নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্প মিথ্যা অভিযোগ করছেন- একারনে তার বক্তব্যের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে আমেরিকার কয়েকটা টিভি চ্যানেল। ভাবুন তো, আমাদের দেশের মন্ত্রী-এমপিরা যখন ঢাকাকে লন্ডন-প্যারিস বানিয়ে ফেলেন, তখন আমাদের কোন চ্যানেল কি এই দুঃসাহস দেখাতে পারবে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, অনেকেই তাকে তুলনা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার সঙ্গে। চার বছরের শাসনামলে যথেষ্ট বিনোদন উপহার দিয়েছেন ব্যবসায়ী থেকে আচমকা রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া ট্রাম্প, তবে যেরকম আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, তার শাসনামলে যুদ্ধ-বিগ্রহ বেড়ে যাবে, পাগলাটে এই লোকটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবেন- সেরকম কিছু হয়নি। বিদায়বেলাতেও তার পাগলামির রোগ যায়নি, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের শেষ ধাপে এসে পরাজয়ের দ্বারপ্রানে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাম্প এখনও বিনোদন দিয়ে চলেছেন বিশ্ববাসীকে। কখনও নিজেকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করছেন, খানিক বাদেই আবার নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলছেন, কখনও ভোট চুরির অভিযোগ আনছেন, হোয়াইট হাউজে শোকসভার আয়োজন করছেন, আবার নিজের দলের সিনেটরদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়ছেন- সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি একটা অবস্থা! 

পাঁচটা রাজ্যের ফল ঘোষণা এখনও বাকি। এর মধ্যে দুটোতে এগিয়ে আছেন ডেমোক্র‍্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তার ইলেক্টোরাল ভোট ২৬৪টি  ট্রাম্পের ২১৪টি। আর মাত্র ৬টি ভোট পেলেই ২৭০- এর ম্যাজিক্যাল ফিগার ছুঁয়ে হোয়াইট হাউজের চাবি পেয়ে যাবেন বাইডেন। ট্রাম্প এখনও জয় থেকে অনেকটাই দূরে। ক্ষমতায় যে পালাবদল আসছে, সেটা বুঝে গেছে আমেরিকার মানুষও। আর তাই ট্রাম্পের এই প্রলাপে খুব একটা কান দিচ্ছে না তারা। খোদ রিপাবলিকান নেতাদের সমর্থনও পাচ্ছেন না ট্রাম্প। হোয়াইট হাউজ কিংবা প্রেসিডেন্ট প্যালেসের বাইরে- সর্বত্রই এখন ট্রাম্প একা। 

ট্রাম্পের সঙ্গে গত চার বছরে সংবাদমাধ্যমের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। পূর্ববর্তী যে কোন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের মধ্যে মিডিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কই সবচেয়ে তিক্ত ছিল। এর একটা বড় কারন হচ্ছে, ট্রাম্প কখনও 'পলিটিক্যাল এটিকেট' মেনে কথা বলতেন না, মনে যা আসতো ফটাফট বলে ফেলতেন, এখনও বলেন। কূটিনৈতিক শিষ্টাচারের ধার ধরে ট্রাম্পকে কখনোই কেউ কথা বলতে শোনেনি। আর আমেরিকায় যেহেতু মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে পুরোপুরি, সেখানে সাংবাদিকেরাও জ্বী হুজুরি না করে প্রেসিডেন্টের মুখের ওপর জবাব দেয়ার সাহস রাখেন। সেকারনে দুই পক্ষের টক্করটা গত চার বছর ধরেই জমেছে বারবার, ট্রাম্প যেমন মিডিয়াকে পাত্তা না দেয়ার ভান করেছেন, মিডিয়াও তেমনই ইচ্ছেমতো তাকে তুলোধোনা করেছে।

ট্রাম্পের দাবী, নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে

তবে এখন যেহেতু ট্রাম্প বেকায়দায়, মিডিয়া সেই সুযোগটা নেবে না কেন? সিএনএন সহ ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে খ্যাত যেসব মিডিয়া আছে, তারা ক্রমাগতই নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্পের এসব অভিযোগকে মক করছে। আমেরিকার মতো জায়গায় ভোট জালিয়াতি বা ভোট চুরির অভিযোগটা শুধু খেলোই নয়, অবান্তরও। গত দুইদিন ধরে ট্রাম্প একনাগাড়ে এই অভিযোগ তুলছেন। সুপ্রীম কোর্টে যাবেন বলেও হুমকি দিচ্ছেন বারবার। অথচ তার হাতে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। মিডিয়া তাই মোটামুটি সার্ফ এক্সেল দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিয়েছে ট্রাম্পকে। 

নির্বাচনের পর আজই প্রথম মিডিয়ার মুখোমুখি হয়েছিলেন ট্রাম্প। যেই না নির্বাচনে জালিয়াতি আর ভোট চুরি নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন, আমেরিকান টেলিভিশন চ্যানেল এমএসএনবিসি, যারা হোয়াইট হাউস থেকে সরাসরি অনুষ্ঠান প্রচার করে তারা ট্রাম্পের ভাষণ সম্প্রচার করা বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে- আমরা একটি ব্যতিক্রমী অবস্থান নিচ্ছি। আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তৃতা সম্প্রচারই শুধু বন্ধ করছি না, আমরা তার ভুলগুলোকেও সংশোধন করে দিচ্ছি। শুধু এমএসএনবিসিই নয়, সিএনবিসি চ্যানেলও একই কাজ করেছে, সম্প্রচার বন্ধের সময় তাদের উপস্থাপক জানিয়েছেন- 'যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যা বলছেন তা সর্বান্তকরণে অসত্য।'

সিএনএনের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈরীতার ইতিহাস তো অনেক পুরনো। ব্যক্তি আক্রমণের অভিযোগ তুলে ট্রাম্প তার সংবাদ সম্মেলন থেকে সিএনএনের সাংবাদিককে একবার বেরও করে দিতে চেয়েছিলেন, তার হোয়াইট হাউজের অ্যাক্রিডেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছিল।  ট্রাম্পের এই দুর্দিনে সিএনএন একটু ঠাট্টা-তামাশা করবে না, তা হয় নাকি! সিএনএনএনের সাংবাদিক এন্ডারসন কুপারের একটা বক্তব্য যেমন ভাইরাল হয়ে গেছে, তিনি বলেছেন- ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিকে এখন দেখাচ্ছে রোদে পোড়া মোটা একটা কচ্ছপের মতো। যে কচ্ছপটা মানতেই পারছে না যে তার সময় শেষ হয়ে আসছে।’

ফক্স নিউজ- যে মিডিয়া হাউজকে ধরা হয় রিপাবলিকানদের বন্ধু হিসেবে, যারা ট্রাম্পকে হিরো বানানোতেই লেগে ছিল গত চার বছর ধরে, তারাও ট্রাম্পের বক্তব্যের সমালোচনা করছে। কট্টর ট্রাম্পপন্থীরা তাই ফক্স নিউজকে বয়কটের ডাক দিচ্ছে, টুইটারে ট্রেন্ড হচ্ছে বয়কট ফক্স নিউজের হ্যাশট্যাগ। কোথাকার জল যে কোথায় চলে যাচ্ছে, সেটা খোদ আমেরিকানরাও বুঝতে পারছে না। আনন্দে আছে ডেমোক্র‍্যাট সমর্থকেরা। রিপাবলিকানদের এই অন্তর্কোন্দল তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে তারা, খোঁচা দিতেও ছাড়ছে না অনেকে। 

সময় ফুরিয়ে এসেছে ট্রাম্পের

ভাবুন তো, আমাদের দেশের একজন সরকারদলীয় নেতা তার ভাষণে বাগাড়ম্বর করছেন, মিথ্যার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন, ভিত্তিহীন সব অভিযোগ করছেন- তখন দেশীয় কোন টেলিভিশন চ্যানেল সেই ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার সাহস রাখে? অমুক নেতা বা তমুক মন্ত্রী ভুলভাল বকছেন, একারনে আমরা তার বক্তব্য প্রচার করছি না, তাকে সংশোধনের সুযোগ দিচ্ছি- এটা বলার সাহস আছে কারো? এটাকেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে, যেটা আমেরিকায় আছে, এশিয়ায় নেই। 

রিপাবলিকান নেতারাও ট্রাম্পের এসব আজগুবি অভিযোগে পাত্তা দিচ্ছেন না। ট্রাম্পের সমর্থনে লিডসে গ্রাহাম ছাড়া আর কোন রিপাবলিকান নেতাই কথা বলছেন না। বরং আড়ালে ট্রাম্পের এসব কথাবার্তার সমালোচনা করছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার এসব বক্তব্যে আমেরিকার আইন এবং সংবিধান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে- এমনটাই তাদের বক্তব্য। ট্রাম্পের পরিবারের পক্ষ থেকে আবার রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে, বিপদের সময়ে তারা ট্রাম্পকে ব্যবহার করেছিলেন, এখন ট্রাম্পের কঠিন সময়ে কেউ পাশে থাকছেন না- এই মর্মে।

শাসক হিসেবে ট্রাম্প যেমনই হোন না কেন, দিনশেষে আমাদের কাছে তিনি মজার একজন মানুষ ছিলেন। তার আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের অবনতিও ঘটেনি, বরং যুদ্ধ-বিগ্রহের হিসেব কষলে পূর্বসূরিদের চেয়ে শান্তিপ্রিয়ই ছিলেন ট্রাম্প, ঝানু ব্যবসায়ী হওয়ায় অস্ত্রের চেয়ে মগজের চাল বেশি চেলেছেন তিনি। শেষবেলায় তার এমন করুণ দশা দেখে খারাপই লাগছে। তবে এসবের পেছনে গোটা দায়টা তারই। সুন্দরভাবে পরাজয় মেনে নিলেই গোটা ব্যাপারটা ভদ্রভাবে চুকে যায়। কিন্ত মানুষটার নাম যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প, তিনি তো আর সোজা রাস্তায় হাঁটবেন না কোনভাবেই...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা