নামের পাশে এত অপকর্মের ফিরিস্তি থাকার পরেও ওসি প্রদীপ বহাল তবিয়তে চাকরি করে যাচ্ছিলেন, কারন যাদের এসব দেখার কথা, তাদেরকে আগেই 'ম্যানেজ' করা হয়ে গেছে! কী সেই ম্যানেজের মন্ত্র?
সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে আটক হবার পর থেকেই একটার পর একটা চাঞ্চল্যকর খবর বেরিয়ে আসছে। প্রথমে সিনহাকে গুলি করে খুন করেছেন যে পুলিশ অফিসার, সেই ইন্সপেক্টর লিয়াকত সহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হলেন। মামলা হবার পর টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসও আত্মসমর্পণ করলেন, এখন আবার বেশ কিছু গণমাধ্যম দাবী করছ্ব, কক্সবাজারের পুলিশ সুপারের নির্দেশেই নাকি ঘটনাটাকে ক্রসফায়ারের নাটক হিসেবে সাজানো হয়েছিল। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের ডকুমেন্টরি ফিল্ম- সবকিছু নিয়ে এত বেশি ঘোলাটে হয়ে গেছে ঘটনাটা, যেন রহস্যের জাল বিছানো হয়েছে প্রতি পরতে পরতে।
তবে আমরা সেই রহস্যের খোঁজ নিতে যাব না। সেটার সমাধান পুলিশ আর সেনাবাহিনীর সদস্যরা করবেন, যৌথ কমিশন গঠন করা হয়েছে ঘটনার তদন্তে, তারাই বলবেন সেদিন রাতে আসলে কি ঘটেছিল। তবে এখানে একটা বিষয় তো দিনের আলোর মতো পরিস্কার। সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে, কোন যুক্তিতেই তার এই হত্যাকান্ডকে জাস্টিফাই করার কোন উপায় নেই।
এদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডটা ডালভাতের মতো স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা এর শিকার হয়েছেন বলেই হয়তো এত মাতামাতি হচ্ছে, কমিটি গঠন করা হচ্ছে, কিন্ত সেই ২০০৪ এর মাদকবিরোধী অভিযান থেকে শুরু করে স্কুলছাত্র লিমনকে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া কিংবা জনৈক হারকিউলিসের নাম করে 'ধর্ষক' অভিযোগ তুলে কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা থেকে আজকের সিনহা হত্যাকান্ড- ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ইতিহাসটা এদেশে অনেক পুরনো।
সন্ত্রাস নির্মূলের নাম করে যে ক্রসফায়া কালচারের সূত্রপাত হয়েছিল, সেই সংস্কৃতি পরে কারণ হয়েছে অজস্র নিরীহ মানুষের মৃত্যুর। এসআই লিয়াকত বা ওসি প্রদীপের মতো মানুষেরা পুলিশ বা র্যাবের পোষাক পরে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে এই ক্রসফায়ারের নামে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গুচ্ছ গুচ্ছ ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটিয়ে বরং পুরস্কৃত হবার নজিরই আছে। ওসি প্রদীপ যেমন পেয়েছেন পুলিশি মেডেল, সেই পুরস্কারের সুপারিশে তার বীরত্বের সপক্ষে উদাহরণ হিসেবে হাজির করা হয়েছিল তার হাতে অন্যায়ভাবে 'সন্ত্রাসীদের' নিহত হবার ঘটনাগুলোলেই। মেজর সিনহার জায়গায় যদু মধু রাম শাম কেউ মারা গেলে এই ইস্যুতে এত আলোচনাও হতো না, প্রদীপ-লিয়াকতদের এসব অপকীর্তির ইতিহাসও উঠে আসতো না অন্ধকার গহবর থেকে।
এখন যেমন জানা যাচ্ছে, টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের প্রতাপ ছিল পুরো চট্টগ্রাম বিভাগেই। পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় প্রত্যাহারের আগেও বেশ কয়েক বার প্রত্যাহার এমনকি বরখাস্ত হয়েছিলেন এই ওসি। ১৯৯৬ সালে চাকরি শুরুর পর কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় কাটে চট্টগ্রাম মহানগর ও কক্সবাজারে। তার বিরুদ্ধে অন্যের জমি দখলই নয়, নিজের পরিবারের সদস্যদের জমি দখলেরও অভিযোগ আছে। এরপরেও বহাল তবিয়তে তিনি চাকরি করে গিয়েছেন, তার টিকির নাগালও কেউ পায়নি। কীভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করা হলো? ওই প্রশ্ন করাটা নিশ্চয়ই অবান্তর নয়।
ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনে পুলিশ কর্মকর্তাদের অসৎ কাজে জড়িয়ে পড়া নিয়ে ভয়ংকর কিছু তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে দাবী করা হয়েছে, মামলা করতে গেলে অনেকক্ষেত্রে বাদী-বিবাদী উভয়ের কাছ থেকেই থানায় টাকা নেয়া হয়। জিডি করতেও টাকা দিতে হয় অনেক জায়গায়। যৌন নির্যাতনের শিকার শতকরা ৮৪ জন নারীই থানায় যেতে চান না। এর কারণ হিসেবে তারা পুলিশের দ্বারা হেনস্তা হওয়ার কথা বলেছেন। এই ঘটনাটা আমরা ফেনীর নুসরাতের বেলায় দেখেছিলাম, ওসি মোয়াজ্জেম থানার ভেতরে কিভাবে ভিডিও করার মাধ্যমে আরেকদফা শ্লীলতাহানি করেছিল তার। এমন ঘটনা শুধু সোনাগাজী নয়, দেশের অনেক থানাতেই ঘটে।
প্রদীপ বলুন, লিয়াকত বলুন, কিংবা অন্য সব অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা, তারা তো চাকরিতে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই অসৎ ছিলেন না। মানুষের সেবা করার শপথ নিয়ে চাকরিতে ঢোকা লোকগুলো দুই নম্বুরী রাস্তাটা আবিস্কার করে কিভাবে? প্রতিটা থানায় মনিটরিংয়ের দায়িত্বেও পুলিশ কর্মকর্তারা থাকেন, ওসির ওপরে থাকেন সার্কেল এসপি, এসপি, ডিআইজি। এদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কীভাবে প্রদীপ-লিয়াকতরা অবৈধ আয় দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন?
ইত্তেফাক বলছে, পুলিশের দুর্নীতি এবং অপরাধে জড়িত হবার বিষয়গুলো দেখভাল করার জন্য উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থা, এবং দুদক কর্মকর্তা- সবাই আছেন। কিন্ত সবটাই নামে, আসলে দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন করেন না কেউই। এজন্য অধিকাংশ ওসি বেপরোয়া। তাছাড়া কোনো কোনো থানার ওসি বদলি হতে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়। শুনে অবাক হবেন, টেকনাফ থানার ওসি হতে ১ কোটি টাকা ঘুষ দেয়া লাগে! কক্সবাজার সদর, মহেশখালী ও চকোরিয়া থানার ওসি হতে বিপুল পরিমাণ অর্থের ঘুষ লাগে।
যেসব থানায় বদলি হতে ঘুষ বেশি লাগে, সেসব থানাকে গুরুত্বপূর্ণ থানা বলা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে হাইওয়ের প্রতিটি থানা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইয়াবা রুট হিসেবে এগুলো ব্যবহৃত হয়, বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ ইয়াবার চালান তো টেকনাফ দিয়েই ঢোকে। থানায় টাকা দেয়া থাকলে পুলিশ চালান ধরবে না। আর টাকা না দিলে চালান তো আটকে যাবেই, ক্রসফায়ারে ফেলে ইয়াবা ব্যবসায়ীকে খতম করে দেয়ার হুমকিও দেয়া হবে। প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে আপত্তি থাকে না ইয়াবা ব্যবসায়ীদের, আর যারা টাকা দিতে চায় না, তারা মরে পড়ে থাকে, পত্রিকায় ছাপা হয়, পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত, এত পিস ইয়াবা উদ্ধার!
ইত্তেফাকের দাবী অনুযায়ী, পুলিশ কনস্টেবল থেকে ডিআইজি র্যাংক পর্যন্ত অনেকেই এই অবৈধ টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন (অবশ্যই সবাই নন)। একারণে প্রদীপ বা লিয়াকতের মতো পুলিশ অফিসাররা দিনের পর দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠার সাহস পান, ধরাকে সরা জ্ঞান করেন, কারণ কিছু হলে তাদেরকে রক্ষা করার জন্যে মাথার ওপরে তো বড় অফিসাররা আছেনই! এক ওসি প্রদীপকেই দেখুন, নামের পাশে এত অপকর্মের ফিরিস্তি থাকার পরেও তিনি বহাল তবিয়তে চাকরি করে যাচ্ছিলেন, কারন যাদের এসব দেখার কথা, তাদেরকে আগেই ম্যানেজ করা হয়ে গেছে।
গোটা ঘটনাটাকে পুলিশ যেভাবে ডিল করছে, সেটাও কিছু ক্ষেত্রে হতাশা উপহার দিচ্ছে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন, সিনহা হত্যাকান্ডের পরে তিনি প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে খোঁজ না নিয়ে ওসি প্রদীপের কাছে শোনা গল্পটাই সংবাদমাধ্যমের সামনে বলে গেলেন- এটা দায়িত্বহীনতার পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। সিনহার সঙ্গে ডকুমেন্টরি বানানোর কাজে রিসোর্টে থাকা দুজনকে আটক করে রেখেছে পুলিশ, তাদের নামে দেয়া হয়েছে মিথ্যা মামলা- ফিল্ম বানানোর জন্য গিয়ে অযথা ভুগতে হচ্ছে ছেলে-মেয়েগুলোকে। আবার তাদের মুক্তির দাবীতে যখন মানববন্ধন করা হচ্ছে, তখন কোথাও কোথাও সেই মানববন্ধনে হামলা করছে পুলিশই!
আজই বরগুনার বামনায় অনুষ্ঠিত এক মানবন্ধনে পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটেছে, পেটানো হয়েছে মানববন্ধনে অংশ নেয়া ছাত্রদের। সেই থানার ওসিকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছে যে কেন আপনারা শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে লাঠিচার্জ করলেন, তখন তিনি মুখস্ত উত্তর দিয়েছেন, এরা সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে রাস্তায় নেমেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বামনা থানার ওসির আমলনামাও ওসি প্রদীপের চেয়ে কম কিছু নয়! পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ কি এই ঘটনাটাকে পার্সোনাল এজেন্ডা হিসেবে নিয়েছেন? দোষ করেছেন ওসি প্রদীপ, এসআই লিয়াকত এবং তার সাথে থাকা কয়েক কনস্টেবল। তাদের বাঁচাতে গিয়ে পুরো বাহিনীর নাম খারাপ কেন করছে বাকীরা?
গোটা করোনাকালে পুলিশ যেভাবে জীবন বাজি রেখে কাজ করেছে, ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র হয়ে লড়েছে, নিজেরা আক্রান্ত হয়েও দেশের মানুষকে নিরাপদ রাখার মিশনে কাজ করেছেন আপ্রাণ। বাহিনীর ভাবমূর্তি ফিরে এসেছে দারুণভাবে, পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা আর ভরসার শূন্য জায়গাটা ভর্তি হয়েছিল দারুণভাবে। ওসি প্রদীপ বা ইন্সপেক্টর লিয়াকতদের কর্মকাণ্ডে সেটা নষ্টই হচ্ছে, প্রদীপ-লিয়াকতরা এক বালতি দুধের মধ্যে দুই ফোঁটা গোমুত্রের মতোই, পরিমাণটা কম, কিন্ত মিশে গেলে গোটা দুধটাই খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন