশ্রুসিক্ত হয় আমাদের চোখ। ক্লার্ক ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে অনুরোধ করেন ৬৪ নাম্বার জার্সিটা তুলে রাখার, হিউজকে নিয়ে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া নিয়ম ভেঙ্গে দল ঘোষণা করতে চায় ষোলজনের, অদৃশ্য হয়েও দলের পাশে থাকেন ফিলিপ হিউজ।
হিউজের মৃত্যুর পর প্রথম আলোতে পবিত্র কুণ্ডু'র লেখা লাইনগুলো এখনও আমার মুখস্ত- "ফিল হিউজ রিটায়ার্ড হার্ট ৬৩- এই লাইনটা লেখা থেকে যাবে পরিত্যাক্ত একটা ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচের স্কোরকার্ডে..."
জাতীয় দলের জার্সি গায়ে আর কখনও দেখা যাবে না তাঁকে, ছোট্ট শরীরে দুর্দান্ত সাহস জড়ো করে বাঘা বাঘা বোলারদের বলগুলোকে সীমানাছাড়া করবেন না আর কোনদিন, সেঞ্চুরী করে ব্যাটে চুমু খাবেন না। ড্রেসিং রুম জমিয়ে রাখতে জুড়ি ছিলো না যাঁর, সেই মানুষটা আর ফিরবেন না অস্ট্রেলিয়ার সাজঘরে। ক্রিকেট থাকবে তার বাহারী সৌন্দর্য্যের মনোমুগ্ধকর ভান্ডার নিয়ে, হয়তো পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত, শুধু ফিলিপ হিউজ আর কোনদিন ব্যাট হাতে মাঠে নামবেন না, দুর্দান্ত কাভার ড্রাইভে বোলারকে সীমানাছাড়া করবেন না। ছয় বছর হয়ে গেলো, ক্রিকেট হিউজকে হারিয়েছে। যে ক্রিকেটটাকে তিনি সবচাইতে বেশী ভালোবেসেছিলেন, ক্রিকেটে বসতি গড়েছিলেন।
ভালো থাকুন ফিলিপ হিউজ, ওপারে অনেক অনেক ভালো থাকুন, ক্রিকেটে মিশে থাকুন।