ডাক্তাররা লড়ছেন প্রাণপনে, সেবা দিচ্ছেন, নিজেরা আক্রান্ত হচ্ছেন, লকডাউন নিশ্চিত করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ, মারা যাচ্ছে তারা। আর আমরা লকডাউনটাকে একটা কৌতুক বানিয়ে বাড়ির পথ ধরছি, শপিং করছি, জিলাপি কিনতে ভীড় জমাচ্ছি!

ডেইলিস্টারে কয়েকদিন আগে একটা ছবি দেখেছিলাম, রাস্তার পাশে ফুটপাথে মাথা নিচু করে বসে আছেন এক পুলিশ সদস্য, শরীরজুড়ে ক্লান্তি ভর করেছে, চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে এখনই বুঝি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন! প্রেসক্লাব এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন সেই পুলিশ সদস্যটি, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করার জন্যে পুলিশের পোষাকের ওপরে ভারী পিপিই চাপিয়েছেন, সেটা পরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে টানা সাত-আট ঘন্টা ডিউটি দিয়েছেন, একটু মুক্ত বাতাসের জন্য হাঁসফাস করেছে শরীর, কিন্ত সেটার যোগান পাননি।

সারা দেশের অজস্র পুলিশ সদস্যের অবস্থা এমনই। সাধারণ ছুটির নামে যে অঘোষিত লকডাউন চলছে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় থাকছেন তারা। মুখে মাস্ক, শরীরে পিপিই জড়িয়ে মানুষকে ঘরে রাখার চেষ্টা করছেন তারা, আর অন্যান্য অপরাধ দমন তো আছেই। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে পুলিশের পরিশ্রম এবং দায়িত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এপর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন অন্তত আটজন। তবুও সুস্থ হওয়া পুলিশ সদস্যরা আবার কাজে ফিরতে চাইছেন, মানুষের সেবা করতে চাইছেন! 

এবার স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা বলা যাক। করোনার জন্য স্পেশালিস্ট যে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে, সেখানকার ডাক্তার-নার্সরা দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না। অবিরত সেবা দিয়ে চলেছেন, রোগীর দেখভাল করছেন, তাদেরও গায়ের ওপর পিপিই'র ভারী আস্তরন, মুখে মাস্ক, পুরো শরীর নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। তবুও ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না তারা, এপর্যন্ত সাড়ে সাতশোর বেশি ডাক্তার এবং নার্স সংক্রমিত হয়েছেন করোনাভাইরাসে, মারা গেছেন তিন জন। 

উত্তরায় গাড়ির সারি, আজকের ছবি

আর যারা এখনও সুস্থ আছেন, তারা পরিবার থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন। বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তান সবাইকে ফেলে পড়ে আছেন হাসপাতালে, বা অন্য কোথাও। যারা বাসা থেকে যাওয়া-আসা করছেন, তারাও নিজেদের আলাদা করে রেখেছেন, সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করতে পারছেন না, স্বামী-স্ত্রীকে একটাবার জড়িয়ে ধরতে পারছেন না। এই যে আত্মত্যাগ, এসবের প্রতিদানে তারা পাচ্ছেন বাসা ছেড়ে দেয়ার হুমকি, প্রতিবেশীদের বাজে ব্যবহার। 

আর এসবের বিনিময়ে জনগন, মানে আমরা কি করছি? লকডাউনটাকে জ্বলজ্যান্ত কৌতুকে পরিণত করেছি। নিয়মিত ভীড় জমাচ্ছি হাট-বাজারে, দরকার না থাকলেও। ঈদের শপিং করতে মার্কেটে যাচ্ছি, করোনা ঠেকানোর চেয়ে লিপস্টিক আই শ্যাডো কিংবা পাঞ্জাবী কেনাটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে! গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের কয়েকদফা ঢাকা-বাড়ি-ঢাকা করালেন, তাতে করোনা ছড়ালো। এখন ঈদ এসেছে, আমরা নিজেরাই পা বাড়াচ্ছি বাড়ির দিকে, করোনা থাকুক আর যাই থাকুক, মরলে মরব, তাও ঈদ তো গ্রামের বাড়িতে গিয়ে করতেই হবে! 

ঘরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, বোঝানো হয়েছে, সতর্ক করা হয়েছে, জরিমানা হয়েছে- আমরা কথা শুনিনি, লকডাউন মানিনি, সামান্য জিলাপি কেনার জন্যেও লম্বা লাইন ধরেছি! এখন দল বেঁধে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ, বাড়িতে ঈদ করার জন্য! ফেরিঘাটে উপচে পড়া ভীড়, ঢাকা থেকে বের হবার রাস্তাগুলোতে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। স্বপ্নের বদলে সঙ্গে করে যে করোনাভাইরাস বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি আমরা, সেটা কেউ বুঝতে পারছে না, পারলেও পাত্তা দিচ্ছে না। আমরা কবে কোন জিনিসটাকে পাত্তা দিয়েছি? 

ফেরীতে ঘরমুখো মানুষের ভীড়

'ঘুষখোর' পুলিশ মরছে আমাদের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে, 'কসাই' ডাক্তার প্রাণ হারাচ্ছে আমাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে, আর আমরা প্রত্যেকে আকাশ থেকে নেমে আসা ফেরেশতা, আমরা বাড়ি যাচ্ছি, আমাদের কোন দোষ নেই! আমাদের কাছে এই বিপদের মধ্যেও আত্মীয়ের বাড়িতে দুটো কাঁঠাল নিয়ে বেড়াতে যাওয়াটা দরকারী কাজ, নতুন জামা সেলাইয়ের জন্যে দর্জির দোকানে লাইন দেয়াটা অবশ্য কর্তব্য, ছয় মাসের শিশু কিংবা কবুতরের খাঁচা মাথায় নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে ভীড়ের মধ্যে ফেরী পার হয়ে বাড়ি যাওয়াটা ফরজ! এরপরেও আমরা নির্লজ্জের মতো অন্য পেশাজীবীদের সমালোচনা করি, অন্য দেশের মানুষের নিন্দা করি! 

লকডাউন নামের এই তামাশাটা জারী রাখার কোন দরকার আর দেখি না। যেটা লোকে মানছে না, মানবে না, সেটা পালনের নামে পুলিশ আর ডাক্তারদের ঝুঁকিতে ফেলে লাভ কি? ঢাকার রাস্তায় গাড়ির ভীড় দেখেছেন? একটা গণপরিবহন নেই, শুধু ব্যক্তিগত গাড়িতেই রাস্তায় জ্যাম লেগে গেছে! এই মানুষগুলো করোনাকে পরোয়া করে না, না করুক, মরুক সবাই। এদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে, এদের চিকিৎসা দেয়ার জন্যে দয়া করে পুলিশ আর ডাক্তারদের আটকে রাখবেন না। এরা নিরাপত্তা পাওয়া, সেবা পাওয়া ডিজার্ভ করে না। পুলিশ আর ডাক্তারদের ছুটি দিয়ে দিন, যে দেশের মানুষ এমন ইতর, বদমাশ আর আইন অমান্যকারী হয়, সেদেশে পুলিশেরও দরকার নেই, ডাক্তারেরও প্রয়োজন নেই। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা