পুলিশ সদস্য শফিকুল ইসলামের এমন উদ্যোগ, ভাবনা, সৃজনশীলতার গল্প অন্য দেশ হলে হৈ চৈ পড়ে যেত। আমাদের দেশে কজন জানেন, এমন একটি বাড়ির কথা?

মানুষটা কাজ করে ট্রাফিক পুলিশ বিভাগে। নাম শফিকুল ইসলাম। তিনি কতটা সৃজনশীল মননের অধিকারী, তার পরিচয় পেতে আপনাকে যেতে হবে কুমিল্লায়। কুমিল্লার হোমনা পৌরসভায় যদি আপনি যান, আচানক হয়ে যাবেন পুলিশ সদস্যের এই বাড়িটি দেখে। মনে মনে হয়ত ভাববেন, মানুষের ক্রিয়েটিভি কত সুন্দর উপায়ে ব্যবহার হতে পারে!

আজকের পৃথিবী নানা কারণে বিপদের মুখে। যে প্রকৃতির মাঝে আমাদের বসবাস, সেই প্রকৃতি ধ্বংস করা আমাদের বিলাস। বিলাসী জীবন আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে প্রকৃতি থেকে। আমরা ভোগবাদী হয়ে গেছি, প্রকৃতি প্রেম আমাদের ভেতর থেকে আসে কদাচিৎ। প্রকৃতির মাঝে গেলে আমরা মুগ্ধ হই ঠিকই, কিন্তু ভাবি না প্রকৃতির সংরক্ষণে আমরা কী দায়িত্ব পালন করতে পারি।

প্লাস্টিকের দূষণ আজকের পৃথিবীতে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, বিরুপ প্রভাব ফেলছে পরিবেশে, সেই প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের জমাট বাড়ছে পৃথিবীতে। এরকম এক পৃথিবীতে পরিত্যক্ত পণ্য নিয়ে অনেকেই রিসাইক্লিংয়ের কাজ করেন। বিভিন্নভাবে পরিত্যক্ত জিনিসগুলো নতুন করে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলেন।

কুমিল্লার শফিকুল ইসলাম যা করলেন তা আরো অভিনব। তিনি নিজের বসতবাড়ি গড়তে ব্যবহার করলেন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক। হোমনার ৯ নাম্বার ওয়ার্ডের লটিয়া নামক এলাকায় আপনি যদি যান, হয়ত চোখে পড়বে আপনারই মতো কৌতুহলী আরো কিছু মানুষ। যারা ট্রাফিক পুলিশের সদস্য শফিকুল ইসলামের বাড়িটি দেখতে এসেছেন। রাস্তার পাশেই রং বেরংয়ের প্লাস্টিক দিয়ে গড়া পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট বাড়িটি।

প্রায় এক লক্ষ প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে গড়া হচ্ছে এ বাড়ি

লোকে অবাক হয়, যেতে যেতে পথে থমকে দাঁড়ায়, বিস্ময়ে হতভম্ব হয়। কেউ কেউ বাড়িটি ছুঁয়ে দেখে। লোকের মনে কৌতুহল জমাট বাঁধে, ভাবে কী করে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে এতো দৃঢ় মজবুত বাড়ি বানানো সম্ভব! যদিও বাড়িটির এখনো পূর্ণাঙ্গ নির্মাণকাজ শেষ হয়নি, তবুও বাড়িটির দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন এখনই দৃশ্যমান এবং তা লোককেও আকর্ষিত করছে বেশ।

শফিকুল ইসলাম এই প্লাস্টিকের বাড়ি নির্মাণের অনুপ্রেরণা পান ২০১১ সালে। সে বছর পত্রিকায় তিনি একটি প্রতিবেদন পড়েন, জানতে পারেন জাপানে প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে এক তিন তলা বাড়ির কথা। তখন থেকেই তিনি আগ্রহী হন। ইউটিউবে ঘাটাঘাটি করতে থাকেন, প্লাস্টিক সম্পর্কে জানতে শুরু করেন।

পরে নিজেই ভাবেন, তিনি গড়বেন এমন একটি বাড়ি, যে বাড়িটি গড়তে ব্যবহার হবে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক। যেই ভাবা, সেই কাজ। শুরু করলেন বাড়ির নির্মাণ। এখন পর্যন্ত ৮০ হাজার পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করেছেন শফিকুল ইসলাম এই বাড়ি গড়তে, মজুদ আছে আরো ২০ হাজার প্লাস্টিক।

এই প্লাস্টিক তিনি সংগ্রহ করতেন কুমিল্লার বিভিন্ন ভাঙ্গারি দোকান থেকে। তারপর বোতলগুলোর ভেতর বালি দিয়ে ভর্তি করেন। বালি ভর্তি এসব বোতল দিয়ে মাটির নীচ থেকে আড়াইফুটের বেশি ভিত তৈরি করেন। তারপর এর ওপর দেয়ালে গাঁথুনি দিয়েছেন তিনি।

সবচেয়ে ইন্টেরেস্টিং হলো, ৮০ হাজার প্লাস্টিক দিয়ে গড়া বাড়িটি এমনভাবে তৈরি করা যে ভূমিকম্পেও তেমন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। প্লাস্টিকভর্তি বালু থাকায় অগ্নিকান্ড ঘটলেও আগুন ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই। বোতলে বালি থাকায় গরমের সময় ঘরের ভেতরের পরিবেশ ঠান্ডা আর শীতের সময় উষ্ণ থাকবে বলেও উল্লেখ করেন শফিকুল। এছাড়া আরেকটি সুবিধা হলো, এই প্লাস্টিক বাড়ি সাধারণ বাড়ির চেয়ে ৩০ শতাংশ কম খরচেই গড়া সম্ভব!

একটা মানুষের এমন উদ্যোগ, ভাবনা, সৃজনশীলতার গল্প অন্য দেশ হলে হৈ চৈ পড়ে যেত। আমাদের দেশে ক'জন জানেন, এমন একটি বাড়ির কথা?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা