হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা - নিছকই গল্প নয়, বাস্তবের এক ট্র্যাজেডি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
গল্পটাকে রুপকথার গল্প মনে হলেও আসলে তা নয়! বাস্তবেই জার্মানিতে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা থেকেই উৎপত্তি ঘটে এই গল্পটির। কী সেই ঘটনা?
আমরা সবাই ছোটবেলায় হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা গল্পটি পড়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এই গল্পটি বেশ চমৎকার লেগেছে। কত শত গল্পই তো পড়েছি, কিন্তু খুব কম গল্পই মাথায় থেকে যায়। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা এমনই এক গল্প। যে গল্প বাঁশিওয়ালা তার প্রাপ্য না পেয়ে বাঁশির মোহনীয় সুরে হ্যামেলিনের শিশুদের মাতোয়ারা করে ফেলে। শিশুরা মোহগ্রস্ততায় তার পিছু নেয়। তারপর আর ফিরে আসে না কেউ।
গল্পটাকে রুপকথার গল্প মনে হলেও আসলে তা নয়! বাস্তবেই জার্মানিতে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা থেকেই উৎপত্তি ঘটে এই গল্পটির। কী সেই ঘটনা?
সময়টা ১২৮৪ সাল। জার্মানির লোয়ার সাক্সনি প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আঁকাবাঁকা ওয়েজার নদীর তীরে অবস্থিত শহরটির নামই হ্যামেলিন। এই শহরে তখন ভয়াবহ ইঁদুরের প্রকোপ দেখা দিলো। এখানে সেখানে যত্রতত্র ইঁদুর পাওয়া যাচ্ছে। ঘরে, বাইরে, স্কুলে, অফিসে কোথাও রেহাই নেই, সর্বত্র ইঁদুরের যন্ত্রণা। এমন সময়ে শহরে রঙ চংয়ে পোষাক পড়া এক বাঁশিওয়ালার আগমণ ঘটল, যে দাবি করল- সে চাইলে সব ইঁদুর দূর করে দিতে পারে।
বস্তুত এটা অবিশ্বাস্যও নয়। কারণ, হায়ার ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ দিয়ে ইঁদুরকে প্রভাবিত করার ব্যাপারটা বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত। যাহোক, সেই বাঁশিওয়ালার সাথে হ্যামেলিনের মেয়রের চুক্তি হলো। ইঁদুরকে শহর ছাড়া করতে পারলে তার জন্য পুরষ্কার আছে। অর্থমূল্য ঘোষণা দিলেন। সেই বাঁশিওয়ালা সত্যি সত্যিই বাঁশির জাদুময় সুর দিয়ে শহরের সব ইঁদুরকে ওয়েজার নদীতে নিয়ে ফেলল। যখন সে ফিরে আসলো, তখন মেয়র সাহেবের মতিভ্রম হলো। মেয়র প্রতিশ্রুত অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। সেই বাঁশিওয়ালা তাতে ক্ষীপ্ত হয় এবং চলে যায়।
তারপর, ২৬ জুন ১২৮৪ সালের দিন বাঁশিওয়ালা প্রতিশোধ নেয়। কীভাবে?
সেদিন শহরে সেন্ট জন-পল দিবস পালিত হচ্ছিল। সবাই ছিল চার্চে। সেদিন আবার আসলো শহরে সেই বাঁশিওয়ালা। সেদিন আবার সে তার বাঁশিতে সুর তোলে। অভাবনীয় এক ঘটনা ঘটে তখন। শহরের সব শিশু এই সুরে আত্মহারা হয়ে যায়। সেদিন ১৩০ জন শিশু হ্যামেলিনের সেই বাঁশিওয়ালার পিছু নেয়। এবং অতঃপর সম্মোহিত শিশুর দলকে বাঁশিওয়ালা একটি পর্বতের ওপারে গুহায় নিয়ে যায়। আর দেখা যায়নি এই শিশুদের। শিশুদের আশ্চর্য এই উধাও হয়ে যাওয়াতে শহরবাসী হতবাক৷ আজও এই ঘটনা তারা মনে রেখেছে।
হ্যামেলিন মানেই যেন ফিরে আসে সেই শিশুদের ঘটনা। কিন্তু বাঁশিওয়ালার এই ঘটনা জানাজানি হয় কীভাবে?
সেদিন নাকি তিনজন শিশু বেঁচে গিয়েছিল। একজন চোখে দেখে না। তাই সে সুর শুনলেও বুঝেনি কোথায় যেতে হবে। আরেকজনকে কানে শুনে না বলে বেঁচে যায়। আর শেষের জন যে পোষাক আনতে বাসায় ফিরে পরে গিয়ে দেখে সবাই এরই মধ্যে চলে গেছে। মোটামুটি এমনই একটি ঘটনা এবং তারপরই এই ঘটনার উপর ভিত্তি করেই গল্পের মিথটি প্রায় রুপকথায় রুপ নেয়।
হ্যামেলিনে একটি জাদুঘর রয়েছে। ওই জাদুঘরে সঞ্চিত অনেক বইয়ের মধ্যে পঞ্চদশ শতাব্দীতে লেখা কয়েকটি বইয়ে পাওয়া যায় এই রহস্যময় কাহিনী। সেখানে পাওয়া যায় এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। ফ্রাউ ভন লিউড নামের এক ১৩ বছরের বালিকার ১২৯৪ সালের রেকর্ডে লিপিবদ্ধ আছে যে সুদর্শন এ লোকটির বয়স ছিল আনুমানিক ৩০। তার বাঁশিটি ছিল রুপোর তৈরি।
এই ঘটনার পর শহরের চার্চে স্টেইনড গ্লাস লাগানো হয়, যেখানে শিশুদের এই মর্মান্তিক নিখোঁজ হবার ঘটনা ছিল। শিশুদের হারিয়ে যাওয়াকে স্মরণ করতেই গ্লাসে ইতিহাস লিখে রাখা হয়েছিল। যদিও জানালাটা ধ্বংস হয়ে যায় ১৬৬০ সালে। পরে ইতিহাসবিদ হ্যান্স ডবারটিন ঐতিহাসিক লেখা থেকে আবার জানালাটি পুনঃনির্মাণ করেন।
হ্যামেলিনের সরকারি দস্তাবেজে যখন থেকে ঐতিহাসিক রেকর্ড রাখা শুরু হয় তখন এন্ট্রি শুরুই হয় এই ঘটনার রেকর্ড দিয়ে। ১৩৮৪ সালের রেকর্ডে বলা হয়, 'একশ বছর হতে চললো, আমরা আমাদের শিশুদের হারিয়েছি..'। অনেকেই ভাবে এটি নিছকই গল্প বোধহয়। এটি নিয়ে এত লেখা, গবেষণা, গ্রন্থ বের হয়েছে যে, মানুষ এখনো বিভ্রান্ত হয়ে যায় মাঝে মধ্যে, আসলেই কি ঘটেছিল এমন কিছু! তবে, জার্মানির যে রাস্তা থেকে শিশুরা উধাও হয়ে গেছে সেখানে এখনও বাদ্য-বাজনা নিষিদ্ধ, আজকে প্রায় ৮০০ বছর ধরে চলছে এই নিষেধাজ্ঞা। 'বুঙ্গে লোজেন স্ট্রিট'কে বলা হয় নো ড্রাম স্ট্রিট। এখানে কোনো প্রকার গান, বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিষিদ্ধ। কারণ, শব্দের সম্মোহনেই তো শহর হারিয়েছিল ১৩০ জন শিশু!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন