মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শরীয়ত বয়াতির সন্তানেরা হয়তো আপনার নাতি-নাতনির বয়সী। কোন দোষ না করেও তাদের প্রতিহিংসার শিকার হতে হচ্ছে। তাদের জন্যে খাবার রান্না করে পাঠাতে হবে না, শুধু কি পরিবারটার পাশে একটু দাঁড়াবেন? তাদের খোঁজ নেবেন একবার?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বাসায় নিজের হাতে রান্না করে খাবার আর মিষ্টি পাঠিয়েছেন। সাকিবের স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশির গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। তখন শিশিরের পছন্দের খাবারের নাম জেনে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ক্রিকেটারদের তিনি নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন, মাঝেমধ্যেও গণভবনে তাদের ডাক পড়ে। সাকিবের স্ত্রীও সেই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হননি, পরদিন সকালে লোক মারফত তিনি শিশিরের পছন্দের খাবারগুলো বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। এমন ভালোবাসা দেখে আপ্লুত হয়েছেন সাকিব এবং শিশির, ফেসবুকে তারা খাবারের ছবি দিয়ে পুরো ঘটনা জানিয়েছেন।

কেউ কেউ এর মধ্যে সমালোচনায় মেতে উঠেছেন। পুরো বিষয়টাকে অন্যদিকে ঘোরানোর একটা চেষ্টা করছে অনেকে। তারা হয়তো জানেন না যে, শেখ হাসিনা এমনিতেই অতিথি আপ্যায়ন খুব পছন্দ করেন। নিজের হাতে রান্না করে অন্যকে খাওয়ানোটা তার শখ। সাকিবকে তিনি নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসে তার স্ত্রীর জন্যে রান্না করে পাঠিয়েছেন। এতে প্রশ্ন তোলার মতো কোন জায়গা আমি অন্তিত দেখতে পেলাম না।

তবে খবরটা দেখার পরে আমার মনে পড়লো শরীয়ত বয়াতি নামের একজন মানুষের কথা। এদেশের নাগরিক হিসেবে তিনিও প্রধানমন্ত্রীর সন্তানের মতোই, অথচ সেই লোকটা জেলে পচে মরছে, তার বাড়িতে রান্না হচ্ছে না, তার সন্তানেরা স্কুলে যেতে পারছে না, জীবনের নিরাপত্তা তাদের তাড়া করে ফিরছে সারাক্ষণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কি কষ্ট করে একটু খোঁজ নেবেন, শরীয়ত বয়াতির বাড়িতে আজ কিছু রান্না হয়েছে কিনা?

শরীয়ত বয়াতি পেশায় একজন বাউল, গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে ধামরাইয়ে এক পালাগানের আসরে তিনি বলেছিলেন- “গান-বাজনা হারাম, এটা কোরানের কোথাও বলা হয় নাই। কেউ যদি হারাম প্রমাণ দিতে পারে তবে তাকে আমি ৫০ লাখ টাকা দিব এবং সারাজীবনের জন্য কবিগান ছেড়ে দেব।”

তার সেই বক্তব্য ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে, কিছু লোকজন তাকে মুশরিক, কাফের ঘোষণা করে ছড়িয়ে দিয়েছে ভিডিওটা। তাকে গ্রেফতারের দাবীতে মানববন্ধন আর সমাবেশও হয়েছে! নুন আনতে পান্তা ফুরানো একজন বাউল শিল্পী হঠাৎই চায়ের দোকানের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে গেলেন, পরিণত হলেন 'তৌহিদি জনতার চোখে সবচেয়ে বড় খলনায়কে! অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশও তার নামে মামলা নিয়েছে, তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। 

সাকিব আল হাসান ইন্সটাগ্রামে আপলোড দিয়েছেন এই ছবি

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে শরীয়ত বয়াতী গ্রেফতার হয়েছেন, ধর্মান্ধদের কাছে মাথা নত করেছে রাষ্ট্র। আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন, পুলিশের হেফাজতে আছেন শরীয়ত বয়াতি, সেখানে তাকে কুপিয়ে মারা হবে না, এই নিশ্চয়তাটুকু অন্তত আছে। কিন্ত তার পরিবার তো পুলিশি প্রহরায় নেই, তাদের দিন কাটছে তাই আতঙ্কে। ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজদের ক্রমাগত হুমকিতে ঘরের ভেতরেই বন্দী জীবন কাটাচ্ছে শরীয়ত বয়াতির পরিবার, জীবনের অনিশ্চয়তা প্রতি মূহুর্তে ঘিরে ধরছে তাদের সবাইকে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে শরীয়ত বয়াতির সন্তানদের। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার বাবার হাত ধরে এই দেশটা স্বাধীন হয়েছিল, তিনি একটা ধর্মনিরপেক্ষ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। সেই বাংলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে একজন বাউল জেলে গেলেন, তাকে রিমান্ডে নেয়া হলো, আমরা আশা করেছিলাম ঘটনাটা আপনার চোখে পড়বে, আপনি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। কিন্ত আপনি একদম উল্টোপথে হাঁটলেন, আপনার কথা শুনে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী হয়তো খুশি হবে, বগল বাজাবে। কিন্ত তাদের খুশি করাটা বঙ্গবন্ধুর কন্যার মিশন হবে কেন- এই প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই।

অনেকগুলো প্রশ্নেরই তো উত্তর খুঁজে পাই না। যে হেফাজত আপনার সরকারের পতনের জন্যে শাপলা চত্বরে এসে হাজির হয়েছিল ২০১৩ সালে, এখন আপনি তাদের সমাবেশে হাজির হয়ে তাদের কাছ থেকেই ‘কওমি জননী’ খেতাব নেন। পত্রিকায় হেফাজতকে রেলের জমি বরাদ্দ দেয়ার খবর পড়ি আমরা। আওয়ামী লীগের অনেকে এগুলোকে জাস্টিফাই করেন, শেখ হাসিনা সবাইকে সাইজ করে ফেলেছেন, এই ভেবে। অথচ হেফাজতের মঞ্চে আপনি গিয়েছেন, এই নৈতিক পরাজয়টুকু তাদের চোখে পড়ে না! আপনি নিজেকে একবার প্রশ্ন করুন, বঙ্গবন্ধু কী কখনও এভাবে হেফাজতের মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াতেন? জবাবটা পেয়ে যাবেন আশা করি।

শরীয়ত বয়াতি

বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর সাম্প্রদায়িকতা- এই দুটো বিপরীতধর্মী শব্দ ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে অন্তত 'গান বাজনা হালাল' বলার অপরাধে একজন বয়াতিকে জেলে যেতে হতো না, রিমান্ডে নেয়া হতো না তাকে, তার সন্তানেরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে ঘরে বসে আতঙ্কের প্রহর কাটাতো না। অথচ এখন আওয়ামী লীগই জামায়াত-হেফাজতের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে, আওয়ামী লীগের মূলমন্ত্র বিলীন হয়ে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে। আপনার সরকারের আমলে ব্লগার খুন হলেন একের পর এক, সেই হামলায় জড়িতদের ধরে শাস্তির ব্যবস্থা না করে আপনারা উল্টো সেই হেফাজতের সুরেই সুর মিলিয়েছিলেন। ধর্মান্ধরা কখনও আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি, তাদের মন যুগিয়ে চলার ব্যর্থ চেষ্টাটা কেন করছেন তাহলে?

তারপরেও মেনে নিলাম, শরীয়ত বয়াতি বিশাল বড় অপরাধ করেছেন, সেই অপরাধের কোন ক্ষমা নেই। তাকে ফাঁসি দেয়া হবে, সেটাও মেনে নিলাম। শরীয়ত বয়াতি খারাপ লোক, খুব খারাপ, কিন্ত তার সন্তানদের কী দোষ? তার পরিবারের অপরাধটা কী? তাদের জীবনকে কেন জাহান্নাম বানিয়ে ফেলা হচ্ছে? শরীয়ত বয়াতিকে জেলের ভাত খাইয়ে কি ধর্মান্ধদের আক্রোশ মেটেনি। তার পরিবারকে কেন অব্যহতভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে? তারা তো গান বাজনা হালাল না হারাম সেই বিষয়ে টু শব্দটাও উচ্চারণ করেনি!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শরীয়ত বয়াতির সন্তানেরা হয়তো আপনার নাতি-নাতনির বয়সী। কোন দোষ না করেও তাদের প্রতিহিংসার শিকার হতে হচ্ছে। আপনার সরকার সারাদেশের সব স্কুলে নতুন বই পাঠিয়েছে, বাচ্চাগুলো সেই বই আনতেও যেতে পারেনি। তাদের একঘরে করে রাখায় বাজার-সদাই বন্ধ, একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে পুরো পরিবারের। তাদের জন্যে খাবার রান্না করে পাঠাতে হবে না, শুধু কি পরিবারটার পাশে একটু দাঁড়াবেন? তাদের খোঁজ নেবেন একবার?

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা